এরপরও কি বোধদয় হবে ?
লিখেছেন লিখেছেন শারমিন ০৭ মে, ২০১৩, ০১:০১:২৫ রাত
গার্মেন্ট সেক্টর এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে বাংলাদেশে। কিন্তু সাম্প্রতিক তাজরিনের অগ্নিকান্ড ও সাভারের বিল্ডিং ধসের ফলে হাজার শ্রমিকের প্রাণহানি জন্ম দিচ্ছে অনেক প্রশ্নের। অগ্নিকান্ড প্রবন ও ঝুকিঁপূর্ণ ভবনে দিনের পর দিন হাজার শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছে। এখনো বহু গার্মেন্ট খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে এ ধরনের ঝুকিঁ এখনো বিদ্যমান।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইন্ডাস্ট্রির নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য আলাদা বোর্ড থাকে। ওই বোর্ড নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে থাকে । যেমন আমেরিকার OSHA (Occupational Safety and Heath Administration) , বৃটেনের HSE (Health, Safety and Emergency) বোর্ড , নরওয়ের PSA (Petroleum Safety Authority)। ঐসব দেশে কোনো কারখানার উত্পাদন শুরুর পূর্বে প্লান, লেআউট ও কর্মপদ্ধতি এসব কর্তৃপক্ষের নিকট হতে অনুমোদন করাতে হয় যেখানে দেখাতে হয় ওই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকগণ কতখানি নিরাপত্তা বা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে । যতখানি ঝুঁকি থাকবে তা অনুমোদিত কিনা । একে বলা হয় রিস্ক এসেসমেন্ট। বাংলাদেশে কি এ ধরনের কোন কর্তৃপক্ষ রয়েছে ? সাভার ট্রাজেডির পর সরকার ঘোষনা করেছে যে আগামী তিন মাসের মধ্যে সব গার্মেন্ট পরিদর্শন করা হবে। তাজরিনের ঘটনার পর বুয়েটের অধ্যাপকদের সমন্নয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হলো। তারা চারটি কারখানা পরিদর্শন করে রিপোর্ট তৈরী করলেন। অথচ সেই রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহনের নুন্যতম উদ্যোগ নেয়া হলো না । তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই চারটি কারখানা তৈরির সময় স্ট্যান্ডার্ড ইন্ডাস্ট্রি কোড অনুসরণ করা হয়নি । চারটি নামকরা ফ্যাক্টরির যদি এই অবস্থা হয় তবে বাকিগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। দেশের অন্য কারখানাগুলো পরিদর্শনের ব্যবস্থা কি করা যেত না এই কয়েক মাসে। দেশী বা বিদেশী বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া যেত। বিশ্বের অনেক নামকরা কোম্পানি আছে যারা শুধু এসব অডিট এর কাজ করে থাকে।
বাংলাদেশে একটি কর্তৃপক্ষ আছে কারখানা পরিদর্শন পরিদফতর । ইন্ডাস্ট্রিগুলো সঠিক নিরাপত্তা কোড অনুসরণ করছে কিনা তা তাদেরই দেখার কথা । ওই পরিদফতর যে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না তাতো বোঝাই যাচ্ছে। ওই পরিদফ্তরে যোগ্য এক্সপার্ট আছে কিনা সেটাও প্রশ্ন । সরকার পরিদফতরের আঙ্গিক পরিবর্তন করে অধিদফতর করতে যাচ্ছে । জনবল নিয়োগের কথাও শোনা যাচ্ছে । যে অধিদফতরই গঠন করা হোক তাদের কাজের পরিধিতে নিরাপত্তার সবগুলো বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন । সেই সাথে প্রয়োজন নিরাপত্তা বিষয়ক আইন প্রনয়ন।
বাংলাদেশে একটি সমন্নিত কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন। ফ্যাক্টরি চালুর পূর্বে ওই কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফ্যাক্টরিগুলো পরিদর্শন করা হবে। শুধু দুর্ঘটনা ঘটার পর একটি টাস্কফোর্স গঠন করে কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করলেই হবে না। শুধু গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো কর্তৃপক্ষের আওতায় আনলে হবে না। সব ধরনের কেমিক্যাল , মেকানিক্যাল এমনকি ফুড ইন্ডাস্ট্রিও পর্যবেক্ষণের আওতয় আনা প্রয়োজন। আমাদের দেশে দুর্ঘটনার কোন পরিসংখ্যান করা হয় না। বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতের খবর পত্রিকাগুলোয় বড় করে ছাপা হয় । কোন ফ্যাক্টরি দুর্ঘটনায় লোক নিহত হলে পত্রিকার এক কোনে ছোট করে ছাপা হয়। এ বিষয়গুলো লাইম লাইটে না আনলে কখনই অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
নির্মাণরত বিল্ডিং থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যুর কথা প্রায়ই শোনা যায়। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শ্রমিকের নিরাপত্তার বিধান করা। কেন সেই ধরনের প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা প্রতিমুলক নেয়া হয় না ? ঐসব নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে কি কোম্পানির পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় ? বিল্ডিং এ ফাটল ধরার পরও বিল্ডিং ও গার্মেন্ট মালিক দ্বারা শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করান সাভার ট্রাজেডির কারণ এটা আমরা সবাই জানি। বিল্ডিং মালিকই কি একমাত্র অপরাধী ? বিল্ডিং এর নির্মান কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলী কতৃক বাজে মেটেরিয়াল ব্যবহার বিল্ডিং ধস কে তরান্নিত করেছে । কিন্তু একটি আবাসিক বিল্ডিং এ পাঁচটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি চালানোর অনুমতি সাভার পৌরসভা কিভাবে দিল ? আবাসিক বিল্ডিং কে ফ্যাক্টরি হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিলে সমস্যা হতে বাধ্য । ফ্যাক্টরিতে হাজার লোক কাজ করছে । প্রতিদিন উচ্চ ভোল্টের জেনারেটার ব্যবহার, বিভিন্ন প্রকার ইকুইপমেন্ট ও মেশিনের লোড কোনো আবাসিক বিল্ডিং নিতে পারবে না । এছাড়া বিভিন্ন এক্সপ্লসিভ মেটেরিয়াল ব্যবহার হতে পারে যা অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি বাড়াবে । এছাড়া ইমার্জেন্সি এক্সিট ও সিড়ির প্রস্বস্ততা ইত্যাদি ব্যাপারও রয়েছে। রানা প্লাজায় যদি ধস না হয়ে অগ্নিকান্ড হত তাহলেও যে বহু প্রাণহানি হত তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।
মোট কথা শিল্প কারখানার সার্বিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়া ও তার যথাযথ প্রয়োগের জন্য দরকার একটি সমন্নিত কর্তৃপক্ষ । যারা কারখানা চালুর পূর্বে সকল বিষয় পর্যবেক্ষণ করে সনদ প্রদান করবে এবং তারপরই উত্পাদন শুরু হবে। অনেকেই হয়ত বলবেন সরকারী আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব ইত্যাদির কথা। তবে এও বলতে পারি সরকার ও মালিক পক্ষের এই অনিচ্ছা সত্তেও আমরা তাদের বাধ্য করতে পারি আইন মেনে চলার জন্য। আর তা হলো জনসচেনতা সৃষ্টির মাধ্যমে । একটি কালচার তৈরির মাধ্যমে যেখানে সেফটি হবে প্রধান বিবেচ্চ্য বিষয়। দেখা যায় আমাদের দেশের শ্রমিকগণ এ ব্যপারে এতই অজ্ঞ যে দিনের পর দিন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করাকে তারা নিয়তি বলে মেনে নিচ্ছে, অথচ শ্রমিকদের যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান মালিকদেরই দায়িত্ব ।
এই শতাব্দীর শুরুতেও ইউরোপ এ শ্রমিক নিরপত্তা, কর্মস্থলে নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে এতটা গুরুত্ব দেয়া হত না । ফলশ্রুতিতে অনেক দুর্ঘটনা , শ্রমিকের প্রাণহানির ফলে এক গণজাগরণ তৈরী হয় । আর সরকার বাধ্য হয় কঠিন আইন প্রয়োগ করতে । বর্তমানে এসব দেশগুলোতে সেফটিকে এত গুরুত্ব দেয়া হয় যে, বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট বন্ধ থাকে শুধু সেফটির সামান্য ত্রুটির কারণে। যারা খনিতে কাজ করে তাদের উচ্চ বেতন প্রদান করা হয় , সেইসাথে প্রচুর ছুটি, বিশেষ ইন্সুরেন্স , স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদি । এসব সুবিধা এজন্যই দেয়া হয় যে একজন শ্রমিক জীবনবাজি রেখে খনিতে কাজ করে । কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায় বিপরীত চিত্র । অন্যান্য টেকনোলজির মত আমরা এখানেও পিছিয়ে আছি অনেক। হেলথ ইন্সুরেন্স নামক একটি ইন্সুরেন্স আছে যা করা হয় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য। এটি আমাদের দেশের অনেক সাধারণ মানুষও জানে না। এছাড়াও আছে ক্ষতিপূরণের ব্যাপার । কর্মস্থলে দুর্ঘটনার কারণে শ্রমিকের মৃত্যু হলে তার পরিবার কত ক্ষতিপূরণ পাবে বা অঙ্গহানি হলে শ্রমিক কত ক্ষতিপূরণ পাবে তার একটি স্ট্যান্ডার্ড অবশ্যই থাকা দরকার। সরকারী আইন হয়ত আছে । মালিক পক্ষ তা দিচ্ছে না আর শ্রমিকও দাবি করছে না তার অজ্ঞতার কারণে। এজন্যই দরকার সচেতনতা। দরকার একটি কালচারের প্রবর্তন । যেখানে শ্রমিক নির্ধারণ করবে কোন কারখানায় সে কাজ করবে না করবে না, তার নুন্যতম মজুরি কত হওয়া উচিত, কর্তৃপক্ষ তাকে যথাযথ নিরাপত্তা দিচ্ছে কিনা ইত্যাদি ।
বলা হয় বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার বিষয়ে ILO (International Labor Organization) এর স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা হয়। সেই স্ট্যান্ডার্ড এ পরিস্কার বলা আছে শ্রমিকরা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ইউনিয়ন গঠন করতে পারবে। অথচ বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেয়া হয় না। আমরা কি মধ্যযুগে ফিরে গেছি? মাননীয় পোপ আমাদের দেশের শ্রমিকদের অবস্থাকে দাস প্রথার সাথে তুলনা করেছেন । সত্যিই তো তাই ।
শোনা যাচ্ছে সভার ট্রাজেডিতে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে বিশ হাজার টাকা ও আহত শ্রমিকদের পাঁচ হাজার করে দেয়া হবে । মানব সৃষ্ট দুর্যোগে যারা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করলো , যাদের জীবনে নেমে আসলো বেঁচে থাকার দুঃসহ বোঝা তাদের জন্য কেবলই পাঁচ হাজার! আর কি বলব? আমরা একটি মধ্যযুগীয় পুঁজি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি । শ্রমিকের হারভাঙ্গা মেহনতে গড়ে তোলা সভ্যতার উপর আরামে বাস করছি আর বিল্ডিং এর নিচে চাপা পরা অগনিত মানুষের জন্য কেবল বলছি 'আহা বেচারা'!
বিষয়: বিবিধ
১২৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন