পর্যটনশিল্প এবং আমাদের কক্সবাজার।
লিখেছেন লিখেছেন মেফতাউল ইসলাম ১০ মে, ২০১৩, ০৩:১৭:৪৩ দুপুর
কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। বিশ্বের দীর্ঘতম এ সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে রাখছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। পর্যটন খাত থেকে বাংলাদেশ যা আয় করে তার অধিকাংশই আসে পর্যটননগরী কক্সবাজার থেকে। বিদেশী কোন পর্যটক বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে আসলে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে কক্সবাজারকে রাখে সবার শীর্ষে। শুধু বিদেশীদের নিকট নয় বাংলাদেশীদের নিকটেও এ পর্যটননগরী ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তাই কক্সবাজারের এই পর্যটন খাত থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারে। আবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু খনিজসম্পদ যা উত্তোলনে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। কক্সবাজারের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের বদরমোকাম পর্যন্ত টানা ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সমুদ্র সৈকত। সমুদ্র সৈকত, হিমছড়ি, ইনানী বিচ, লাবণী বিচ ছাড়াও জেলার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানের মধ্যে কক্সবাজার শহরের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির, ডুলহাজরার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, টেকনাফের মাথিনের কুপ, মেরিন ড্রাইভ সড়ক, রামুর রাম কোট ও নারিকেল বাগান, রাবার বাগান, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, কুতুবদিয়ার বাতিঘর, রামু উপজেলার নাইংছড়ি লেক অন্যতম। তবে সমুদ্র সৈকতের পরেই কক্সবাজারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এখানকার পরিবেশ এবং আবহাওয়া সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পৃথিবীর এ বিশাল সমুদ্র সৈকত শুধু দেশেই নয় পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত। তাই সবসময় পর্যটকে মুখরিত থাকে এ সৈকত। এ সমুদ্র সৈকতকে যদি পরিকল্পিতভাবে আরো পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলা যায় তাহলে বাংলাদেশ এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য যে, কক্সবাজার জেলার নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর নামানুসারে । কক্সবাজারের পূর্ব নাম ছিল পালংকি। আবার এ অঞ্চল প্যানোয়া নামেও পরিচিত ছিল, যার আক্ষরিক অর্থ হলুদ ফুল। হিরাম কক্স পালংকিতে আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান হাজার হাজার বছরের পুরনো সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেছিলেন এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। শরণার্থী পুনর্বাসনে তার অসামান্য অবদানের জন্য স্থানীয় জনগণের নিকট তার মূল্যায়ন বেড়ে যায় এবং এখানে তার নামানুসারে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বাজারটি তখন কক্স সাহেবের বাজার নামেই পরিচিত হতে থাকে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর কক্সবাজার থানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৪ সালে। ১৮৬৯ সালে কক্সবাজার পৌরসভা গঠিত হয়। পরবর্তীতে এটাকে জেলায় রূপান্তর করা হয়।
অনিন্দ্য সুন্দর কক্সবাজারের মূল আকর্ষণ হচ্ছে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, সারি সারি ঝাউবন, সৈকতে আছড়ে পড়া বিশাল ঢেউ, সকালবেলা জলরাশি ভেদ করে রক্তবর্ণ থালার মত সূর্যোদয় প্রভৃতি সৌন্দর্য্যরে পসরা মানুষের মনকে সহজেই বিমোহিত করে দেয়। এখানকার সমুদ্রের পানিতে ¯œান, সূর্যাস্তের মনোহারা দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়। এছাড়া এ সৈকতের অন্যতম আকর্ষণ বিলুপ্তপ্রায় লাল কাঁকড়া এবং কাছিম। এসব উপাদান কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে পৃথিবীতে অনন্য করে তুলেছে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই এখন পর্যটন শিল্পকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশগুলো পর্যটন খাত হতে আয় করছে বিশাল অঙ্কের অর্থ। ভারত পর্যটকদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশেও পর্যটন শিল্প বিকাশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকুল। তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ পাশ্ববর্তী দেশগুলোর মত পর্যটন খাতকে সর্বোচ্চ আগ্রাধিকার দেয়া। বিশেষত কক্সবাজারকে ঘিরে বিশেষ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন অতি জরুরী।
তবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কতকগুলো সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল অবকাঠামোগত দুর্বলতা, যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার বেহাল দশা, পর্যটকদের নিরাপত্তার অভাব, পর্যটন স্থানগুলোতে উন্নতমানের হোটেল, মোটেল এবং রেস্টুরেন্টের অভাব, পর্যাপ্ত পর্যটক গাইডের অভাব ইত্যাদি। আবার সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। একের পর এক হরতাল, অবরোধে বহিঃর্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা ইতোমধ্যে তাদের দেশের জনগণকে অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া বাংলাদেশে ভ্রমণ না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য পরোক্ষভাবে অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ। তাই অন্তত রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে পর্যটকরা যেন বাংলাদেশের প্রতি বিরক্ত না হন সে দিকটি আমাদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিৎ।
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অন্তরায় থাকলেও এর মধ্যে দিয়েই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। বিশেষত কক্সবাজারকে ঘিরে আমাদের বিশেষ কিছু পরিকল্পনা দরকার। ১. আমাদের দেশের পর্যটন শিল্প প্রচারের অভাবে বহির্বিশ্বে তেমন প্রসার লাভ করতে পারেনি। কক্সবাজার বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত এ বিষয়টি পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তিদের নিকট যেভাবেই হোক পৌছাতে হবে। অর্থাৎ প্রচারণা বাড়াতে হবে। ২. কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ঠ উন্নয়ন সাধন করতে হবে। বিশেষত কক্সবাজারে যেতে পর্যটকদের যাতে কোন সমস্যায় পতিত হতে না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ৩. কক্সবাজারকে স্বয়ংসম্পূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অবশ্যই সেখাকার বিমান বন্দরটিকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। ৪. কক্সবাজারে গিয়ে পর্যটকদের যাতে নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় ভুগতে না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কয়েকমাস আগে কক্সবাজারে লাগাতার হরতাল চললে সেখানে পর্যটকদের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া, অনেকসময় সেখানে চুরি, ছিনতাই এবং ডাকাতির মত ঘটনাও ঘটে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এটা নির্মূলে ব্যবস্থা নিতে হবে। ৫. কক্সবাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নতমানের পর্যটন মোটেল ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করতে হবে এবং পর্যটক গাইডের ব্যবস্থা করতে হবে। ৬. পর্যটননগরী কক্সবাজারকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়ে একে আরো ঢেলে সাজাতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এসব নিশ্চিত করা সম্ভব হলে কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে।
কক্সবাজারের অর্থনৈতিক গুরুত্ব শুধু পর্যটনগত দিক থেকেই নয়, বরং এই সমুদ্র সৈকতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদও রয়েছে। কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতে প্রায় ২ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ৯৮ টন খনিজ পদার্থ অপরিশোধিত অবস্থায় আছে। ইলমেনাইট, রুটাইল, ম্যাগনেটাইল, জিরকন, কায়ানাইট, গারনেট, ম্যাগনেট্রাস্ট, মোনাজাইট, লিউকপ্রিনসহ সমুদ্র সৈকতের বালুতে প্রাপ্ত খনিজ সম্পদগুলো দেশ বিদেশের বহু শিল্প কারখানায় ব্যবহারের জন্য বিপুল চাহিদা রয়েছে। বাদামি রঙের মোনাজাইট অতি মূল্যবান পদার্থ। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ পারমানবিক বোমা তৈরিতে এবং পারমানবিক চুল্লীতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ১৭টি মূল্যবান ভারী খনিজসম্পদের স্তূপ আছে। এর মধ্যে আটটি অতি মূল্যবান খনিজ সম্পদ।
উপকূলের বদরমোকাম, সাবরাং, টেকনাফ ও সিটখালিতে মোট ইলমেনাইট আছে ৪ লাখ ৫০ হাজার ৯৪৪ টন, গারনেট আছে ৬৪ হাজার ৮৬৪ টন, জিরকন আছে ৭০ হাজার ৭২২ টন, রুটাইল আছে ১৮ হাজার ৬৬৪ টন, ম্যাগনেটাইল ২১ হাজার ৫৬৯ টন, লিউকপ্রিন ৫১ হাজার ৮৩৬ টন, কায়ানাইট ১৯ হাজার ৮৬২ টন, মোনাজাইট ১২ হাজার ১০১ টন। সৈকতে কাঁচা বালু আছে দুই কোটি পাঁচ লাখ টন। ভারী খনিজ পদার্থ আছে ৪৩ লাখ টন। গবেষকদের মতে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ উপকূলীয় এলাকায় খনিজ পদার্থের মোট ১৭টি পয়েন্ট আছে। এগুলো হচ্ছে- টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, বদরমোকাম, সাবরাং, ইনানী, কলাতলী, শীলখালী, কুতোবজোম, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, ফকিরাহাটসহ আরো কয়েকটি পয়েন্ট। প্রত্যেকটি পয়েন্ট থেকেই স্বতন্ত্রভাবে খনিজ পদার্থ উত্তোলন সম্ভম।
এসব খনিজ পদার্থ যদি যথাযথভাবে উত্তোলন করা সম্ভব হয় তাহলে বাংলাদেশ অনেক লাভবান হবে। ধারনা করা হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার শুধুমাত্র খনিজ বালু উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু সঠিক সমীক্ষা এবং পরিকল্পনার অভাবে আমরা এসব সম্পদ আহরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। তাছাড়া আমাদের অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সীমাবদ্ধতাও আছে। অবশ্য বিভিন্ন দেশ এসব সম্পদ উত্তোলনে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তাদের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা নিয়ে আমাদের এসব সম্পদ উত্তোলনে তৎপর হওয়া উচিৎ। কেননা এই মহামূল্যবান সম্পদ সংরক্ষণ বা আহরণের অভাবে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব সম্পদ উঠানো সম্ভব হলে একদিকে যেমন দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব, তেমনি অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন সম্ভব।
এছাড়াও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক বাগদা পোনা সংগ্রহ করা হয়। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রায় ৫৭টি বাগদা হ্যাচারি আছে। এসব হ্যাচারির মাধ্যমে বাগদা পোনার চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এখানে জেলে সম্প্রদায় সমুদ্রের উপকূলের কাছাকাছি মাছ আহরণ কাজে ব্যস্ত হয় বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পরপর। সমুদ্র শান্ত থাকার ফলে শীতকালে অসংখ্য নৌকা মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকে। এ মাছধরা পেশার ওপর অসংখ্য জেলেদের জীবণ-জীবিকা নির্ভরশীল।
একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত বিকাশমান একটি শিল্প হল পর্যটন। পর্যটন শিল্প তার বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক দেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত হয়েছে। পর্যটনের ক্ষেত্রে কক্সবাজার বাংলাদেশের জন্য একটি অপার সম্ভাবনাময়ী এলাকা। পর্যটন এবং খনিজ উভয় সম্পদে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলটি বাংলাদেশের ভাগ্য পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তাই এ অপার সম্ভাবনাময়ী এলাকাকে আমাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে যে অন্তরায়গুলো রয়েছে তা চিহ্নিত করে নিরসনকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন