মুরসির ক্ষমতাচ্যুতি ও ইসলামপন্থীদের দর্শনগত দৈন্যতা

লিখেছেন লিখেছেন রামির ১৫ জুলাই, ২০১৩, ১২:০৪:৫৫ দুপুর

৩ জুলাই ২০১৩ রাতে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস (এফজে) পাটির নির্বাচিত, মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত অবাধ, নিরপেক্ষ ও জননন্দিত, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মুরসী ক্ষমতাচ্যুত হন। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী, মুসলিম বিশ্বের শিক্ষার ‘প্রাণকেন্দ্র’, অতীত সভ্যতার লীলাভূমি এবং সর্বোপরি ইসলামপন্থী বৃহত্তম সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড এর জম্মভূমি হওয়ার স্বভাবতই গোটা মুসলিম বিশ্বে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুরসীর ক্ষমতাচ্যুতির এই ঘটনা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী ইসলাম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলো মুরসীর ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই সতর্ক নজর রাখছিল মিশরের ঘটনা প্রবাহের উপর। মিশরের অতীত ও মুরসীর ক্ষমতাসীন হবার পরের ঘটনা প্রবাহ থেকে নানাবিধ সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছিল। ইসলাম-কেন্দ্রিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের মৌলিক নীতিমালা কেমন হওয়া উচিৎ, কী ধরনের কর্মকৌশল সংগঠনসমূহের নেওয়া উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি।

এমনি প্রেক্ষাপটে মুরসীর এই ক্ষমতাচ্যুতি ইসলামপন্থী-চিন্তক সমাজে আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। পেপার-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারে চলছে ব্যাপক বিশ্লেষণ। চলছে এর কারণ অনুসন্ধান আর তা প্রতিরোধের সম্ভাব্য উপায় উদ্ভাবন। আমরা একটু গভীরে গিয়ে আর্থ-সামাজিক কারণের পাশাপাশি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর দার্শনিক কারণ ও তার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করব।

ইসলামপন্থীদের আত্ম-বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি ক্ষমতাসীন হবার পর যদি মনে হয় যে, ক্ষমতাসীন সরকার জনবিরোধী কার্যকলাপে ব্যস্ত, দেশবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে তাহলে জনগণ কিন্ত ৫ বছর অপেক্ষা না করে তার বিরোধীতা করবে। সরকারের পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানাবে। এতে ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি না হলে সরকারবিরোধী জনগণ দেশি বা বিদেশী শক্তিকে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার জন্য স্বাগত জানায়। এটা যদি বাংলাদেশ বা অন্য দেশে ইসলামপন্থী দলগুলোর অবস্থান হয়- তাহলে মিশরে সরকারবিরোধী দলগুলোর একই অবস্থানে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা হতাশ’ কেনো? কেনোই বা তাদের সেকিউলারিষ্টবিরোধী এত চিৎকার?

বাংলাদেশে ইসলামপন্থী বিরোধীদলের ইচ্ছামাফিক কাজ না করায় যদি সরকারবিরোধী আন্দোলন করা বাস্তবসম্মত, ‘ইসলামি-দায়িত্ব’ ও দেশ-সেবার কাজ হয়- তাহলে মিসরের ক্ষমতাসীন সরকার ‘সেকিউলারিস্ট ও লিবারাল’ বিরোধীদলের মনোপুত কাজ না করায়- সরকারকে ক্ষমতা ছাড়ার আহ্বান কেন অযৌক্তিক হবে?

ঘটনা একই। অথচ দু’দেশে দুই অবস্থান কেন? এই ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ কি বৈপরীত্য নয়। নয় কি মুনাফেকী অথবা চরিত্রের দ্বৈতনীতি? দ্বৈতনীতিই যদি হয় তাহলে- কেন আমাদের এই অবস্থান? ইসলাম কী বলে এই বিষয়ে? এ মৌলিক সমস্যার উদ্ভবই বা কেন? আমরা জানতে চেষ্টা করব- এই রকম পরিস্থিতিতে ইসলামের দর্শন কী বলে?

mursi egyptমুরসীর ক্ষমতাচ্যুতির সাধারণ কারণসমূহ

মিসরের সেনাবাহিনীর এই ক্যু নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। একেকজন একেকভাবে বিশ্লেষণ করছেন এই ঘটনাকে। মুরসীর ক্ষমতাচ্যুতির অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে –

১. মিশরের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা

২. ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব

৩. বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিপ্লবী জনগণের আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়ন না হওয়া

৪. নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম-বৃদ্ধি

৫. বিরোধীদলের সরকারে অংশীদারিত্ব না থাকা

৬. সংবিধানে সকল রাজনৈতিক দলের মতামতের প্রতিফলন না হওয়া

৭. সেকিউলারিস্ট- যারা মোবারকবিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখেছিল তাদেরকে ‘ধর্মবিরোধী’ হিসাবে চিহ্নিতকরণ

৮. বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাপন্থী ও চেতনাবিরোধী বিভাজনের মতো ‘মোবারকপন্থী’ ও ‘মোবারকবিরোধী’ আখ্যায় আখ্যায়িতকরণ

৯. মুসলিম ব্রাদারহুড কিংবা এফজে’র মতামদের বিরোধী মতকে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসাবে রূপায়ন

১০. জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের চাইতে সংবিধানের ‘তথাকথিত ইসলামিকরণে বেশী জোর ( সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাদি যু্ক্তকরণ) প্রদান

১১. শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেকিউলারিস্টদের মতামতকে অগ্রাহ্য করা

১২. প্রচলিত গণতন্ত্রকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা

১৩. সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা

১৪. সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, স্কাফ, ও সুপ্রিম ইলেকশন কমিশন এর সাথে মাত্রাতিরিক্ত বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি।

এসব কারণের সাথে বাংলাদেশের ইসলামপণ্থী তরুণ বুদ্ধিজীবীদের লেখা হতে আরো কিছু কারণ উল্লেখ করা যায়-

১. বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়ার মতো বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক নেতৃত্বকে হত্যার পরিবর্তে ক্ষমা করা

২. সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশকে বিচারের মুখোমুখি না করা,

৩. বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশনের একটি বড় অংশকে ক্ষমতাচ্যুত না করা

৪. আগের সরকারের একটি বড় অংশকে বিনা বিচারে হত্যা না করা ইত্যাদি।

আমাদের মতে এসব কারণ এক ধরনের ইমোশানাল, ‘বাম আদর্শ প্রভাবিত’ ভ্রান্ত ইসলামী কনসেপ্ট।

কারণ বনাম ফলাফল

উপরে বর্ণিত কারণগুলো মুরসীর ক্ষমতাচ্যুতির জন্য যথেষ্ট হতে পারে । এর বাইরেও আরো কোন কারণ থাকতে পারে; নাও পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এগুলো কি মৌলিক কারণ, নাকি অন্য কোনো মৌলিক কারণের ফলাফল?

আসলে এগুলো মৌলিক কোনো কারণ নয়, বরং মৌলিক কোনো কারণের ফলাফল মাত্র। আর এগুলোকে যদি কোনো কারণ হিসাবে ট্রিট করা যায়, তাহলে সবোর্চ্চ সেকেন্ডারি কারণ বলা যেতে পারে, প্রাইমারি কারণ নয়। আর উপরোক্ত কারণগুলোকে যদি ফলাফল হিসাবে ট্রিট করি, তাহলে মুরসীর ক্ষমতাচ্যুতির মৌলিক কারণ হলো- ‘রাষ্ট্র সম্পর্কে বা রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে ইসলামী দর্শনের মূলনীতি বুঝতে বর্তমানের ‘পলিটিকাল ইসলাম’ গাইডেড রাজনৈতিক দলসমূহের বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থ হওয়া। আর এসব মিসআন্ডারস্টুড বিষয়গুলোর মাঝে রয়েছে- “ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী সংবিধান, ইসলামী বিপ্লব” ইত্যাদি পরিভাষার মাঝে দর্শনগত যে ভ্রান্তি রয়েছে তা অনুধাবনে এবং বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ।

সমাধানের পূর্বশর্ত

মিসরের বর্তমান এই ঘটনায় মুসলিম ব্রাদারহুডের বা এফজে পার্টি কিংবা শাসক হিসেবে মুরসীর কোনো ব্যর্থতা নেই। বরং দল বা শাসক হিসাবে গত এক বছরে তাদের অনেক অর্জন রয়েছে। মিসরের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মুরসীর এক বছরের সফল শাসন, মিসরের দীর্ঘ মেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য “আন নাহদা” বা পুনর্জাগরণ প্রকল্পের অনুমোদন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু, আগামী ২০ বছরে মিসরের অর্থনীতিকে ভাড়াভিত্তিক অর্থনীতি থেকে উৎপাদন ভিত্তিক বা রফতানিমূলক অর্থনীতিতে রূপান্তরের কার্যক্রম গ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে মিসরের একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রভাবশালী অবস্থান তৈরি নি:সন্দেহে মুরসী এবং দল হিসাবে এফজে পার্টির সফলতার মাণদন্ড। তাই মিসরের সমস্যার মূলে ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের যে দর্শনগত বিভ্রান্তি তা বুঝতে হলে কিছু স্বত:সিদ্ধ নিয়ম মেনে চলতে হবে। সেগুলো হচ্ছে-

ক) ইসলামে রাষ্ট্র বা সমাজ শাসন ব্যবস্থার কোনো সর্বজনীন বিধান বা পদ্ধতি বলে দেয়া হয়নি। বরং জোর দেয়া হয়েছে সুশাসন, ন্যায় বিচার ও জনগণের সবোর্চ্চ আশা-আকাঙ্খা পুরণের ওপর। মুসলিম দার্শনিক ও সমাজ চিন্তকদের তাই নিত্য-নতুন পথ এবং পদ্ধতি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

খ) সমাজ বা রাষ্ট্রচিন্তার কোনো পদ্ধতিই সামাজিক সুবিচার ও সুশাসনের উপর গুরুত্ব পাবে না

গ) গণতন্ত্র বর্তমান সময় পর্যন্ত মানব আবিষ্কৃত সবচেয়ে ভাল সমাজ-শাসন ব্যবস্থা হলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার রকমভেদ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের লক্ষ্যমাত্রা হবে শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে অংশীদার করা।

egypt arm agressionমুরসীর পতনের কারণগুলোর ধরন

মুরসীর ক্ষমতাচ্যুতির কারণগুলোকে আমরা বিভিন্নভাবে ভাগ করব। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক। অর্থনৈতিক কারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বেকারত্বের হার, জিডিপির নিম্নবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক বিনিয়োগের নিম্নগতি ইত্যাদি। রাজনৈতিক কারণের মধ্যে রয়েছে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহ। এক্ষেত্রে এফজে পার্টি বহুত্ববাদকে উপেক্ষা করে কিছুটা একদলীয়, শাসন ব্যবস্থা চালু করে। সাংবিধানিক কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে মিশরের নতুন সংবিধান রচনা। যেখানে উদারতাবাদী, কমিউনিস্ট, কপটিক খ্রিস্টান ও সালাফীসহ সকলের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। সালাফীরা চেয়েছিল আরো অধিক তথাকথিত ‘ইসলামায়ন’ প্রক্রিয়া। আর কমিউমিস্টরা চেয়েছিল উদারতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। এফজে পার্টি উভয় গ্রুপকেই উপেক্ষার মাধ্যমে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সংবিধানে আল্লাহর সর্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও অন্যান্য ধারা সংযোজন করে ।

এফজে পার্টির কর্মপন্থা ও তাতে ইসলামি দর্শনের প্রভাব

ব্রাদারহুড ব্যাকড এফজে পার্টি গত বছর যে সব কার্যক্রম সম্পাদন করেছে তাতে ইসলামী দর্শনের প্রতিফলন রয়েছে। বিশ্বব্যাপী পলিটিক্যাল ইসলামিস্টরা বিশ্বাস করেন-ইসলামি বিপ্লব সাধন, ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম ও ইসলামি সংবিধান অনুযায়ী ইসলামি/মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালনা করা ইসলামি আন্দোলন এবং মুসলমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র ইসলামি বিপ্লব, ইসলামি সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম-ইসলাম, মুসলিম রাষ্ট্র ইত্যাকার শব্দগুলো (বাংলা অথবা ইংরেজি কিংবা আরবি ভাষায়) যে ইসলামি দর্শনের মাঝে ষোড়শ শতাব্দীর অনুপ্রবিষ্ট এক ধরনের “ভাষার অপপ্রয়োগ” (রাষ্ট্রবিজ্ঞান: প্রেক্ষিত ইসলাম, লেখক- আব্দুল রশিদ মতিন, আইআইইউএম) এবং ইসলামের সার্বজনীন মানবতাবাদের সাথে সাংঘর্ষিক, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী চিন্তকদের মাঝে তেমন কোনো কাজ হয়নি। বিংশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মাওলানা মওদুদী এসব পরিভাষা, তাদের অর্থ এবং ইসলামি সার্বজনীন দর্শনের সাথে এগুলোর সামঞ্জস্যতা নিয়ে কিছু কাজ করেছেন। আর পরবর্তী সময়ে কম-বেশী, সবাই তাঁকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেছেন। মৌলিক গবেষণা তেমন একটা হয়নি। আর হলেও বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এসব জ্ঞান-গবেষণা ও তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য হয়নি।

যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংবিধান, ইসলামি বিপ্লব, রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাকার বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ব মুসলিম মনীষীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি; তাই ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন গুলোর নিকট এসব ব্যাপার অনেকটা অস্পষ্ট আছে। ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংবিধান, ইসলামি বিপ্লব, রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাদি বিষয়ের কোনো টার্গেট, মানদণ্ড ও লক্ষ্যমাত্রা নেই। পূর্ব নির্ধারিত কোনো লক্ষ্যমাত্রা না থাকায় এসব অর্জনের বিভিন্ন বিকল্প নিয়েও গবেষণা নেই। ফলে, এফজে পার্টিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে-অন দ্যা স্পট। বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করার কোনো সুযোগ ছিল না।

মুরসীর ক্ষমতাচ্যুতির কারণ হিসাবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক যে সকল কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে-তাতে দেখা যায়, যে দলই মিসর শাসন করুক না কেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুরসীর চেয়ে বেশি সফলতা লাভ করা কঠিন হতো। কিন্তু যদি সামষ্টিকভাবে সব দল মিলে মিসর শাসন করত, তাহলে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এসব গণদাবি উত্থাপন করার কোনো সুযোগ থাকতনা। এর ফলে সর্বদলীয় শাসন-ব্যবস্থা স্থায়ী হতো। দেশ ও জনগণের শাসন-ব্যবস্থায় বহুমত প্রধান্য পেত। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা স্থায়ীরূপ লাভ করত। মিলিটারি শাসনাধীনে যে ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ গড়ে উঠেছিল- তাদের দীর্ঘ মেয়াদে দমন করা সম্ভব হতো। বহুত্ববাদী শাসনে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ থাকে, ফলে যে কোনো ভুল-ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ বেশি থাকে। বহুত্ববাদি শাসন ব্যবস্থায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় স্থিতিশীলতা বিরাজ করে, স্বস্ব ধর্ম-কালচার পালন করার সুযোগ থাকে।

দীর্ঘদিন ব্যাপী ক্রুসেড, পরবর্তীতে উপনিবেশিকতা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তালেবান, হরকাতুল জিহাদ, ইসরাঈলের ফিলিস্তিনবিরোধী কার্যকলাপে, জাতিসংঘের মুসলিম-বিষয়ক উদাসীনতা ইত্যাদির কারণে বর্তমান বিশ্বে যে জাতিগত আন্ত: সম্পর্কের ‘অবিশ্বাস’ সৃষ্টি হয়েছে- প্লুরালিস্টিক শাসনের মাধ্যমে তা দূর করা সম্ভব হতো মিসরের মতো দেশের ক্ষেত্রে। এর ফলে জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটত। চুরি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য প্রভৃতির অবসান ঘটত। মানবতাবাদের বিজয় দেখা দিত। আর এ সবই হচ্ছে ইসলামি শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রা।

egypt_murciদর্শনগত বিভ্রান্তি ও তার ফলাফল এবং মুক্তির উপায়

মুসলিম ব্রাদারহুডসহ সকল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংবিধান, ইসলামি বিপ্লব, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ইত্যাদি বিষয়গুলোতে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শন যেহেতু অস্পষ্ট। যেহেতু এসব বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সেগুলো অর্জনের জন্য নির্দষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও তার সুনির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি নিয়ে কোনো গবেষণা নেই; তাই মুসলিম ব্রাদারহুডসহ যে কোনো ইসলামপন্থী দল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু ভুলের সম্মুখীন হয়। প্রথমত: ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ পরিভাষাটির অর্থ কী? দ্বিতীয়ত: ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ পরিভাষাটির বর্তমানে প্রচলিত বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে -‘ইসলামি রাষ্ট্র’-এ সার্বভৌমত্ত্বের মালিক আল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, সংবিধান হবে ইসলামি। আর এ কারণে, মুসলিম ব্রাদারহুডসহ সকল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর দর্শন হয়ে দাড়াঁয়, কিভাবে কোনো দেশের ক্ষমতায় আসীন হবার পর সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ত্ব, ইসলামি সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ইত্যাকার বিষয়গুলো, আক্ষরিক অর্থে সেদেশের সংবিধানে যুক্ত করা যায়। এই কাজকে তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিশ্বাস করে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করে। আর শুধুমাত্র এ কারণেই মুসলিম ব্রাদারহুড এবং ব্রাদারহুড ব্যাকড্ এফজে পার্টি ‌এবং এই দল মনোনীত প্রেসিডেন্ট মুরসীও মোবারকবিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকে প্লুরালিস্টিক সরকারের কথা বললেও ধীরে ধীরে, সুকৌশলে এবং অনেকটা অবচেতনভাবেই তাদের পূর্বোক্ত অবস্থান থেকে সরে আসেন। ‘কিং মেকার’ এর অবস্থান গ্রহণ না করে হয়ে বসেন ‘কিং’। সুদীর্ঘ সময় পরে ক্ষমতা পেয়ে তারা মিসরের তথাকথিত ‘ইসলামায়নে’ সর্বশক্তি নিয়োগ করে। যেহেতু সেকিউলারিস্ট, লিবারেল কিংবা কপটিক খ্রিস্টানদের সাথে থাকলে এসব তথাকথিত ‘ইসলামায়ন’-এর কাজ করা সম্ভব নয় তাই তারা এদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা শুরু করে। আর সাথে রাখলেও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, ইসলামি সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ইত্যাকার বিষয়গুলোতে তাদের কেয়ার না করেই সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত করে। আর এখানেই বাধে যত বিপত্তি।

বিপরীতপক্ষে, মুসলিম ব্রাদারহুড যদি দর্শনগতভাবে বিশ্বাস করত যে, ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংবিধান, ইসলামি বিপ্লব, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ইত্যাদি পরিভাষাগুলো ইসলামি দর্শনে এক ধরনের ‘মিসগাইডিং টার্মিনোলজি’ এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (অন্যান্য ধর্মপালনকারিসহ) কোনো দেশের বা রাষ্ট্রের সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ত্ব, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ইসলামের ফরজ-ওয়াজিব, সুন্নত ইত্যাকার বিষয়গুলো সন্নিবেশের কোন প্রাসঙ্গিকতা, যৌক্তিকতা ও গুরুত্ব ইসলামে নেই এবং মুসলমানদের কুরআন- সুন্নাহ দ্বারা বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে মানবজাতির নিকট উপস্থাপিত ও স্বীকৃত। তাহলে মুসলিম ব্রাদারহুড, ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি কিংবা মুরসী কেউই ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংবিধান, ইসলামি বিপ্লব, রাষ্ট্রধর্ম – ইসলাম ইত্যাদি পরিভাষাগুলো সংবিধানে সংযোজনের জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠতনা। প্লুরালিস্টিক সোসাইটির কনসেপ্ট হতে দূরে সরে আসতনা। সালাফি কিংবা অন্য কোনো দলের পক্ষ থেকেও আরো বেশি গোঁড়ামি প্রদর্শনের চাপ থাকতনা। আর ‘কিং মেকার’ এর আসন থেকে ‘কিং’ এর আসনে বসার এক্সট্রা আনন্দও কোনো ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল অনুভব করতনা। আর এমন আচরণ নি:সন্দেহে তাদের জন্য হতো দূরদৃষ্টিপূর্ণ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ।

মওদুদী ও তৎপরবর্তী গবেষণা

যে সব পরিভাষা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনে দর্শনগত বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে সে সব পরিভাষা নিয়ে ইসলামপন্থী সমাজচিন্তকদের প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন। প্রয়োজন ইসলামি দর্শন কিভাবে পশ্চিমাদ্ভুত সব পরিভাষাগুলোকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করতে পারে তার সঠিক সমীকরণ নির্ণয়। প্রয়োজন মাওলানা মওদুদী ১৯৪০ সালে এবং তৎপরবর্তী সময়ে ইসলামি বিপ্লব, ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংবিধান ও গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে যে প্রাথমিক ও গুণগত (Primary and Qualitative) বিশ্লেষণ করেছেন (ইসলামি বিপ্লবের পথ, মাওলানা মওদুদী, অনুবাদ- আব্দুস শহীদ নাসিম) সেগুলোর পুন:নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ এবং সেগুলোর আরো সুক্ষ্মতর ও উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে সঠিক সংখ্যায়ন (Quantification)। আর এ জন্য অত্যাবশ্যকীয় কাজ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে গবেষণা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করা। যাতে প্রচুর সংখ্যক “মওদুদী দ্যা জুনিয়রস” এর জন্ম হয়। বিশ্বব্যাপী জন্ম নেয়া এসব তাত্ত্বিক ও গবেষকদের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজে প্রচলিত ওই সব ‘মিসগাইডিং টার্মিনোলজি’র অপনোদন ঘটবে। সঠিক টার্মিনোলজির উদ্ভব হবে এবং বিশ্বব্যাপি সর্বজনীন, মানবতাবাদী একটি ‘কর্মপরিচয়বাহী’ ইসলামভিত্তিক ‘সমাজ ও রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থার’ দর্শন জন্মলাভ করবে।

সর্বশেষ কথা

বর্তমানে মুরসীর এই ক্ষমতাচ্যুতি ব্যক্তি হিসাবে মুরসী, রাজনৈতিক দল হিসাবে ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি কিংবা ইসলামপন্থী সামাজিক সংগঠন হিসাবে মুসলিম ব্রাদারহুডের একক কোনো পরাজয় নয়। বরং বিশ্বব্যাপী ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’-পন্থী চিন্তাধারার বুদ্ধিজীবীদের এক দর্শনগত দৈন্যতা এবং ইসলামী-দর্শন ভিত্তিক ‘সমাজ ও রাষ্ট্র’ কাঠামো বিষয়ে টারশিয়ারি বা উচ্চ জ্ঞান-গবেষণায় ‘নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থীদের’ পিছিয়ে থাকার এক জ্বলন্ত নমুনা ।

তাই বলা যায় “মিসরের এই ঘটনা সেই অঞ্চলের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি” হলেও এই ঘটনার বীজ শুধু মিসরের অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা সাংবিধানিক আইনী কাঠামোর মধ্যেই সীমিত নয়। বরং সমাজ কাঠামো পরিচলনাবিধির দর্শনগত স্তরে এই বীজ নিহিত। আর দর্শনগত ভ্রান্তি বা বিশ্বাসের কারণে সৃষ্ট কোনো সমস্যার সমাধান কেবলমাত্র দর্শনগত ভ্রান্তি দূর করার মাধ্যমেই সম্ভব, অন্যথায় নয়। সুতরাং প্রচলিত ইসলামি বিপ্লবের (মিসগাইডিং পরিভাষা) চিন্তায় বিভোর প্রচলিত ইসলামি আন্দোলনগুলোকে ইসলামের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নীতিমালা বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করে ভবিষ্যৎ ‘দর্শন-কাঠামো’ ঠিক করতে হবে। নইলে শত সহস্রবার তাদের আলজেরিয়া, মিসর আর তুরস্কের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

ফরহাদ মাজহারের ভাষায় “তবে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক ছাড়া মিসরীয় জনগণের প্রায় সবারই সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাওয়াকে ইসলামবিরোধীদের ষড়যন্ত্র হিসেবে না দেখে নির্বাচনবাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখাই শ্রেয়। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের প্রতি ইসলামপন্থী রাজনীতির নীতি ও কৌশলের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাও এ ক্ষেত্রে দায়ী। এই দিকগুলো থেকে দেখলে মিসরের ঘটনাবলী থেকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী ও ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক ধারার দুই পক্ষই কিছুটা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, এই আশা করি”।

বিষয়: বিবিধ

১২০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File