বই পরিচিতি-৩ (বুক রিভিউ-৩)
লিখেছেন লিখেছেন রামির ১৫ অক্টোবর, ২০১৩, ০১:০০:৫৫ দুপুর
নামঃ সংগঠন ও বাঙালি
লেখকঃ আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ
প্রকাশকঃ মাওলা ব্রাদার্স
১ম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩
২য় প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
দামঃ ১২৫/= (একশত পঁচিশ টাকা) (পাওয়া যাবে- ১০০টাকায়)
পৃষ্ঠাঃ ৮০।
সংগঠন সম্পর্কে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের এটি একটি চমৎকার বই। বাংলা ভাষায়, বলতে গেলে সংগঠন সম্পর্কে ইসলামি ধারার বইয়ের বাইরে, এটি মৌলিক বই। সংগঠন কী, এর প্রয়োজনীয়তা কী, বাঙালির সাংগঠনিক দূর্বলতার কারণগুলো কী? ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বইটিতে সেকিউলার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করেছেন। বইটিতে তিনি এত বেশি বার ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং এমন সব সফল ব্যক্তিদের উদাহরণ টেনে এনেছেন যে, মনেই হয়না ‘মুসলমান নামক কোন জাতি’ এই বাঙাল মূলকে আছে/ ছিল এবং তাদের ধর্ম পরিচয় ইসলাম। যদিও নৃতাত্ত্বিক আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি নিজেই বলেছেন, “বাঙালি কখনোই স্বাধীন ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ছিলনা, এবং মুসলমান হবার পূর্বে এই বাঙালিরা এখানে মানুষ স্বীকৃতিই পায়নি”, তবুও তিনি মুসলমান নামক জাতি-গোষ্ঠীটির কথা আলোচনার সাহস কিংবা প্রয়োজন কোনটাই অনুভব করেননি। তারপরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখান ঊঠে এসেছে যা ইসলামি ধারার দা’য়ি, সমাজ কর্মী ও সমাজ বিপ্লবীদের কাজে লাগতে পারে।
**বইটির সূচীপত্রঃ
১. বাঙালির সাংগঠনিক দূর্বলতা-
২. বাঙালির সাংগঠনিক দূর্বলতার কারণ আত্মপরতা-
৩. বাঙালির সাংগঠনিক দূর্বলতার আরও কারণঃ ব্যক্তিগত আসহায়তা, অক্ষমতা, হীনমন্যতা ও আত্মঘাত-
৪. সাংগঠনিক ব্যর্থতার মৌলিক কারনঃ স্বাস্থ্যগত দূর্বলতা!-
৫. কেন আমাদের স্বাস্থ্য বা কর্মক্ষমতা নিঁচুমানের?-
৬. আমাদের সরকার পদ্ধতির রুপরেখা-
৭. সংসদীয় বনাম রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির গণতন্ত্র-
৮. আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর রুপরেখা-
৯. সংগঠনের উত্তরাধিকার-
বইয়ের ভেতর থেকেঃ
‘বাঙালীর সাংগঠনিক দূর্বলতা’ অধ্যায়ে সংগঠনের প্রয়োজনের কথা বলতে গিয়ে লেখক বলেছেন,
“একটা জাতির সংগঠনগুলো যত শক্তিশালি, সে জাতি তত শক্তিশালি । আমাদের জাতির সংগঠনের জগৎটা খুব দূর্বল। এটাই জাতি হিসেবে দূর্বলতার মূল কারণ। জাতিগত ভাবে সমর্থ হয়ে উঠতে হলে এই দূর্বলতা আমাদের কাটিয়ে উঠতেই হবে ।
… … … গত তিন দশকে স্বাধীনতার মুক্ত ও বাধাবন্ধনহীন পরিবেশে আমাদের দেশে যে হাজার হাজার সংগঠন গড়ে উঠতে শুরু করেছে, সেগুলোকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য নিজেদের শক্তির পাশাপাশি আমাদের দূর্বলতাগুলোও চিনে নেওয়া জরুরি।” (পৃষ্ঠাঃ ভূমিকাঃ ৬-৭)
কিভাবে তিনি গড়ে তুললেন বিশ্বসাহিত্যের মতো সংগঠন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন-
একজন মানুষের পক্ষে আর যাই হোক সংগঠন গড়ে তোলা খুবই দুরুহ হওয়ার কথা। … আমার ধারণা ছোট বড় যাই হোক যে কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই একই রকম কঠিন যদি তা সততা গড়ে তোলা যায়। সব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায়ই সমান রকেয়াহুতি দিতে হয় প্রতিষ্ঠাতাদের। অপরিসীম কষ্ট-দুঃখে অজগ্রামের কোন স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে ঢাকয় একটা বড়সড় প্রতিষ্ঠান তৈরী করার কোন পার্থক্য নেই। সময়, অবস্থান, আদর্শ বা মেধার পরিমাণ বা সূযোগ-সুবিধার কম বেশির কারণে সেগুলো বড় বা ছোট হয়”।
যদিও আমার প্রতিষ্ঠানটি অনেক বড় নয়, তবুও “একটি বড় প্রতিষ্ঠান তৈরীর সমান দুঃখ-কষ্টের বোঝাই আমাকে বইতে হয়েছিল। জীবনের উপর দিয়ে নিগ্রহও কম যায়নি। তবু আমি পেরেছিলাম। পেরেছিলাম মানে পারতে হয়েছিল। যে কারণে রামমোহন কে ধর্মসভা প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল, বিদ্যাসাগর কে পাঠ্যবই লেখায় বা সামাজিক আন্দোলনে নামতে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ কে বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে হয়েছিল, বেগম রোকেয়া কে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল; আমাকেও যত সামান্যই হোক, আমার প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে হয়েছিল। তাঁদের মতোই যুগের দাবির উত্তর দেবার জন্য করতে হয়েছিল এটা। এ যে আনন্দে খল খল করতে করতে আমি করেছিলাম, তা নয়। এর চেয়ে ঢের ঢের প্রিয় কাজ ফেলেই আমি এটা করেছিলাম। করেছিলাম বিবেকের দায়িত্ব হিসেবে। খুব আনন্দ পাইনি তবু করেছি। করছি এ জন্য যে, আমার যুগ এই দাবি নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এই পৃথিবীতে মানুষ যা করে তা হয়তো শেষ পর্যন্ত যুগের চাহিদা মেটানোর জন্যই করে। সারা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরে যেমন চলছিল ধর্মের যুগ, উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত যেমন চলছিল কবিতার যুগ, সাত চল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত যেমন ছিল আমাদের জাতীয়তাবাদের যুগ, তেমনি একাত্তরের পর থেকে আমাদের চলছে সংগঠনের যুগ”। (পৃষ্ঠাঃ ১০)
জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন-
“১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে জন্ম নিয়েছি। একটি জাতি অসংখ্য ছোট বড় সংগঠনের যোগফলের নাম। এই সংগঠনগুলো সংখ্যায় যত বেশী হবে এবং শক্তিতে যত অপরাজেয় হবে ঐ জাতিও হবে তত অপ্রতিরোধ্য”।
“স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণতা দেবার দরকারে সারা দেশের সবখানে অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ঊঠার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই সাংগঠনিক প্রয়োজনের পথ ধরে সারা দেশে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে ঊঠতে শুরু করে। এই প্রবণতা আরও কয়েক দশক ধরে নিরবছিন্ন ভাবে প্রবহমান থাকবে বলে আমার ধারণা। গত তিরিশ বছরে এই প্রবণতার পথ ধরে এ দেশে এমন সব বিশাল ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, বিশেষ করে এমন কিছু এনজিও যা রীতিমত বিশ্বমাপের……”।
তিনি আরো বলেন, “কেবলমাত্র সংগঠন নির্মাণের মাধ্যমেই জাতীয় জীবনের সব দুঃখ, সমস্যা ও নৈরাজ্যের উত্তর দেওয়া সম্ভব। তাই হাজার হাজার সংগঠন গড়ে তোলার ভেতর দিয়ে আমাদের দেশের বেদনাবিদ্ধ মানুষেরা ঐসব দুঃখের প্রতিকেরের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতি হিশেবে* আমরা টিকব কি না, টিকলে কতটা সমৃদ্ধি অর্জন করব, তা এসব সংগঠনের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। সংগঠন আজও এ জাতির অনিবার্য বিধিলিপি” (পৃষ্ঠাঃ ১১)
তিনি বাঙালী জাতিকে সাংগঠনিক ভাবে দূর্বল হিশেবে উল্লেখ করেন এবং তার কারণ হিশেবে “বাঙালীর আত্ম-পরতা, অসহায়তা, আত্মঘাত ও দূর্বলস্বাস্থ্য কে দায়ী করেন”।
সংগঠনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেন- “কোন একটা বড় কাজ করার জন্য কিছু মানুষের সুপরিকল্পিত এবং সংঘবদ্ধ চেষ্টাই হলো সংগঠন।” (পৃষ্ঠাঃ ১১)
সংগঠনের সফলতার নিয়ামক হিসেবে ৪টি প্রধান কারণ তিনি উল্লেখ করেন। তার ভাষায় “একটা সংগঠন সফল হয় কয়েকটা কারণে। (১) ওই সংগঠনের কর্মীদের সামনে একটি উজ্জ্বল ও অর্থপূর্ণ লক্ষ্য তুলে ধরতে পারলে; (২) সেই লক্ষ্যের দিকে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্নময়ভাবে জাগিয়ে তুলতে পারলে; (৩) এই উদ্যোগকে সক্রিয় রাখার মতো বস্তুগত সহযোগিতা নিশ্চিত করতে পারলে; (৪) কর্মীদের সামনে লাভের মূলো ঝুলিয়ে রাখতে পারলে। এ সবের সহযোগে ওই কর্মীদল কে সুষ্ঠু উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হলে যে অবিশ্বাস্য ফল পাওয়া যায় তা এর বহুগূণ বিচ্ছিন্ন মানুষের আলাদা চেষ্টা দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়”। (পৃষ্ঠাঃ ১৩)
সব শেষ অধ্যায়ে তিনি “উত্তরাধিকারের সংকট” কে আমাদের সংগঠনের “সবচেয়ে মারাত্মক সংকট” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “সংগঠনগুলোর স্থায়িত্বের সবচেয়ে বড় অন্তরায় এই কারণটিই।… … …আগেই বলেছি এদেশে সংগঠন গড়ে তোলাটাই একটা অসাধ্য ব্যাপার। মাঝারি শক্তির মানুষ দিয়ে এ সম্ভব হয়না। এদেশে কেঊ নিজেকে কারো চেয়ে কম মনে করেনা। তাদের সমকক্ষ বা সামান্য বেশী ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষ কোন কিছু তৈরী করে তাদের উপর কর্তৃত্ব ফলাবে এটা তারা মেনে নেয়না। তাই সবাই মিলে তাকে ধ্বংস করে ফেলে। এ জন্যই এ দেশের অধিকাংশ সংগঠন মুকুলিত হতে না হতেই ঝরে যায়”। (পৃষ্ঠাঃ ৭৮-৭৯)
এমনি আরও নানান অনুষংগ চমৎকার ভাবে লেখক তুলে নিয়ে এসেছেন বইটিতে। সংগঠন নিয়ে যারা ভাবেন, যারা ভাবতে চান, যারা দেশের সেবায়, মানব সেবায় অবদান রাখতে চান কিন্তু কোন পথ খুঁজে পান না, কাজ করতে হতে গিয়ে হতাশ হন তাদের জন্য নিসঃন্দেহে পথ নির্দেশিকা হিসাবে কাজে লাগবে বইটি। …………তো আসুন, একটু সময় বের করে পড়ে ফেলি বইটি।
*‘হিশেব’ বানান টি লেখক নিজে এ ভাবে ব্যবহার করেছেন।
** মূল বইয়ের সূচীপত্রে কোন ক্রম উল্লেখ নেই। কিন্তু বোঝার সুবিধার্থে এখানে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
(নিউজেভেন্ট২৪.কম-এ ১৫-১০-২০১৩ তারিখে প্রকাশিত)
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন