ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ - ৩
লিখেছেন লিখেছেন মেরিনার ১৭ নভেম্বর, ২০১৭, ০৮:১৬:০৮ রাত
[এর আগের পর্বটি রয়েছে এখানে Click this link ]
২)নিজের এবং আল্লাহর মাঝে কাউকে মধ্যস্থতাকারী জ্ঞান করা।
আমাদের তালিকার পরবর্তী ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়টি হচ্ছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চেয়ে কাউকে মধ্যস্থতাকারী বা agency জ্ঞান করা। এই প্রবণতা থেকেই আমাদের দেশে পীর-ফকিরের রমরমা ব্যবসা – বলা যায় জান্নাতের গেট-পাস বা টিকেটের ব্যবসা। যুক্তিও আছে চমৎকার। গ্রাম বাংলায় শীতকালের মৌসুমী ওয়াজে বলতে শুনবেন যে, কোন সাধারণ মানুষ যদি কোন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়, সে কি সরাসরি তার অফিস কক্ষে যেতে পারে? পারে না! তাকে সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির একান্ত সচিব/সেক্রেটারীর কাছে প্রথমে গিয়ে ধরনা দিতে হয়। তিনি যদি সাক্ষাৎপ্রার্থীর উপর রাজী/খুশী/প্রসন্ন হন, তবে তিনি সাক্ষাৎপ্রার্থীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন – আর তিনি যদি রুষ্ট হন তবে, সাক্ষাৎকারীর আর সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যাক্তিটির কাছে পৌঁছানো হয় না। প্রথম শুনলে যে কারো যুক্তিটিকে খুব মোক্ষম মনে হয়: সত্যিই তো অনন্ত, অসীম আল্লাহ্ কত মহান সত্ত্বা; আমাদের মত সাধরণেরা কি করে তাঁর কাছে সরাসরি যেতে পারে? সুতরাং “উসীলাহ্” বা মধ্যস্থাকারী ধরতে হবে। এই সারর্মমের fallacious যুক্তিই (fallacy কোথায় তা আমরা একটু পরে দেখবো ইনশা’আল্লাহ্) হচ্ছে আবহমানকাল থেকে মূর্তিপূজা, কবরপূজা, ব্যক্তিপূজা ও পীরপূজার একটা উৎস – বলা যায় শিরকের সূতিকাগার। এভাবেই ইসলাম পূর্ব আরব দেশে লাত, মানাত বা উজ্জার সৃষ্টি হয়েছিল – আল্লাহকে তাঁর কাজে সাহায্য করা petty gods বা demi gods(নাউযুবিল্লাহ্) ।
উপরন্তু, এই যুক্তির মাধ্যমে শিরকে লিপ্ত হবার আর একটা বাস্তব পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় – এর মাধ্যমে deification of humans এবং humanization the deity বাস্তবায়িত হয়। কোন কোন মানুষ আল্লাহর agent, এই ভেবে সেসব মানুষকে আল্লাহর কাছাকাছি – সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন ও উৎকৃষ্ট একটা সত্ত্বা ভেবে, deification of humans-এর সূত্রপাত হয়। তারপর একসময় দেখবেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে “বিশেষ ব্যক্তি” মনে করে, একদম আক্ষরিক অর্থেই সেজদা করছে (নীচে সংযুক্ত ভিডিও দেখুন! নাউযুবিল্লাহ্!!)। অপরদিকে আল্লাহকে মানুষের মত যখন মনে করা হয় - একজন মানুষের দৃষ্টি, জ্ঞান, বোধ, সময়, ব্যাপ্তি ইত্যদির সীমাবদ্ধতা যখন আল্লাহর বেলায় আরোপ করা হয়, তখন শিরকের অপর প্রক্রিয়া অর্থাৎ humanization the deity –এর প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন হয়। উপরে এই মাত্র আমরা যে কল্পনিক দৃশ্যের অবতারণা করলাম সেখানে যে যুক্তিটা উপস্থাপন করা হয় তাতে কি বলা হচ্ছে? এখানে প্রকারান্তরে বলা হচ্ছে যে, একজন প্রধানমন্ত্রী/প্রেসিডেন্ট যেমন সাধরণের মাঝে নিরাপদ নন, তাদের নিরাপত্তার জন্য যেমন নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে তেমন আল্লাহরও নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে, আল্লাহও সাধারণের সাথে সাক্ষতের জন্য নন; একজন প্রধানমন্ত্রী/প্রেসিডেন্ট যেমন জানেন না দর্শনার্থীর মনে কি রয়েছে, লোকটি ভালো না দুষ্ট, সে কি চায় তেমনি অবস্থা আল্লাহরও তা জানা নেই(নাউযুবিল্লাহ্) – আর তাই একজন মধ্যস্থতাকারীর দরকার যে certify করবে যে, দর্শনার্থী দর্শন লাভের উপযোগী। এভাবেই বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহকে মানুষের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসে, মানুষের মত ভেবে তাঁর ছবি পর্যন্ত আঁকা হয় (সংযুক্তি: মাইকেল এঞ্জেলোর বিখ্যাত সেই ছবি যেখানে ঈশ্বরকে একজন উস্কো খু্স্কো চুলোর সাদা দাড়ি প্রৌঢ় হিসেবে দেখানো হয়) – ধর্মতত্ত্বে ব্যাপারটাকে anthropomorphism বলা হয়। একবার যখন ব্যাপারটা ঘটে, তখন মানুষের সকল অপূর্ণতা ঈশ্বরের উপর আরোপ করা হয় – এমন কি মানুষ মনগড়া গাল-গপ্পের সাথে সাথে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার স্ত্রী সন্তানও আবিষ্কার করে (আবারো নাউযুবিল্লাহ) – এভাবেই ইসলামপূর্ব আরবদের মাঝে লাত, মানাত ও উজ্জার উদ্ভব ঘটেছিল। অথচ, আমরা গত পর্বেই শিখলাম যে, তৌহীদ শিক্ষার শুরুতেই রয়েছে: আর কিছুই আল্লাহর মত নয় – আল্লাহ্ও আর কিছুর মত নন! – এই আত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুভব ও মূলনীতি। তাছাড়া ইসলামী বিশ্বাস মতে আমরা জানি যে, আল্লাহ্ space-timeএর variable নন, বরং space-time আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন – ব্যস, সেগুলো অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে! সৃষ্টির ৫০,০০০ আগেই তিনি সংরক্ষিত ফলকে লিখিয়ে রেখেছেন, আমি আজ আপনাদের জন্য ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়গুলো লিখবো।
এবার আসুন উপরে আমি মধ্যস্থতাকারীর ব্যাপারটা fallacious কেন বলেছিলাম সেই প্রসঙ্গে। কুর’আনের ৩৪নং সূরার এক জায়গায় আল্লাহ্ বলেন:
“Say: ‘Call upon those whom you assert (to be associate gods) besides Allâh, they possess not even the weight of an atom (or a small ant), either in the heavens or on the earth, nor have they any share in either, nor there is for Him any supporter from among them’. Intercession with Him profits not, except for him whom He permits.......” (Qur’an, 34:22-23)
“বল: ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ মনে করতে তাদেরকে আহবান কর। তারা আসমানসমূহ ও যমীনের মধ্যে পরমাণু পরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়। আর এ দু’য়ের মধ্যে তাদের কোন অংশীদারিত্ব নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সাহায্যকারীও নয়।‘ আর আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন সে ছাড়া তাঁর কাছে কোন সুপারিশ কারো উপকার করবে না। .....” (কুর’আন, ৩৪:২৩-২৩)
এই আয়াতগুলোর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বিখ্যাত সিরিয়ান স্কলার হাফিজ ইবনুল কায়্যিম(১২৯২ – ১৩৫০ ইংরেজী) বলেন: এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ শিরকের পক্ষ অবলম্বনকারীদের সকল যুক্তির শিকড় কেটে দিয়েছেন।
আমরা একটু দেখি আল্লাহর কথাগুলোর নিহিতার্থ কেমন! একটা উদাহরণ নেয়া যাক: ধরুন আপনি সিলেট থেকে ঢাকা এসেছেন আপনার প্রাইভেট কার নিয়ে এবং এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন; কিন্তু ঐ বাসায় গাড়ী রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় আপনি জানলেন যে, আপনার আত্মীয়ের বাসার পাশের বাসার একটা গ্যারেজ খালি পড়ে আছে। আপনি কি করবেন? প্রথমে খোঁজ নেবেন ঐ বাসার মালিক কে – কারণ তাকে পেলে এবং তিনি অনুমতি দিলে আপনার আর কোন ভাবনা নেই! আপনি অনায়াসে ঐ গ্যারেজটা আপনার অবস্থানের ২ রাত্রির জন্য ব্যবহার করতে পারেন। খোঁজ নিতে গিয়ে জানলেন যে, ঐ বাসার মালিক একজন নয় বরং ২ ভাই। আপনি তখন ভাবতে পারেন যে, ভাই দুইজনের একজনকে পেলেই আপনার কাজে হয়ে যাবে, কারণ তারা দু’জনেই ঐ বাড়ীর মালিক/অংশীদার। এমতাবস্থায় আপনি জানলেন যে, মালিক ২ ভাইই দেশের বাইরে, কিন্তু তাদের বাসার একজন কেয়ারটেকার আছে। আপনি ভাবতে পারেন যে, ঐ কেয়ারটেকার গ্যারেজের মালিক না হলেও, মালিকদের সাহায্যকারী ব্যক্তি – সুতরাং তিনি চাইলেও আপনার কাজটা হতে পারে। তার কাছে কথা পাড়লে তিনি নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব না নিয়ে বললেন যে, পাড়ার ওমুক সাহেব বাড়ির মালিকদের ঘনিষ্টজন। তিনি যদি ফোনে বাড়ির মালিককে একটু সুপারিশ করেন, তবে হয়তো তারা রাজি হবেন – আর তারা যদি তাকে কেবল একটা ফোন করেও বলে দেন, তবে তিনি আপনার জন্য গ্যারেজখানা খুলে দেবেন!
উপরের উদাহরণে আমরা ৩৪:২২-২৩ আয়াতে আল্লাহ্ যে চার শ্রেণীর মর্যাদার অধিকারীর কথা বলেছেন – তা আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি। আল্লাহ্ বলছেন এই মহাবিশ্বের বস্তু বা কর্মকান্ডের ব্যাপারে আল্লাহ্ ছাড়া প্রথম তিন শ্রেনীর মর্যাদাসম্পন্ন আর কেউ নেই – অর্থাৎ ১) এই মহাবিশ্বের একটা পরমাণুর মালিকও কেউ নন ২) অংশীদারও কেউ নন ৩) কোন কাজে বা কর্মকান্ডে আল্লাহর সহায়তাকারী বা সাহয্যকারীও কোউ নন। তারপর চতুর্থ শ্রেণীর অর্থাৎ সুপারিশকারীর কথা বলতে গিয়ে বলছেন – আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারবেন না বা কারো সুপারিশ কোন কাজে আসবে না! আমরা আয়াতুল কুরসি (২:২৫৫) থেকেও এই কথাটা জানি। তাহলে আমরা আর কারো আরাধনা করে বা তোয়াজ করে কি লাভ – আমরা তো কিছুই পাবো না বরং চির জাহান্নামী হবার সম্ভাবনার সম্মুখীন হবো!
আমরা জানি হাশরের দিন রাসুল(সা.) এবং আরো অনেকে, আমাদের কারো কারো জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন ইনশা’আল্লাহ্। কিন্তু ঐ সুপারিশের দুইটি পূর্বশর্ত আছে: ক) যিনি সুপারিশ করবেন তাকে আল্লাহর অনুমতি লাভ করতে হবে খ) যার ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে, তার ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি লাগবে। তাহলেই বুঝুন, যে ভন্ড আপনার কাছে বেহেশতের টিকিট বিক্রী করছে, সে পৃথবীতে আপনাকে প্রতারিত করে তো আপনার ধন/সম্পদ/আনুগত্য ইত্যাদি হাসিল করছেই। উপরন্তু ঈমান বিনষ্টকারী একটা কাজে আপনাকে যুক্ত করে আপনার আখেরাতও নষ্ট করছে। আজকের পর্বের জন্য আমাদের কথা প্রায় শেষ। সবশেষে একটা আয়ত দেখবো আমরা:
“আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে।“ (কুর’আন, ২:১৮৬)
আমরা একদিনে শুধু ফরজ নামাজেই আল্লাহর কাছে ১৭ বার প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের সরলপথে পরিচালিত করেন। জানেন তো সরলপথ বা straight line হচ্ছে shortest distance between two points। সুতরাং আর কোন মাধ্যম ঘুরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
মানুষ মানুষকে সেজদা করছে....
মাইকেল এঞ্জেলোর সেই বিখ্যাত ছবি!
বিষয়: বিবিধ
৮৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন