বুক রিভিউ: মানবমন মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব (ক্রম-৪)
লিখেছেন লিখেছেন রামির ২৭ অক্টোবর, ২০১৩, ০১:১৪:৪৬ দুপুর
যতীন সরকার লিখিত “সমাজতন্ত্র” বিষয়ক বই- ‘মানবমন মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’। এ বই হতে ১২টি পয়েন্ট নিয়েই সাজানো হয়েছে এবারের বই পরিচিতি পর্ব । পুঁজিবাদের উপর সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ত্বের সার্বজনীন কারণগুলোই মূলত বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে। তবে, পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের পত্তন ও পতনের কারণগুলোও আলোচিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে বহুল চর্চিত ‘নাস্তিকতা’ কে লেখক অস্বীকার করেছেন এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ইসলামসহ সকল ধর্মের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে ব্যাখ্যা করার জন্য বঙ্কিমসহ আল্লামা ইকবালের বিভিন্ন রেফারেন্স পাণ্ডিত্যের সাথে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে আস্তিক প্রমাণের এই চেষ্টা বইটিকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলোচনার যুক্তি বা লজিক নিয়ে বিতর্কের সূযোগ থাকলেও ভাষা বর্ণনা ও যুক্তি প্রয়োগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ও ‘বাংলা একাডেমী’ পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা অর্জনকারী, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর সাবেক সভাপতি, দীর্ঘ চার দশক ব্যাপী ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক এই অধ্যাপক কাম লেখক বেশ মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন । তাঁর এসব আলোচনার মধ্য হতে ১২টি পয়েন্ট এখানে সংক্ষেপে নোটাকারে টুকে রাখা হলো বইটি সম্পর্কে একটি ধারণা পাবার জন্য।
০১. বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দু’নীতি কিংবা একই নীতির দু’স্তর ভিত্তিক বিকাশ হচ্ছেঃ
‘সমাজ কে প্রত্যেকে দেবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী, পাবে তার কাজ অনুযায়ী’- এটি হলো সমাজতন্ত্রের ১ম নীতি; এরপর সমাজতন্ত্র বিকশিত হতে হতে সাম্যবাদে রুপান্তরিত হবে যখন, তখন তার নীতি হবে- ‘সমাজ কে প্রত্যেকে দেবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী, পাবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী’ (পৃষ্ঠা-৩৭)।
০২. কার্ল মার্কস মানুষের খাদ্য গ্রহণের মতো মৌলিক প্রয়োজন সম্পর্কে বলেছিলেনঃ “ক্ষুধা তো সবারই আছে, কিন্তু যে ক্ষুধা মেটে রান্না করা উত্তম মাংস কাঁটা চামচ দিয়ে খেয়ে, তার সঙ্গে নিশ্চয় পার্থক্য আছে সে ক্ষুধার যা মেটানো হতো কাঁচা মাংস হাত দিয়ে ধরে দাঁত আর নখ দিয়ে কেটে কোন রকমে গলাধঃকরণ করা হতো”। খাদ্য গ্রহণ বা ক্ষুধা মেটানোর মতো বস্ত্রের কিংবা বাসস্থানের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রেও এ ধরণের কথা অনায়াসে বলা যায়। গাছের বাকল বা পশুর চামড়াকে বস্ত্ররুপে ব্যবহার করার সঙ্গে আজকের বিচিত্র পরিচ্ছদের সমারোহের, কিংবা গুহায় বা বৃক্ষকোটরে মাথা গুঁজে থাকার সঙ্গে সুরম্য হর্ম্যে বিজ্ঞানের দানস্বরুপ বিপুল আরামআয়েশে বাস করার মধ্যে নিশ্চয় আকাশ পাতাল পার্থক্য… … পেটের ক্ষুধা ও যৌন ক্ষুধার সাথে সমান দাবি নিয়ে এসে যুক্ত হয়েছে জ্ঞানের ক্ষুধা ও সৌন্দয্যের ক্ষুধা। খাদ্যের মতো যৌন সঙ্গী নির্বাচনেও এসেছে রুচিবোধ ও দায়িত্ববোধ; খাদ্য সংগ্রহকর্ম উত্তীর্ণ হয়েছে রন্ধন কলায় ও যৌনতা প্রেমে। প্রধানত পুঁজিবাদের অসীম চাহিদা ও তার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির প্রসংগ আলোচনা করতে গিয়েই লেখক এভাবে তা ব্যক্ত করেছেন।
০৩. মার্কসবাদের অগ্রগতির ইতিহাস কে লেলিন তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। তার যুগ বিভক্তিকে মেনে নিয়েই পরবর্তীতে এ সমাজতন্ত্রের ইতিহাসকে মোট ৫ ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১৮৪৮-১৮৭১ পর্যন্ত ১ম যুগ
১৮৭২-১৯০৪ পর্যন্ত ২য় যুগ
১৯০৫-১৯১৭ পর্যন্ত ৩য় যুগ
১৯১৭-১৯৪৫ পর্যন্ত ৪র্থ যুগ
১৯৪৫- বর্তমান পর্যন্ত ৫ম যুগ
১৮৪৮ এর আগেকার সমাজতন্ত্র ছিল কল্পস্বর্গবাদী। ১৯৪৮ সালে মার্কস-এঙ্গেলস রচিত ‘কমিউনিস্ট এস্তেহার’ প্রকাশের পর কমিউনিস্ট আন্দোলন বৈজ্ঞানিক যুগে প্রবেশ করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে ১৮৭১ সালে ফরাসি দেশে গড়ে উঠা ‘প্যারি কমিঊন’র প্রতিষ্ঠা ও মাত্র তিন মাসের মধ্যেই তার ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদের প্রথম যুগের অবসান ঘটে। একই ভাবে ১৯০৫ এ রুশ বিপ্লবের পরাজয়ে মার্কসবাদের দ্বিতীয় যুগের অবসান ঘটে এবং সূচনা হয় তৃতীয় যুগের। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের সফলতা থেকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ৪র্থ যুগের সূচনা ঘটে। ১৯৪৫ সালে, বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবির পত্তনের পর থেকেই ৫ম যুগের সূত্রপাত (পৃষ্ঠাঃ৯০-৯১)।
০৪. অ্যাঙ্গেলস এর বিখ্যাত উক্তিঃ “A perfect society, a perfect ‘state’ are things which can only exist in imagination. On the contrary, all the successive historical systems are the transitory stages… Each stage is necessary, and is therefore justified for the time and conditions to which it owes its origin… for it (i.e. dialectical philosophy). Nothing is final, absolute, sacred … dialectical philosophy… recognizes that definite stage of knowledge and society is justified for their time and circumstances; but only so far. The conservatism of this mode of outlook is relative; its revolutionary character is absolute- the only absolute, dialectical philosophy admits. (পৃষ্ঠা-১৭০)
বাংলা অনুবাদঃ ‘একটি সর্বৈব নিখুঁত সমাজ, একটি সর্বৈব নিখুঁত রাষ্ট্র, এগুলো কেবল কল্পনাতেই থাকা সম্ভব। প্রকারান্তরে সমস্ত আনুক্রমিক ঐতিহাসিক ব্যবস্থাই উত্তরকালীন প্রবহমান স্তরমাত্র… প্রতিটি স্তরই প্রয়োজনীয়, এবং সেহেতু যে সময়ে ও যে কারণে তার উৎপত্তি সে বিবেচনায় তা যুক্তিসঙ্গত… এতে (অর্থাৎ ডায়ালেক্টিক দর্শনে) কোন কিছুই চূড়ান্ত, পরম, পবিত্র নয়… ডায়ালেক্টিক দর্শন … স্বীকার করে যে, জ্ঞান ও সমাজের নির্দিষ্ট স্তরগুলো তাদের জন্য নির্দিষ্ট সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যুক্তিসঙ্গত; কিন্তু কেবল এতটুকুই মাত্র। এই দৃষ্টিভঙ্গির (ডায়ালেক্টিক দর্শনের) রক্ষণশীলতা একান্তই আপেক্ষিক; এর বিপ্লবী চরিত্রই হলো পরম সত্য- যে পরম সত্যকে ডায়ালেক্টিক দর্শন স্বীকার করে”(পৃষ্ঠা-১৭১)।
০৫. ১৯৯১ সালের আগস্টে খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নেই সমাজতান্ত্রিক পার্টি ক্ষমতাচ্যুত ও নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
০৬. ১৯৫৮ সালে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট তত্ত্ববিদ লেফিলভ তার “Problems Actuals du Marxism” নামে একটি বইয়ে নিম্নোক্ত বক্তব্য তুলে ধরেন যার কারণে তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়ঃ
এক. সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর রাষ্ট্রকাঠামোকে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা দিয়ে এমন শক্তিশালি করা হয়েছে যে, এ ক্ষমতার বাইরে অবস্থিত শ্রমকেরা সেখানে শোষন ও শাসনের স্বীকার।
দুই. সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের নামে কমিঊনিষ্ট পার্টি শাসিত দেশে কঠোর আমলাতন্ত্রের পত্তন ঘটানো হয়েছে।
তিন. ক্ষমতাকেন্দ্রের অতিরিক্ত ক্ষমতা ও হৃদয়হীন আমলাতন্ত্রের ফলে প্রাক-সমাজতন্ত্রী যুগের মতই শ্রমজীবীরা
শ্রম প্রক্রিয়া হতে বিচ্যুত হতে চলেছে। আগের মতোই তারা শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা শোষিত, শাসিত এবং লুন্ঠিত হচ্ছে।
লেফিলভের এই বক্তব্য নিয়ে পার্টিতে বিতর্ক চলতে পারত, চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার সত্যতা ও অসত্যতা উদ্ঘাটন করা যেত, এমনকি তার বক্তব্য পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হলেও তাঁর মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর জন্য পার্টি সংগঠনে অবস্থানের অধিকার নিশ্চিত করাটাই একান্ত সঙ্গত হতো। কিন্তু একশিলা পার্টি ও ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিয়তা’ তত্ত্বের বিকৃত ব্যাখ্যার দরুনই লেফিলভের মত কোন স্বাধীন চিন্তক কে কোন কমিউনিস্ট পার্টি ধারণ করতে পারেনি। কমিউনিস্টদের এ ব্যর্থতা অশুভ ফলই বয়ে এনেছে (পৃষ্ঠা-১৭৫)।
০৭. পুঁজিবাদের শোষন ও পুঁজিবাদীদের অপকর্মের ধরণ বুঝাতে গিয়ে লেখক যিশু খ্রিষ্টের একটি বাক্য কুট করেছেন। বাক্যটি হচ্ছেঃ “একটি সুচের ছিদ্রের ভেতর দিয়ে একটি উটের চলে যাওয়া সম্ভব হলেও ধনী ব্যক্তির স্বর্গলাভ কখনো সম্ভব নয়” (পৃষ্ঠা-১৩১) ।
০৮. সাম্রাজ্যবাদের পোষমানা তাত্ত্বিকরা সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে মানুষকে অপতত্ত্বীয় ধুম্রজালে আটকে ফেলার চেষ্টায় নানান তত্ত্ব নিয়া হাজির হচ্ছে। যেমন-‘শ্রেণী সংগ্রামের’ বিপরীতে ‘সভ্যতার সংঘাত’ (Class of Civilization) নামের বিকৃত তত্ত্ব (পৃষ্ঠা-১৯৫)।
০৯. বিপ্লব যদি কেবল সমাজের বহিরঙ্গেই পরিবর্তন আনে, মানুষের চিন্তায় প্রত্যয়ে আবেগে যদি ঘটাতে না পারে আমূল রুপান্তর, তবে সে বিপ্লবে মানুষের কোনোই প্রয়োজন থাকতে পারেনা। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব মানুষের চৈতন্যে কেমন করে কী রুপান্তর নিয়ে আসে, এবং ভবিষ্যতের কমিউনিস্ট সমাজই-বা রুপান্তরের কী সম্ভাবনা ধারণ করে,- সে সব নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদি মনোবিজ্ঞানী প্লাতানভ (পৃষ্ঠা-৩৩)।
১০. সমাজতন্ত্র হলো পুঁজিবাদের মরণব্যাধি। সে ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুঁজিবাদীরা অনেক আগেই প্রতিষেধক টিকা উদ্ভাবন করে নিয়েছে। পুঁজিবাদের দেহে সমাজতন্ত্রের কিছু বীজ ঢুকিয়ে দেয়াই হচ্ছে সেই প্রতিষেধক টিকা। অবাধ বা মুক্ত অর্থনীতির কিছুটা রাশ টেনে ধরে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ করে পুঁজিবাদের দেহে সমাজতন্ত্রের টিকা তারা আগেও নিয়েছে, এখনো নিচ্ছে (পৃষ্ঠা-১৯৭)। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মোকাবিলায় বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা অনেক ক্ষেত্রে আপোষের প্রক্রিয়া গ্রহণ করেন। ফলে ধ্রুপদী পুঁজিবাদ অনেকটা কল্যাণবাদী রুপ পরিগ্রহ করছে।
১১. মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের দ্ব্যার্থহীন সিদ্ধান্ত হলোঃ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল লক্ষ্য কোন মতেই ধনতন্ত্রী রাষ্ট্রের বদলে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়- রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির উচ্ছেদ করাই তার আসল লক্ষ্য। সে লক্ষ্যটি যে বিভিন্ন দেশের শাসক কমিউনিস্ট পার্টি গুলো বেমালুম ভিলে গিয়েছিল – সে কথা বোধ হয় নির্দ্বিধায় বলা চলে (পৃষ্ঠা-১৭৬) ।
১২ (ক). নামঃ মানবমন মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব
লেখকঃ যতীন সরকার
প্রকাশকঃ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
১ম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০
সর্বশেষ পরিবর্ধিত সংস্করণঃ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
দামঃ ৩০০/= (তিনশত টাকা) (পাওয়া যাবে- ২২০ টাকায়)
পৃষ্ঠাঃ ২০২।
১২ (খ). বইটির সূচীপত্রঃ
অধ্যায় ১- সহজ স্বাভাবিক মানুষ (২৩-২৬)
অধ্যায় ২- মানুষের অনন্ত সম্ভাবনা (২৬-৩০)
অধ্যায় ৩- বিপ্লব, বিকশিত মানুষ ও মনোবিজ্ঞান (৩১-৪৩)
অধ্যায় ৪- মনুষ্যত্ব-বিরোধী ভাবাদর্শ (৪৪-৫২)
অধ্যায় ৫- বিপ্লবের পথের বিভ্রান্তি- উৎক্রান্তি (৫৩-৮৮)
অধ্যায় ৬- সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শক্তিকেন্দ্র (৮৯-১২৩)
অধ্যায় ৭- সাম্যবাদ ও মানুষের ধর্ম (১২৪-১৬৮)
উত্তর কথনঃ (সর্বশেষ সস্করণে যুক্ত)
অধ্যায় ১- মার্কসবাদের খন্ডীভবন ও সমাজতন্ত্রের সংকট (১৬৯-১৮৪)
অধ্যায় ১- চীন ও কিউবা বিপ্লবের প্রতি দৃষ্টিপাতঃ সতর্ক ও সক্রিয় আশাবাদ (১৮৫-২০২)
সমাপ্ত
বিষয়: বিবিধ
১২৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন