রাজনীতিবিদদের নিকট জিম্মি যে গণতন্ত্র
লিখেছেন লিখেছেন মেফতাউল ইসলাম ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১১:৫৩:৩১ সকাল
অলৌকিকভাবে সরকারি ও বিরোধীদলের নেত্রীদ্বয়ের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে আগামী বছরের ৫ই জানুয়ারি বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে কে জিতবে তা আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি। প্রত্যেকটি দেশেই নির্বাচনের পূর্বে কোন দল জয়ী হবে বা কোন দল পরাজিত হবে এ নিয়ে বিভিন্ন জরিপ হয়ে থাকে। এর ভিত্তিতে আমরা অনুমান করে নেই নির্বাচানের ভবিষ্যৎ ফলাফল কি হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এবারে নির্বাচনের পূর্বে এ ধরনের জরিপ না হলেও ভোটের ময়দানের হিসাব-নিকাশে আওয়ামীলীগের বিজয় এক রকম নিশ্চিত হয়ে গেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই যদি কোন দল ১২৭টি আসন পেয়ে থাকে তবে নির্বাচনের পরে সে দলটি কতটি আসন পেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মোদ্দকথা, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগের ক্ষমতাসীন হওয়ার বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।
বিরোধী দলের বুদ্ধিজীবিরা ইতিমধ্যে হিসাব কষতে শুরু করেছেন নতুন আওয়ামী সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে। একজন কলাম লেখকের সাথে আলাপ চলাকালে তিনি আমাকে বলেই ফেললেন যে, আওয়ামীলীগ সরকার নির্দ্বিধায় আরো দু’বছর ক্ষমতায় থাকবে। এমনকি বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও একটি বিষয়ে একমত যে, সরকার যেকোন মূল্যে আগামী কিছুদিনের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখবে। সুতরাং সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর জন্য বিরোধী দলও একের পর এক আন্দোলনের পসরা সাজিয়ে রাখবে। তার মানে সরকার যতদিন ক্ষমতা ধরে রাখবে ততদিন পর্যন্ত বিরোধীদল রাস্তায় গাড়ি পুড়াবে, নিরীহ যাত্রীদের শরীরে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারবে, রাস্তার গাছ কেটে অবরোধের সৃষ্টি করবে, জনগণকে ঘরে বসে রাখতে বাধ্য করবে।
নির্বাচন নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের এ হঠকারিতার জন্য অন্যান্য দলগুলোর মূল্যায়ন অনেকটা বেড়ে গেছে। সাবেক স্বৈরাচারীকে সাথে নিয়ে আওয়ামীলীগ তার নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে চেয়েছিলো। কিন্তু সাবেক স্বৈরাচারী হঠাৎ করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলে তাকে কৃত্রিম রোগী বানিয়ে রাখা হয়েছে হাসপাতালে। না জানি, তাকে কবে আধুনিক চিকিৎসার নামে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়। স্বৈরাচারী বেকে বসলে কি হবে, তার বিবাহিত বধূ তো সরকারের লেজ ধরে বসে আছে। সরকারী দলের দয়ায় ইতিমধ্যে কয়েকটি আসনও নিশ্চিত হয়েছে তাদের। এমনকি ভবিষ্যতে প্রধান বিরোধী দল হবার বাসনাও তাদের পূরণ হতে চলেছে। সুতরাং কুইন মেকারের স্ত্রীর দুরদর্শিতার জন্য অবশ্যই তাকে বিদ্যুষী বলে আখ্যা দেয়া যায়।
জোটের রাজনীতির কারণে আমরা দেখছি বিএনপি জামায়াতকে তাদের সহোদর হিসেবে গ্রহণ করেছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর দল হলেও তারা জামায়াতকে ছাড়তে নারাজ। বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু ও কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিএনপি পড়েছে চরম বিপাকে। একদিকে তারা চাচ্ছে জামায়াত তাদের সাথে থাক, অন্যদিকে পাবলিক সেন্টিমেন্টের কারণে জামায়াতীদের সাথে তারা খুব বেশি মেশামেশিও করতে পারছেনা। তবে তারা কোনভাবেই জামায়াতকে ছাড়তে প্রস্তুত নয়। কারণ তারা এটা ভালো করেই জানে, জামায়াতকে ছাড়া তাদের একার পক্ষে রাজনীতির মাঠ গরম রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং নিছক দলীয় স্বার্থের কারণে আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিতর্কিত দুটি রাজনৈতিক দলকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
দেশের এ প্রধান দুটি দলের রাজনৈতিক অদুরদর্শিতা ও অপরিণামদর্শিতার জন্য কেউ কেউ ভাবছেন তৃতীয় কোন শক্তির উত্থান দরকার। কিন্তু আমি বলব, তৃতীয় কোন শক্তির উত্থান তখনই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে যদি তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে তৃতীয় কোন শক্তির উত্থানকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু একটা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানকে আমি কখনই প্রশ্রয় দেই না। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিকভাবে তৃতীয় কোন শক্তির উত্থান অনেকটাই অসম্ভব বলে বিবেচিত। এমনকি আমরা রাতারাতি পারিবারিক রাজনীতির সংস্পর্শ থেকেও বেড়িয়ে আসতে পারবো না। সেক্ষেত্রে বাস্তবতা হল, প্রধান দু’দলকে মানদন্ড ধরেই আমাদের এগিয়ে চলতে হবে। তবে পারিবারিক রাজনীতির সংস্পর্শ থেকে আমরা সহজেই বের হয়ে আসতে পারি। সেক্ষেত্রে একজন প্রার্থী দু’বারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেনা, এ সংক্রান্ত একটি আইনই যথেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে। তবে আইন তৈরির কাজটি যেহেতু রাজনীতিবিদদের দাঁড়াই হয়ে থাকে তাই এটিও তাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।
আর বর্তমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য প্রধানমন্ত্রী একাই যথেষ্ঠ। যেহেতু এই পদটির জন্যই বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে না তাই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগই চলমান সংকটের একমাত্র সমাধান বয়ে আনতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য রাজনীতি করেন না, তিনি রাজনীতি করেন দেশের মানুষের জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যদি দেশের মানুষের জন্যই রাজনীতি করেন তাহলে গণভোট দিয়ে যাচাই করে দেখুন না, জনগণ আপনার অধীনে নির্বাচন চায় কিনা? সব রাজনীতিবিদরাই দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করে। কারণ রাজনীতির চাষাবাদ মানুষকে নিয়েই। তবে এটাও সত্য যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদই ক্ষমতার লোভে রাজনীতি করে। আমাদের দেশে ক্ষমতাই রাজনৈতিক চর্চার একমাত্র অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যতই বলুক না কেন তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য রাজনীতি করেন না, কিন্তু জনগণ তা বিশ্বাস করেনা। আবার বিরোধী দলও যতই বলুক না কেন গণতন্ত্র ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই তারা হরতাল ও অবরোধের মত কর্মসূচী পালন করছে এটাও জনগণ বিশ্বাস করেনা। কারণ রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জনগণ এখন সহজেই অনুমান করতে পারে। রাজনীতিবিদরা যদি দেশ ও জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনাই করতো তাহলে একের পর এক হরতাল, অবরোধ দিয়ে বিএনপি জনগণকে ঘরে জিম্মি করে রাখতো না। আবার আওয়ামীলীগ যদি দেশের জন্যই রাজনীতি করতো তাহলে দেশের ৯০ ভাগ মানুষের চাওয়াকে তারা এক নিমেষেই ফুৎকার দিয়ে উড়িয়ে দিত না। সুতরাং, রাজনীতিবিদদের গলাবাজি দেশের কল্যাণ বয়ে আনবেনা বরং দেশকে খাদের কিনারে নিমজ্জিত করবে।
বর্তমান সরকারের একগুয়েমির কারণে দেশ ধীরে ধীরে রসাতলে যাচ্ছে। বিদেশী প্রভুরা আমাদের দেশকে নিয়ে দরকষাকষিতে নেমেছে। তারা পরামর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। আমরা নিজেরাই আমাদের দেশকে নিয়ে বিদেশীদের নাক গলানোর সুযোগ করে দিচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ হাসিলে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করছে। চীনও বাংলাদেশকে নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে। এভাবে দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই খেলার পাত্রে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ।
মহান বিজয় দিবসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিগণ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাননি। এটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মারাত্মক লংঘন। ধারনা করা হচ্ছে, সরকারের একগুয়ে নীতির কারণেই সরকারের প্রতি অনাস্থার প্রতীক হিসেবে তারা এ কাজটি করেছে। এটা বর্তমান সরকারের জন্য একটি চরম বার্তা। এর মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হল যে, সরকার যদি তার একদলীয় নির্বাচনের রূপরেখা হতে সরে না আসে তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রও সরকারের কর্মকান্ডে তেমন খুশি নয়। সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিলে যুক্তরাষ্ট্রও সেই একই পথে হাটতে পারে।
আমরা যদি নিজেরাই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে না পারি তবে বিদেশী প্রভুরা আমাদের দেশীয় বিষয় নিয়ে আরো বেশি নাক গলানোর চেষ্টা চালাবে। এক্ষেত্রে বিদেশীদের একপক্ষ আওয়ামীলীগকে সমর্থন দিয়ে আবার অন্যপক্ষ বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালাবে। ভারত আওয়ামীলীগের সাথে দরকষাকষিতে লাভবান হওয়ার কথা ভেবে বর্তমান সরকারের কর্মকান্ডকে সমর্থন দিচ্ছে। বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের অনায্য চুক্তি করতে ভারত আমাদেরকে চাপ দিচ্ছে। আবার সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন লাভের আশায় টিকফার মত একটি সা¤্রাজ্যবাদী চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সুতরাং সরকারি ও বিরোধী দলের হঠকারীতার জন্য বিদেশীপ্রভুরা আজ আমাদের দেশটাকে লুটেপুটে খাওয়ার সুযোগ পাবে।
ত্যাগ স্বীকার ও অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শণ গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। কিছু বিষয়ে ছাড় দেয়া ও সমঝোতার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের এই গুণগুলো আমাদের রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের মাঝে একবারেই অনুপস্থিত। ছাড় দেয়াকে এখানে পরাজয়ের সামিল বলে বিবেচনা করা হয়। কোন দল কোন বিষয়ে সমঝোতা করতে চাইলে বিরোধী পক্ষ সেটাকে অপর রাজনৈতিক দলটির দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করে। এ কারণেই আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল কেউ কাউকে সামান্য ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। অথচ কোন দল সমঝোতা ও আপোষ করলে তাদেরকে ইতিহাসে শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করা হত। রাজনীতিবিদদের বোঝা উচিত আজকে তারা যা করছেন তাই আগামী দিনের ইতিহাস বলে বিবেচিত হবে। তাই রাজনীতিবিদদের নিকট আমার প্রশ্ন, আপনারা কি চান না ইতিহাসের পাতায় আপনাদের কর্মকান্ড স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকুক? নাকি আপনারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকতে চান? আপনারা কি ইতিহাসের নায়ক বা প্রবাদপুরুষ হয়ে থাকতে চান, নাকি খলনায়কের পাতায় নাম লেখাতে চান?
বিষয়: রাজনীতি
১৩৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন