সামাজিক জীবনে রোজার আবেদন

লিখেছেন লিখেছেন নিশান শাহীন ২৯ জুলাই, ২০১৩, ০৬:১৪:৫৭ সন্ধ্যা



রমাদান মাস মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। তাকওয়া অর্জনের মাস রমাদান। নেকি হাসিলের মাসও এটি। লাইলাতুল কদর এবং কোরআনের মাসও রমাদান। এ মাসের মর্যাদা অনেক। এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন বান্দা পরিণত হতে পারে সোনার মানুষে।

সামাজিক জীবনে রোজার প্রভাব অনেক। যেমন :

১. তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠন : আল্লাহর ভয় মানুষকে সব ধরনের কুকর্ম থেকে বিরত রাখে। কঠোর আইন রচনা ও প্রয়োগ করে যা করা যায় না খোদাভীতির মাধ্যমে তা সহজেই করা সম্ভব। আল্লাহভীতি মানুষকে উত্তম মানুষে পরিণত করে। উত্তম মানুষ সমাজের অপরিহার্য অংশ। রমাদানের রোজা পালনের মাধ্যমে একজন বান্দা পরহেজগারিতার চূড়ান্ত প্রশিণ লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা রোজাকে ফরজও করেছেন তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনের নিমিত্তে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে করে তোমরা খোদাভীরু হতে পার’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৩)।

২. সুশৃঙ্খল জীবন গঠন : রোজা মুসলিম নর-নারীকে সুশৃঙ্খল জীবন গঠনে অভ্যস্ত করে। রমাদান মাসজুড়ে থাকে কঠিন নিয়মকানুন অনুশীলনের বাধ্যবাধকতা। প্রতিদিন সুবহে সাদিকের আগেই সাহরি গ্রহণের পর আর কোনো আহার গ্রহণ না করে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে মাগরিবের সময় ইফতার করি। মাগরিবের নামাজের কিছু পরই আবার তারাবির নামাজ। তারাবির শেষে একটু বিশ্রাম আবার জেগে ওঠা তাহাজ্জুদ এবং সাহরির জন্য। এ এক কঠোর অনুশীলন।

৩. ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপন : সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন রোজাদার ঐক্যবদ্ধ জীবন গঠনের প্রশিণ লাভ করেন। মূলত ইসলামের সব ইবাদতের মধ্যেই একতাবদ্ধ হওয়ার শিা নিহিত আছে। একই সময় সাহরি গ্রহণ, একই সময় ইফতার করা, জামায়াতবদ্ধভাবে তারাবির নামাজ আদায়, একসঙ্গে ঈদ আনন্দ করা, একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করার মধ্যে রয়েছে একতার শিা। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েই ্যান্ত হননি; তিনি যেসব ইবাদত ফরজ করেছেন তার প্রতিটির মধ্যে মুসলমানের একতাবদ্ধ হওয়ার বাস্তব ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন।

৪. লোভ লালসামুক্ত সমাজ বিনির্মাণ : লোভ-লালসা মানুষকে ধ্বংস করে। সমাজে যত ধরনের বৈষম্য তা মানুষের লোভের প্রতিফল। রোজা মানুষের লোভকে জ্বালিয়ে ফেলে। যে ব্যক্তির সামনে হাজারো কোরমা, পোলাউ, বিরিয়ানি এবং নিজের সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাকে স্পর্শ করে না, সে কীভাবে অন্যায়ভাবে অন্যের মাল লুণ্ঠন করবে? যিনি রোজা রাখবেন, তিনি কখনও হারাম জিনিসের প্রতি লোভ রাখতে পারেন না।

৫. সহমর্মিতা : রোজা পালনের মাধ্যমে একজন বান্দা অপরের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের বাস্তব ট্রেনিং পেয়ে থাকে। একজন ধনী মানুষ যখন সারা দিন না খেয়ে থাকে, তখন সে বাস্তবিকই অনুভব করতে শেখে যে গরিব-দুঃখীরা কীভাবে না খেয়ে কষ্ট করে জীবনযাপন করে। রোজার মাধ্যমে সে গরিবের কষ্ট অনুধাবন করতে পারে। এই অনুভূতিই তাকে অন্যের প্রতি সহমর্মী বানায়।

৬. উত্তম কাজের প্রতিযোগিতা : সমাজের সদস্যরা যত বেশি ভালো কাজ করবে, তত বেশি কল্যাণ হবে সমাজের। রমাদান মাসে একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব। দান করলে পাওয়া যায় সত্তুরগুণ সওয়াব। আল্লাহর রাসুল (সা.) এই মাসে ব্যাপক দান-খয়রাত করতেন। এ মাসে একজন রোজাদারকে ইফতার করালেও অনেক সওয়াব পাওয়া যায়। তাই এ মাসে বেশি বেশি নেকি কামানোর আসায় মুসলিম নর-নারীরা উত্তম আমলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন, যার প্রভাব সমাজ জীবনে পড়ে। সবার ভালো কাজের পাল্লায় সমাজে শান্তির সুবাতাস বয়ে যায়।

৭. কৃচ্ছ্রতা সাধন : রোজা মানুষের মধ্যে কৃচ্ছ্রতা সাধনে সহায়তা করে। সমাজ থেকে অপচয় দূর করে। যে ব্যক্তি রোজা ছাড়া যখন-তখন খাবার-দাবার গ্রহণ করত, সে এখন নিয়মের আবর্তে পড়ে দুই বেলা পরিমিত আহার গ্রহণ করছে। এ এক মহান শিা। রোজার এ শিা যে সমাজ গ্রহণ করেছে সে সমাজে গরিব-দুঃখী থাকতে পারে না। থাকতে পারে না কোনো অভাব-অনটন।

৮. আমানতদারি : একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনের জন্য সবার মধ্যে আমানতদারি থাকতে হবে। আমানতদারিতা না থাকলে কেউ কারও জন্য নিরাপদ নয়। রমাদান মাসের রোজা মানুষকে কঠিন আমানতদারি শেখায়। দিনের বেলা আহার-পানীয় ও স্ত্রী সম্ভোগের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর ভয়ে যিনি এগুলো থেকে বিরত থাকতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই বড় আমানতদার ব্যক্তি। তিনি ইচ্ছে করলেই আড়ালে-আবডালে বসে আহার গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু তিনি তা করেন না। তিনি মনে করেন, মানুষের অন্তরালে হলেও মহান রাব্বুল আলামীন আমার প্রকাশ্য ও গোপন কর্ম অবলোকন করেন। রোজার এ শিা মুসলমানের সব কর্মে প্রভাব ফেলে। আমানতদারির চেতনা জাগ্রত করতে রোজার ভূমিকা অনন্য।

৯. অনাচারমুক্ত সমাজ গঠন : অনাচারমুক্ত সমাজ গঠনে রোজার ভূমিকা অনবদ্য। হাদিসে এসেছে, ‘রোজা ঢালস্বরূপ’ অর্থাত্ রোজা রোজাদারকে সব ধরনের অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে হেফাজত করে। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখেও খারাপ কথা ও কাজকে ত্যাগ করতে পারল না, তার খাবার ও পানীয় বর্জন করে ুধার্ত থাকাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ আবার বলা হয়েছে, কেউ যদি কোনো রোজাদারকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতে আসে, সে যেন বলে আমি রোজাদার। এর অর্থ কী? এর অর্থ হচ্ছে, রোজা রেখে কোনোভাবেই অন্যায় কাজের সঙ্গে নিজকে জড়ানো যাবে না। রমাদানের পুরো এক মাস কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে বান্দা এই সুন্দর শিাকে মনেপ্রাণে লাভ করে বাকি ১১ মাস নিজেকে সব ধরনের পাপাচার ও অনাচারমুক্ত রাখার প্রেরণা লাভ করে।

১০. সম্মিলিতভাবে আনন্দ উপভোগ : রোজা যেমনিভাবে একে অপরের ব্যথা-বেদনা বোঝার সুযোগ করে দেয়, ঠিক সবাইকে আনন্দ-উত্সব উপভোগ করারও সুযোগ এনে দেয়। এক মাস সিয়াম সাধনার পর যখন আকাশে ঈদের চাঁদ ওঠে, তখন সবার মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। ঈদের আনন্দের সঙ্গে অন্য কোনো আনন্দের তুলনা হয় না। সবার মধ্যে স্বর্গীয় আনন্দ ভর করে। ঈদের ময়দানে ধনী-গরিব একত্রে ঈদের নামাজ আদায় করেন। গরিবরাও আনন্দ করার সুযোগ পায়। আল্লাহর রাসুল সদকাতুল ফিতর ফরজ করে দিয়ে গরিব-মিসকিনদের ভালো পোশাক ও ভালো খাবার আয়োজন করার সুযোগ করে দিয়েছেন।

পরিশেষে বলব, প্রত্যেক বছর রহতম, বরকত ও মাগফিরাতের বারতা নিয়ে যে রোজা আমাদের কাছে আসে, তা যেন আমরা বাস্তবিকই গ্রহণ করতে পারি। আহার-পানীয় থেকে বিরত থাকলাম অথচ মিথ্যা কথা, সুদ, ঘুষ, মদ-জুয়া, হত্যা-রাহাজানি, জেনা-ব্যাভিচারসহ কোনো অনাচারকে বর্জন করতে পারলাম না, তাহলে এই রোজার কোনো মূল্য নেই। রোজার শিা গ্রহণ করে আমরা যাতে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠন করতে পারি, সে চেষ্টাই করা উচিত আমাদের সবার। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন। আমীন।

বিষয়: বিবিধ

১৩৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File