বই পরিচিতি / বুক রিভিউ-“সাম্রাজ্যবাদ- ধনতন্ত্র, কমিউনিজম ও ইসলামের নিরিখে ব্যতিক্রমী পর্যালোচনা”
লিখেছেন লিখেছেন রামির ০৮ জুন, ২০১৪, ০১:৪৮:৫০ রাত
কনসেপ্ট বা ধারণা হিসাবে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটিকে আজ আর নতুন করে পরিচিত করার প্রয়োজন নেই। আধুনিক ‘জাতি-রাষ্ট্র’ ধারণার উৎপত্তি ও টিকে থাকার মূলে কাজ করছে এই সাম্রাজ্যবাদি মূলনীতি, চেতনা এবং কৌশল । চেতনা ও কর্মকৌশল হিসাবে সাম্রাজ্যবাদ অনেক পুরানো হলেও বর্তমান ধারার যে সাম্রাজ্যবাদ তার জন্ম সতের শতকের প্রথম দিকে যা উপনিবেশিকতার রুপ ধরে বিকাশ লাভ করে উনিশ শতকের প্রথম দিকে ।
তবে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার পথ পরিক্রমায় ‘সাম্রাজ্যবাদ’ চেতনাও অতিক্রম করেছে বিবর্তন প্রক্রিয়া। আর এ বিবর্তনের ধারায় এর ধারণাগত ও দ্যোতনাগত পরিবর্তনও হয়েছে। লুইস স্যামুয়েল ফুয়েরার মতে, সাম্রাজ্যবাদের দুটো সাবটাইপস হচ্ছে- রিগ্রেসিভ- যা অনেকটা কলোনিয়ালিজম ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দখল দারিত্ব এবং প্রগ্রেসিভ। হালের যে সর্বব্যাপি সাম্রাজবাদী কর্মকৌশল ও কর্মপরিধি তা হচ্ছে প্রগ্রেসিভ সাম্রাজ্যবাদের নমুনা ।
প্রগ্রেসিভ সাম্রাজ্যবাদের প্রধান নমুনা হচ্ছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব দিক দিয়েই অন্য রাষ্ট্র বা দেশের উপর শক্তিশালী দেশের প্রভুত্ব বজায় রাখা। উনবিংশ বা বিংশ সতকে সাম্রাজ্যবাদ বলতে কেবল অর্থনৈতিক শোষণ কিংবা হেজিমনিকেই বুঝানো হতো। বর্তমানে এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদ এখন আর কেবল তার অর্থনৈতিক শাসন-শোষণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তা পরিণত হয়েছে এক সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে। ফলে দেশে দেশে মানূষের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি আজ হুমকীর সম্মুখীন।
বিশেষ করে ধর্ম হিসাবে ইসলামের ভেতর সাম্রাজ্যবাদ কে মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ঠ শক্তিশালী উপাদান বিদ্যমান থাকায় বিশ্বব্যাপি মুসলিম দেশ, জনপদ ও জনগোষ্ঠী আজ সেকিউলার উদ্ভুত ও চালিত সাম্রাজ্যবাদের প্রধান শিকারে পরিণত হয়েছে। আর এ বিষয়টি প্রথম একাডেমিক ভাবে জনসম্মখে হাজির করেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্শিটির প্রফেসর এডওয়ার্ড সাঈদ তার বিখ্যাত বই- “Orientalism” -এ যা প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। ইউরো-এ্যামেরিকান সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের উপর তার সাম্রাজ্যবাদী কলা-কৌশল চাপিয়ে দিচ্ছে তা এখানে তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। ওরিয়েন্টালিজমে যে সাম্রাজ্যবাদের কলা-কৌশল তুলে ধরেছেন তা আরো প্রকটরুপে প্রকাশ করেছেন ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তার Culture and Imperialism বই-এ।
সাম্রাজ্যাবাদের রয়েছে নানান কলা-কৌশল এবং এ সকল কলাকৌশল বাস্তবায়নের জন্য সাম্রাজ্যাবাদি বিশ্ব ছলে-বলে-কৌশলে ব্যয় করে চলেছে কাড়ি কাড়ি ডলার। যদিও শাসন-শোষণের এই কলা-কৌশল মানবতা কিংবা মানব জাতির জন্য কল্যাণ নয় বরং অকল্যাণই বয়ে আনছে তবুও মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির স্বার্থে এসব তথাকথিত উন্নত বিশ্ব তা বাস্তবায়নের নানান ছল চাতুরি করেই চলেছে।
অতি সম্পতি সাম্রাজ্যবাদী এসব কলা-কৌশলের নানান গোপন কর্মসূচী উইকিলিক্সের মতোই প্রকাশ করে দিয়েছেন জন পার্কিন্স তার “Confessions of an economic Hit man” এবং “The secret history of the American Empire”-এ। জন পার্কিন্স ছিলেন এক সময় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল, পুঁজিপতিদের শোষণের হাতিয়ার- আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি এসব কুকীর্তি প্রকাশ করেন এবং আমেরিকার পরবর্তী জেনারেশনের জন্য সাম্রাজ্যবাদের কলা-কৌশল মুক্ত এক মানবতাবাদী সভ্যতার ধারক-বাহক হিসাবে আমেরিকাকে গড়ে তোলার এক আহবান জানান।
বিশ্বব্যাপি এই সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে হাজার হাজার কলাম ও পুস্তক-পুস্তিকা। এ সব পুস্তকে নানান ভাবে তুলে ধরা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের শোষণের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক সমূহ। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত “Imperialism, the Highest Stage of Capitalism” পুস্তকে লেলিন প্রথম বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদি সভ্যতা বিকাশলাভের সর্বোচ্চ স্তর। আর এর পরই বিশ্বব্যাপি পুজিবাদের হাতিয়ার হিসাবে সাম্রাজ্যবাদ কে ব্যাখ্যা করে শত শত পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশেও প্রকাশিত হয়েছে শত শত কলাম ও বই। সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে অনেক বই থাকলেও বিশিষ্ট দার্শনিক, কলামিষ্ট ও কবি ফরহাদ মাঝহার এবং বিশিষ্ট (পুঁজিবাদী চিন্তাপুষ্ট) অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদের বই দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে এ বই দুটিতেই পুঁজিবাদী সভ্যতার ধারক বাহক এবং অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার হিসাবেই সাম্রাজ্যবাদ কে ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের বাইরে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে প্রথম ব্যাখ্যা করেন এডওয়ার্ড সাইদ তার বই-এ। আর বাংলা ভাষায় সাম্রাজ্যবাদের এই কম্প্রিহেন্সিভ ব্যাখাটি হাজির করেছেন বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও গবেষক ফাহমিদ-উর-রহমান। সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা-চেতনার বিমূর্ত রুপকে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা-ভাষী জন সমাজে মূর্তমান করে যারা তার বিরুদ্ধে জন সচেতনতা গড়ে তুলছেন ফাহমিদ-উর-রহমান তাদের অন্যতম। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যারা বিশ্ব সভ্যতাকে মানব বসবাসের উপযোগী করার কাজে সদা ব্যস্ত- ড. ফাহমিদ তাদের সামনের কাতারে সদা উপস্থিত।
সাম্রাজবাদ বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ২০১২ সালে। সম্প্রতি ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে বইটির ২য় প্রকাশ। সময়ের বিবেচনায় ২য় প্রকাশের সাথে প্রথম প্রকাশের তেমন পার্থক্য না থাকলেও বিষয় ও বিন্যাসে এসেছে অনেক পরিবর্তন। অনেক গুলো বিষয় তিনি ভিন্ন ভাবে নতুন তত্ত্ব ও তথ্য দ্বারা সুবিন্যস্ত করেছেন।
শুধু অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক দিক থেকে নয় বরং বাঙ্গালী মুসলমানের স্বরুপ অন্বেষা থেকে শুরু করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তথা দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী, গণতন্ত্রী, ইসলামপন্থী এবং সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসন বিরোধী শক্তির ঐক্য ভাবনায় তার এ বইটি এ সময় তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বায়িত যে চরিত্র তার পাশাপাশি বাংলাদেশে কিংবা উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের যে লোকাল বা স্থানিক দালালায়িত চেহারা তা তিনি পুংখানুপুংখ ভাবে তুলে এনেছেন। ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ হতে সাম্রাজ্যবাদের যে ব্যাখ্যা, মুসলিম স্কলারদের যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান এবং ধর্মের জায়গা হতে মুসলমানদের যে করণীয় তার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক আলোচনা বইটিকে ইতোপূর্বে প্রকাশিত সকল বই থেকে ব্যতিক্রম করেছে। সূচী ও বিষয়বস্তুর কারণে বইটি সাম্রাজ্যবাদের উপর একটি রেফারেন্স বই এর তালিকায় স্থান পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
সাম্রাজ্যবাদ, ইসলাম ও সাম্রাজ্যবাদ, ইতিহাস ও সাম্রাজ্যবাদ এই শিরোনামে বইটিকে তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। সাম্রজ্যবাদের যে পুরানা চেহারা সেখান থেকে হাল-আমলের যে নতুন কর্ম-কৌশল তার প্রায়ই সবই উঠে এসেছে এবারের প্রকাশে। আল্লামা ইকবাল, চে গুয়েভারা, ভে এস নাইপল, গুন্টার গ্রাস, টনি ব্লেয়ার কিংবা উইকিলিক্স থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের আরব বসন্তের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের যে ভূমিকা তাও ঊঠে এসেছে ফাহমিদ-উর-রহমানের এই বই-এ।
বর্তমান সময়ের যে চায়ের কাপ গরম করা টেবিল টক- যেমন সিভিল সোসাইটি, ইসলামোফোবিয়া, কর্পোরেটজগত কিংবা বাংলার যে অতীত ঐতিহ্য সিরাজ-উদ্দৌলা, ফরায়েজী আন্দোলন, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ অথবা বৈশ্বিক ঘটনাবলী যেমন সানুসী আন্দোলন, ফিলিস্তীনের আরমাগেডন, দেওবন্দের ওলেমা কিংবা হায়দারবাদের ট্রাডেজী সব কিছুই স্থানিত হয়েছে বইটিতে। ফলে বইটির নামকরণ “সাম্রাজ্যবাদ- ধনতন্ত্র, কমিউনিজম, ও ইসলামের নিরিখে ব্যতিক্রমী পর্যালোচনা” যথার্থ হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
তিনশত পৃষ্ঠার বইটির প্রতিটি পাতা তত্ত্ব ও তথ্যবহুল হলেও সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলায় করণীয় কি এবং কি প্রক্রিয়ায় তা করা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ার ধরণ ও তার প্রকারভেদের বিষয়টি আলাদা পরিচ্ছেদ কিংবা আলাদা অধ্যায়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হতে পারত। যা যদি প্রতিটি আলোচনায় প্রকটভাবে না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে পাঠকের করণীয় উঠে এসেছে তবুও আলাদা ভাবে এই আলোচনার অভাব বই পাঠ শেষে পাঠক অনুভব করবে পরতে পরতে। পাঠকের প্রত্যাশার এই বিষয়টিতে লেখক পরবর্তী প্রকাশে মনোযোগ দিবেন- এই আশা করা, বোধ হয়, অতিশয়োক্তি হবেনা।
জাতীয় জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমন বই প্রকাশ করে, নিঃসন্দেহে, বুক মাস্টার প্রকাশনী নিপীড়িত, নির্যাতীত ও শোষিত-বঞ্চিত মানবতার সেবার পাশাপশি এক জাতীয় ভূমিকা পালন করল যা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার।
******************************************************
বিষয়: সাহিত্য
২৬৫৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন