গুলেন মুভমেন্ট : মুসলমানদের পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনে এক নতুন ধারা
লিখেছেন লিখেছেন রামির ০৭ জুলাই, ২০১৩, ১২:১৫:৫১ দুপুর
পরিবর্তনশীল সমাজ ও বিশ্বের অনেক কিছুই ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবন ও জগত সম্পর্কীয় মৌলিক বিশ্বাসের পরিবর্তন না ঘটলেও মৌলিক বিশ্বাস কেন্দ্রিক কার্যসমূহের ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে অনুধাবন ও বাস্তব জীবনে পরিপালনের প্রক্রিয়াটি বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজে বিবর্তনশীল। আর তাই ইসলামকেন্দ্রিক বিষয়সমূহের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আমরা অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করি। বিগত চার দশকে তুরস্কে ইসলামপন্থী আন্দোলনের কার্যাবলী প্রখ্যাত দার্শনিক, আলেম, শিক্ষক, চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক ফেতুল্লাহ গুলেন এর হাতে অভিনব রূপ ও কৌশল পরিগ্রহণ করেছে। ফেতুল্লাহ গুলেনের সাথে তাঁর সহকর্মীদের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গী ও কার্যকৌশল বিশ্বাসীর নিকট “গুলেন মুভমেন্ট” নামে পরিচিত। তুরস্কে ইসলামপন্থী একে পার্টির ক্ষমতায়ন এবং দীর্ঘ ১০ বছরব্যাপী চরম সমাজতান্ত্রিক ও নাস্তিক্যবাদী সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলা করে এরদোগান ও আব্দুল্লাহ গুলের সরকার পরিচালনার নেপথ্যে রয়েছে এই গুলেন মুভমেন্টের ব্যাপক অবদান। এই প্রেক্ষাপটেই বিশ্বব্যাপী ফেতুল্লাহ গুলেন ও গুলেন মুভমেন্টকে নিয়ে শুরু হয়েছে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ। ফেতুল্লাহ গুলেন ও গুলেন মুভমেন্টকে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী ব্যক্তিদের নিকট প্রাথমিকভাবে পরিচিত করানোর অংশ হিসেবে আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
ঐতিহাসিক পটভূমি : গুলেন মুভমেন্ট হচ্ছে একটি সামাজিক আন্দোলন (Civil society movement)। তুরস্কের ইজমির নগরীর প্রচারক ফেতুল্লাহ গুলেন এবং তার চারপাশের একদল ত্যাগী, নিষ্ঠাবান ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক এবং স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের একটি সামাজিক সেবা প্রদানকারী গ্রুপ হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই গুলেন মুভমেন্টের। পশ্চিমা স্কলারদের নিকট, এককথায়, এটি গুলেন আন্দোলন (গুলেন মুভমেন্ট) হিসেবে পরিচিত। গুলেন মুভমেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের নিকট এটি হিজমেত বা ‘স্বেচ্ছাসেবী আন্দোলন’ হিসেবে পরিচিত। ফেতুল্লাহ গুলেন এই আন্দোলনকে ‘মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ একদল লোকের আন্দোলন’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
মুসলিম-বিশ্বাসভিত্তিক আন্দোলন হিসেবে এটি ১৯৬০ সালের দিকে যাত্রা শুরু করে। আর এই উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ছাত্র-বৃত্তি, ছাত্রাবাস, স্কুল-কলেজ এবং কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষা-সেবা নিয়ে। বিগত চার দশকের মধ্যে এটি জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে এটি শিক্ষাক্ষেত্র হতে আন্তঃসাংস্কৃতিক, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে। বর্তমানে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কয়েক মিলিয়নে। গুলেন মুভমেন্টের অনুসারীদের রয়েছে শত শত ফাউন্ডেশন, কোম্পানি, পেশাজীবী সংগঠন এবং অসংখ্য আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সামাজিক সংগঠন ও সংস্থা।
প্রথম দিকে গুলেন মুভমেন্টের কাজ শুরু হয় মূলত ছাত্র-শিক্ষক, স্থানীয় অধিবাসী এবং বিভিন্ন সভা-সমিতি, সেমিনার ও ক্যাফে-কর্নারে ফেতুল্লাহ গুলেনের খোলা প্রশ্নোত্তর পর্বে যারা অংশগ্রহণ করতো তাদের মাধ্যমে। আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে গুলেন ইজমির শহরের একটি ছাত্রাবাস কাম কোচিং সেন্টারে ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। ফেতুল্লাহ গুলেন মুভমেন্টের প্রাথমিক উন্নয়নে এই ‘কিস্তানি পাজারি’ ছাত্রাবাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গুলেন ছিলেন একজন সরকারি ধর্ম-প্রচারক। তিনি ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি অংশ নিতেন নানা গণবক্তৃতায়। তাছাড়াও গুলেন অংশ নিতেন যেকোনো ক্যাফে-কর্নারে ও চা-চক্রের আড্ডায়। এই সকল পরিবেশে আলোচনা চলত সুশিক্ষার জন্য আবশ্যকীয় নানা অনুসঙ্গ এবং প্রয়োজনীয় নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে। আর এই আলোচনাই গুলেন ও তার চারপাশের লোকজনকে সামাজিক সামষ্টিক মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। এই আলোচনা ও পর্যালোচনার ফলেই পরবর্তীতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে ওঠে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। আর এই সব প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম শিক্ষাভিত্তিক; যেমনÑ ছাত্রবাস, কোচিং সেন্টার, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর কলেজ প্রভৃতি। পরবর্তী সময়ে মিডিয়াভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে এই সকল মিডিয়া গড়ে উঠেছিল শিক্ষা উদ্যোগের অনুবর্তন হিসেবে। আরো পরের দিকে, সমমনা ও সমপেশার লোকদের নিয়ে গড়ে ওঠে নানা পেশাজীবী, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
আশির দশকের শেষ দিকে তুরস্কে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের লালন সামরিক শক্তির লৌহশাসনের অবসান ঘটে। ঠিক একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে এবং মধ্যএশিয়ায় অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। এই সময় গুলেন মুভমেন্ট দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের পর মধ্যএশিয়ার সকল সদ্য স্বাধীন মুসলিম দেশে গুলেন মুভমেন্ট তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। তুর্কি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীভুক্ত এসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি গুলেন মুভমেন্ট আন্তঃসাংস্কৃতিক ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ শুরু করে। হান্টিংটেনের “সভ্যতার সঙ্কট” এর বিপরীতে ফেতুল্লাহ গুলেনের এই “আন্তঃধর্মীয় সংলাপ” সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়।
যদিও এন্টার্কটিকা ব্যাতীত বাকী সকল মহাদেশেই গুলেন মুভমেন্টের কাজ সম্প্রসারিত হলেও এর কোনো নিবন্ধিত অফিস বা ঠিকানা নেই। তুরস্কের সকল শহর ও নগরীতে গুলেন মুভমেন্টের দ্বারা অনুপ্রাণিত স্কুল কিংবা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ছড়িয়ে রয়েছে। তুরস্কের বাইরেও সকল মহাদেশ জুড়ে শত শত স্কুল ছড়িয়ে আছে। আর এ সকল স্কুল গুলেনের শান্তিপূর্ণ জীবন ও কর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ১৯৬০ সালে গুলেনের কতিপয় শিষ্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ২০০০ সালে লাখ লাখ মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেকেরই গুলেনের সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। এটা সত্যিই আশ্চর্যের যে, কিভাবে এটা ঘটল? গুলেন মুভমেন্ট এর কোন্ বিষয় তুরস্কের জনগণকে এতটা আকৃষ্ট করল?
গুলেন মুভমেন্টের বাণী ও তার মূল আকর্ষণ : ষাটের দশকের শেষ দিকে এবং সত্তরের দশকের প্রথম দিকে গুলেন দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে/বিপরীতে বাস্তবজীবনীভিত্তিক গভীর বিশ্বাস ও মানবসেবার প্রচার শুরু করেন। সে সময় গণতন্ত্রের ওপর অগণতান্ত্রিক বাধা, জনজীবনে ধর্মীয় আচার পালনে বাধা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংঘর্ষ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। সুন্নী ও আলভী, তুর্কী ও কুর্দি, নিষ্ঠাবান ও সেক্যুলার মুসলিম নাগরিকদের মাঝে উত্তেজনা ছিল চরমে। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রী, ফ্যাসিস্ট ও ধর্মীয় চরমপন্থীদের মাঝের রাজনৈতিক ও আদর্শিক সশস্ত্র সংঘাত তুরস্কের রাস্তাঘাটে হাজার হাজার যুবকের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এছাড়াও তথাকথিত আধুনিকতাপন্থী ও ঐতিহ্যবাদপন্থীদের মাঝে বিরাজমান চরম উত্তেজনা ও অন্যান্য অনেক সমস্যা মিলে তুরস্কের শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে ফেলেছিল। আর এসব কারণে ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও গোটা মানবতাকে নিয়ে গুলেনের সামগ্রিক চিন্তাধারা তাঁর শ্রোতাদের নিকট একটি আবেদন সৃষ্টি করেছিল। দারিদ্র্য, পারস্পরিক শত্রুতা (বিশেষ করে ধর্মবিভেদ), সুশিক্ষার অভাবকে গুলেন এসব সমস্যার মূল কারণ হিসেবে সনাক্ত করেন। আর এর সমাধান হিসেবে গুলেন নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন এবং তার অনুসারীদের শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেন :
১. আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে একজন গভীর বিশ্বাসী এবং সে বিশ্বাসের বাস্তব অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলা।
২. শুধু নিজের সেবা না করে অন্যদের সেবার চিন্তাও করতে হবে; শুধু নিজের কথা চিন্তা না করে মহৎ ভিশন নিয়েও ভাবতে হবে। তিনি সচেতন যুবক ও জনগণকে প্রশ্ন করলেন, কেন আরো সমৃদ্ধ তুরস্ক চাইবে না? কেন শান্তিপূর্ণ মানবতা কামনা করবে না?
৩. অজ্ঞতা, ধর্ম-বিভাজন, দারিদ্র্য ইত্যাদি যে সকল সমস্যা জাতিকে পঙ্গু করছে তার প্রধান কারণ মৌলিক শিক্ষার অভাব। আর শিক্ষাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে সবার আগে দরকার নিষ্ঠাবান শিক্ষা ও প্রশাসকÑ যারা মানুষের কাক্সিক্ষত মূল্যবোধ ছাত্রদের সামনে পালনের মাধ্যমে তুলে ধরবে। কাজেই শিক্ষায় বিনিয়োগ করুন। তিনি আহ্বান জানালেন, যদি আপনি একজন ব্যবসায়ী হন তাহলে কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করুন। যদি আপনি সন্তানের জনক-জননী হোন, তাহলে সন্তানদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করুন এবং আপন আপন এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন। আপন পরিসরে প্রত্যেকেই সহায়তা করুন ‘শিক্ষা-প্রকল্প’ বাস্তবায়নে। পরবর্তীতে অন্যান্য প্রকল্প যেমনÑ মিডিয়া, স্বাস্থ্যসেবা, আকস্মিক বিপর্যয়ে সহায়তা দান, দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি চালু হয়েছিল এবং জনগণের নিকট আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
৪. সবকিছু সরকারের নিকট থেকে চাইবেন না। নাগরিক দায়িত্ববোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালন করুন এবং কখনো নিজের দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। গুলেনের এই আহ্বান জন এফ কেনেডির সেই বিখ্যাত উক্তিরই যেন নতুন এক প্রতিধ্বনি ‘‘প্রশ্ন করবে না রাষ্ট্র তোমার জন্য কি করতে পারে? বরং প্রশ্ন করবে তুমি রাষ্ট্রের জন্য কি করলে?’’
যদি আপনি ব্যবসায়ী হোন তাহলে নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করুন, বিভিন্ন পার্টনারশিপ ও হোল্ডিংস গঠন করুন, অর্থ আয় করুন এবং উদারহস্তে দান করুন। কোনো পার্থিব প্রতিদান আশা না করে মানব সমাজের দায়িত্ব পালন করুন।
৫. পৃথকীকরণ, বর্ধনীকরণ এবং জনজীবনের ঘটনায় প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করুন। বিচারবিভাগ, শাসনবিভাগ, সামরিক বাহিনী, মিডিয়া, শিল্পকলা ও ব্যবসা সর্বত্রই সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করুন। দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকরা এসব প্রতিষ্ঠানগুলো “ধর্মবর্জিত গুণাবলী” সম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করেছে। তারা তাদের সন্তানদের শুধুমাত্র মাদরাসা এবং ইমাম হাতিফ স্কুলে প্রেরণ করছে। ফলে তাদের প্রত্যাশা কিংবা বিশ্বশিক্ষা অবমূল্যায়িত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। (চলবে)
সোর্স:সাপ্তাহিক সোনারবাঙলায় প্রকাশিত
সোর্স:
বিষয়: রাজনীতি
১০৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন