পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নঃ অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে ইসলামি আন্দোলন

লিখেছেন লিখেছেন রামির ১৯ মে, ২০১৪, ০৭:২১:০২ সকাল

(Monitoring & Evaluation: From Economic Development to Islamic Movement)

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই বাংলাদেশে ইসলাম ইন্সপায়ার্ড আন্দোলনের- যা সাধারণ ভাবে আমাদের কাছে ইসলামি আন্দোলন নামে পরিচিত- কাজ শুরু হয় । অন্যান্য অনেক ইসলামি আন্দোলনের মধ্যে রাজনৈতিক সংযুক্তির কারণে জামায়াতে ইসলামি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য ধারার জন্ম দেয়। সে থেকে আজ অবধি জামায়াতে ইসলামি ভারতীয় উপমহাদেশের- প্রধানত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের- রাজনীতিতে এক অনিবার্য বাস্তবতা। জামায়াত যেহেতু একটি আদর্শবাদি দল তাই ইসলামপন্থী মুসলমানের নিকট জামায়াতের একটি আবেদন রয়েছে যা উপেক্ষা করার নয়। আবার, জামায়াত যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে তার যাত্রা শুরু করেছিল, সে লক্ষ্য অর্জন কতটুকু করতে পেরেছে বা পারেনি সে বিষয়টি আজও অনির্ণেয়। জামায়াতের বর্তমান অবদান কিংবা ভবিষ্যত লক্ষ্য-মাত্রা অর্জনের নিমিত্ত তাই প্রয়োজন সঠিক পরিবীক্ষন ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার (Monitoring & Evaluation)।

জীবন-ব্যবস্থা হিসাবে, মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ইসলাম সার্বজনীন হলেও ইসলাম-উৎসারিত কোন আন্দোলনের গৃহীত কর্ম-কৌশল কিন্তু সার্বজনীন নয়। কারণ আন্দোলনগুলো সাধারণত গড়ে উঠে কোন যুগের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে এবং কোন যুগস্রষ্টা ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা সম্বলিত নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে। কাজেই যুগ পরিবর্তনের ধারায় এবং ব্যক্তির পরিবর্তনের সাথে এসব আদর্শ উৎসারিত আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি – কর্মকৌশল ও অর্জিত ফলাফল সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা দরকার এবং সময়োচিত সঠিক কর্মপদ্ধতি – কর্মকৌশল গ্রহণ করা দরকার। তাই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, কোন বিপ্লব-আন্দোলনই দীর্ঘমেয়াদে প্রাসঙ্গিক হয় না এবং সময়ের সাথে অনেক আন্দোলনই সময়ের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যায়। ইসলামি আন্দোলন হিসাবে বাংলাদেশে জামায়াত- শিবির-ছাত্রী সংস্থাও এক দীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে; তাই আজ এর আশু মুল্যায়ন প্রয়োজন।

বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র-কাঠামোয় উন্নয়ন অর্থনীতি (Development Economics) একটি নতুন সংযোজন। ১৯৩০ এর মহামন্দা ও সমাজবাদের উত্থান ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের লেজে-ফেয়ার ভিত্তিক ক্যাপিটালিস্টিক অর্থনীতির ভিত্তিকে ধ্বসিয়ে দেয় যার ফলে কেইনিসিয়ান বিপ্লব এবং কল্যাণমূলক (Welfare) রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক অন্যতম উপস্বর্গ হচ্ছে জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন। আর জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের সাথে জড়িত আছে পরিকল্পিত উন্নয়নের ধারণা যাকে কেন্দ্র করেই উদ্ভব হয়েছে উন্নয়ন অর্থনীতির (Development Economics)।

উন্নয়ন অর্থনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে- সমাজ বা রাষ্ট্র কাঠামোয় বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সে পরিকল্পনাকে কতগুলো ধাপ-ভিত্তিক পর্যায়ে বিভক্ত করে ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কিছু পর্যায়ক্রমিক ধাপ হচ্ছে- গোলস, অবজেকটিভস, আউটপুট এবং ইনপুট। কোন সমস্যা সমাধানের জন্য পরিকল্পনার প্রথমেই গোল নির্ধারণ করা হয় এবং তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যাতে সুচারুভাবে সম্পন্ন হয় সে জন্য গ্রহণ করা হয়-পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া (Monitoring and Evaluation)।

পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন হচ্ছে আধুনিক প্রজেক্ট ম্যাঞ্জমেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি টুলস, যা গৃহীত পরিকল্পনা/প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য ইতোপূর্বে পরিকল্পিত ধারাবাহিক পর্যায়গুলোর এক্সিকিউশন নিশ্চিত করে। পরিবীক্ষণ বা মনিটরিং প্রক্রিয়া সাধারণত দুই ধরনের- একটি ধাপ নির্ভর (Implementation of the different steps based) এবং অন্যটি রেজাল্ট নির্ভর (Results based)। প্রথমটিতে লক্ষ্য রাখা হয় যাতে, প্রকল্পটিতে যে সকল অংগ যেভাবে ব্যবহারের কথা ছিল তা ব্যবহৃত হয়েছে কিনা এবং তা নির্দিষ্ট টাইম-ফ্রেমে শেষ হয়েছে কিনা। অন্যদিকে রেজাল্ট নির্ভর মনিটরিং নিশ্চিত করে যে, যে উদ্দেশ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা। কারণ নির্দিষ্ট অংগ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট টাইম-ফ্রেমে কাজ শেষ করলেই হবে না, প্রকল্প কে অবশ্যই তার ইপ্সিত ফলাফল প্রদান করতে হবে।

মনিটরিং এর সাথে ইভ্যালুয়েশন বা মূল্যায়নের একটু পার্থক্য রয়েছে। মূল্যায়ন ও মূলত দুই প্রকার- ফরমেটিভ এবং সামেইটিভ। সামেইটিভ মূল্যায়নের রয়েছে কয়েকটি ভাগ- গোল-বেজড মুল্যায়ন, ইম্প্যাক্ট-বেজড মুল্যায়ন এবং আউটকাম-বেজড মূল্যায়ন। ফরমেটিভ মূল্যায়ন সাধারণত প্রকল্প চলাকালীন সময়ে করা হয় (প্রকল্প চলাকালীন করা মনিটরিং এর সাথে এর পার্থক্য রয়েছে)। অন্যদিকে সামিটিভ মূল্যায়ন করা হয় পরিকল্পনা বাস্তাবয়নের পর।

মনিটরিং শুধুমাত্র প্রকল্প প্রস্তাব সঠিক ভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করে কিন্তু মূল্যায়ন এই কাজটির পাশাপাশি প্রকল্পটি যে উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল তা সঠিক ছিল কিনা এবং এবং সমাজ বা রাষ্ট্র- কাঠামোয় বিদ্যমান সমস্যা সমাধান কিংবা বিদ্যমান অবস্থার উন্নয়নের জন্য যা দরকার তার সাথে গৃহীত পরিকল্পনা প্রাসঙ্গিক ছিল কিনা সেটিও বিবেচনায় আনতে পারে। কোন প্রকল্প মূল্যায়নে এ বিষয়টিও লক্ষ্য করা হয় যে, যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল, যে স্ট্রাটেজী অবলম্বন করা হয়েছিল একই টাইম-ফ্রেমে একই শর্তে আরো বেটার কোন প্রকল্পের মাধ্যমে তা পূরণ করা সম্ভব ছিল কিনা এবং ভবিষ্যতে আরো বেটার কোন আল্টারনেটিভ আবিস্কার/ ব্যবহার করা যায় কিনা।

মূল্যায়নের বিশেষ গুরুত্ব হচ্ছে এই যে, দীর্ঘমেয়াদে যে মাস্টার প্ল্যান করা হয় তার ভুল-ত্রুটি এতে ধরা পড়ে এবং ভবিষ্যতে এ জাতীয় ভুলের সম্ভাবনা রোধ করে, যা মনিটরিং এর মাধ্যমে সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামি আন্দোলন/ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াত তার যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৪১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে। জামায়াতের জন্মের সাথে তৎকালীন বিশ্বের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা- যা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী কে প্রভাবিত করেছিল – হলো ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের করূণ অবস্থা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশদের দুরাবস্থা এবং বিশ্বব্যাপি সমাজতন্ত্রের উত্থান। বিশেষ করে তৎকালীন ভারতে ধর্মহীন গণতান্ত্রিক জাতিয় রাষ্ট্র (Secular Democratic National State) কায়েমের উদ্দেশ্যে গান্ধীজীর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠন, সমগ্র ভারত-বাসীকে এক জাতি আখ্যা দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক কাতারে শামিল করার যে চেষ্টা, এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদের জাতীয়তাবাদী চিন্তায় উৎসারিত মুসলিম লীগ গঠন ইত্যাকার ঘটনাবলী মাওলানা মওদুদীকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছিল বলে তিনি ‘ইসলামি আন্দোলনের ভবিষ্যত কর্মসূচী’ বইয়ের জামায়াত গড়ে উঠার সময়ে আন্দোলনের ক্রমিক পর্যায়ের দ্বিতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।

মাওলানা মওদুদী, যেহেতু, মনে করতেন যে, বর্তমান যুগে সমাজ জীবন পরিগঠন ও ভাঙ্গার বৃহত্তম শক্তি হচ্ছে সরকার (ইসলামি আন্দোলনঃ সাফল্যের শর্তাবলী) এবং ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে ইসলামি দর্শনের এক অন্যতম উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন (আল জিহাদ ফিল ইসলাম) (কারণ তখনো ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ শব্দটি যে একটি মিসনোমার- রশিদ আব্দুল মতিনের মতে- , মদীনা যে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ ছিলনা কিংবা ইসলামি রাষ্ট্রের পরিবর্তে তারিক রামাদের সিভিল রাষ্ট্রের বিতর্কের উদ্ভব হয় নি কিংবা আব্দুল ওয়াহাব আল আফেন্দীর মত “Who Needs an Islamic State” বই এর লেখকের আবির্ভাব হয় নি)। তাই মাওলানা মওদূদী ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে চরম ও পরমতম লক্ষ্য নির্ধারণ করে জামায়াতের প্রয়োজনীয় কলাকৌশল ও কর্ম-পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জামায়াত তার আন্দোলনের ইতিহাসে এক ভিন্ন মাত্রার পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যা বিশ্বের অন্য কোন দেশের ইসলামি আন্দোলন এর পূর্বে কখনো মোকাবিলা করে নি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির বয়স বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সমান। জামায়াতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আরো সূচারুভাবে বাস্তবায়নের নিমিত্ত জামায়াতের আদর্শ ধারণ করে ১৯৭৭ সালে শিবির এবং ১৯৭৮ সালে ছাত্রী সংস্থা কাজ শুরু করে।

বিগত ৪৩ বছরে জামায়াত, ৩৬ বছরে শিবির এবং ৩৫ বছরে ছাত্রী সংস্থা হাজারো হাজারো পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে । আজ প্রয়োজন গৃহীত ও ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত এবং বাস্তবায়িতব্য এসব পরিকল্পনার/প্রকল্পের রেজাল্ট-বেজড মনিটরিং এবং ইভ্যালুয়েশন।

সাধারণত পরিকল্পনা মনিটরিং করা হয় প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন সময় কিংবা প্রকল্প সমাপ্ত হবার পর । আর ইভ্যালূয়েশন করা হয় গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর (সামেইটিভ) । আবার, মনিটরিং করা হয় বাস্তবায়িতব্য পরিকল্পনার/ প্রকল্পের প্রাপ্ত ফলাফলের কিন্তু ইভ্যালুয়েশন করা হয় প্রিন্সিপুল বা মূলনীতির বা লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের, গৃহীত স্ট্রাটেজীর, কর্ম-পদ্ধতির এবং তা বাস্তবায়ন পদ্ধতির, যা প্রক্রিয়ায় স্ট্রাটেজী, কর্ম-পদ্ধতি- কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল সে পদ্ধতির।

বিগত বছরগুলোতে ইসলাম-পন্থী সংগঠনের অর্জিত ফলাফল এবং যাত্রাকালে এসব সংগঠনের যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, কতটুকু হয় নি, যেটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তার কারণ, যে টুকু বাস্তবায়িত হয় নি তার কারণ অনুসন্ধান আজ জরুরী। এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের যে নির্ধারিত গোল, অবজেকটিভ, টার্গেট ও ইন্ডিকেটর ছিল সেগুলোর স্ট্যাটাস যাচাই করা।

প্রয়োজন নতুন করে আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সামেইটিভ (summative) মূল্যায়ন করার, যাতে আমরা নির্ধারণ করতে পারি আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কতটুকু অর্জিত হয়েছে এবং বাকী অংশের জন্য কি ধরণের পদক্ষেপ নিতে হবে? সামেইটিভ মূল্যায়নের পাশাপাশি আমাদের প্রতিনিয়ত গৃহীত পরিকল্পনার জন্য ফরমেটিভ মূল্যায়নের ব্যবস্থাও থাকা প্রয়োজন।

সঠিক মনিটরিং টুলস ও ইভ্যালুয়েশন প্রতিবেদনের আলোকে নতুন যুগে নতুন ভাবে কার্যকর ও প্রমাণিত স্ট্রাটেজী, কর্ম-পদ্ধতি ও কর্ম-কৌশল গ্রহণের যথার্থতার উপরই নির্ভর করবে এদেশে ইসলামি আন্দোলনের ভবিষ্যত অর্জনাবলীর গতিধারা ।

……………………………………

……………………………………

বিষয়: রাজনীতি

১৫৫৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

223316
১৯ মে ২০১৪ সকাল ১১:৫৪
সন্ধাতারা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
224492
২২ মে ২০১৪ সকাল ০৭:৫৪
রামির লিখেছেন : ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File