ইদানিং আমাদের দেশের নারীরা ইসলামী আদব ,হিজাব ইত্যাদি নিয়ে কিছু কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে আমার পূরণ দিনের একটা নিবেদন পুন:প্রচার ।

লিখেছেন লিখেছেন এস এম ইমদাদুল ইসলাম ১৩ আগস্ট, ২০১৩, ০৮:০৪:৩৪ রাত

" ষোড়শীর মুখ ও দাদীর নেকাব "

--------------------------------------------------------------

এরকম একটা সুযোগ আপনি কেন হাত ছাড়া করবেন ?

-প্লীজ, আপনারা আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। যথেষ্ট হয়েছে। আপনারা আমার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রতিবাদ করেছেন। দ্যটস এনাফ । আমি এ বিষয়ে আর কোন কথা বলতে চাইছি না।

কিন্তু প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের এরকম ইলিগ্যাল সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয়ে মামলা করা তো আপনার বৈধ অধিকার ।

-দেখুন, আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি। এটা এখানেই সমাপ্তি টানা হোক। এ নিয়ে আর কোন বাড়াবাড়ি দয়া করে কেউ করবেন না। আমি আমার পক্ষে যে সামাজিক রায় পেয়েছি, সেটাই যথেষ্ট। আর তা ছাড়া তিনি আমার শিক্ষক, গুরুজন। ভুল তো তিনি করতেই পারেন। অতএব ---- । দয়া করে আপনারা আসুন ।

নানা রকম বিশেষনে বিশেষায়িত করেও শবনমের নিকট থেকে আর কোন তথ্য উদ্ঘাটন করতে না পেরে সাংবাদিকরা সেদিনকার মত বিদেয় হলেন ।

এ এক বিড়ম্বনা। কোন একটা কিছুর গন্ধ পেলেই হল, একেবারে জোঁকের মত লেগে থাকে এরা । রোজ রোজ সাংবাদিকদের এভাবে অযাচিত নাক গলানো -একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছে।

গাঢ় অমাবশ্যার অন্ধকার। দু'চোখ পলকহীন। শীতল বাতাসে চোখ দুটো ঠান্ডা বরফের মত ভারী হয়ে আসছে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। দাদীর নাকের আওয়াজ হাল্কা কানে আসছে। কোনদিন তার কান্না দেখিনি। আজ স্কুল থেকে ফেরার পর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছিলেন তিনি। তার এ কান্নার ভাষা বুঝতে আমার এতটুকু কষ্ট হয়নি। আর তাই তাঁকে কাঁদতে এতটুকু বারন করিনি। এরকম কান্নার খুব প্রয়োজন ছিল । হার্টে অনেক জমানো ময়লা আজ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে গেছে। অনেক বিচক্ষণতার সাথে এত বছর মায়ের সব প্রকার কুচক্রের প্রতিকুলে দাঁড়িয়ে তিনি কোন প্রতিবাদ করেন নি। কেবল মাত্র আমাকে ভালবেসেই আমার মায়ের অনেক অপমান তিনি মুখ বুজে সহ্য করেন। কী অসাধারণ গুনের অধিকারী তিনি ! আমার বাবা প্রচন্ড সহজ, সরল একজন সাধারণ মানুষ । খুবই চাপা স্বভাব তার । সহজে রেগে যান না। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বে বা নৈতিকতাবোধে কেউ আঘাত করলে তিনি এক অন্যরকম মানুষে পরিণত হন। বাবার এ স্বভাব দাদী খুব ভাল করেই অনুধাবন করেন। মায়ের সাথে বাবার যাতে কোনরকম ঝগড়া না হয় তার জন্য তিনি বুকের জমানো সব গ্লানী ঐ অতটুকুন একটা হৃদয় পৃষ্ঠে গর্ত করে সেখানেই কবর দিয়ে রাখেন । দুর্গন্ধ ছড়ানোর আশংকায় তিনি সযত্নে দূষণমুক্ত রাখেন পুরো পরিবেশকে। যতই ভেবেছি ততই অবাক হয়েছি। কতখানি ধৈর্য্য মানুষের থাকলে এমন হতে পারে!

দাদীর মুখে শোনা তাঁর জীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সব ক'টা স্মৃতি হৃদয়ের পরতে পরতে গেঁথে আছে। নিরব এ আঁধার রাতে সেগুলো আবার মনের গহিনে আনদোলিত করে চলেছে। আমার দাদী , শী ইজ গ্রেট ! এ্যান আইডল অব মাই লাইফ । অথচ আমারই গর্ভধারিনী মা ? কত বোকা ! মা অবশ্য নিজেকে আল্ট্রা মডার্ণ , অতি আধুনিকা মনে করেন। অনেকগুলো গিগ্রী অর্জনের গৌরব প্রদর্শন করেন। কিন্তু দাদীর শিক্ষার সামনে তিনি যে কত মুর্খ তা কোনদিন ভেবে দেখেন নি। মায়ের অজ্ঞ চোখ দুটো একদিন খুলবে, এ বিশ্বাস আমার বাবাও করতেন। আমিও করতাম। কিন্তু দুঃখ কেবল এটুকু মা এত লেখা পড়া শিখে কেন নিজে থেকে তা বুঝতে পারলেন না ?

মামলা করার মত বোকামী করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এ ভুল প্রিন্সিপ্যাল স্যার একা করেন নি। মামলা করতে হলে প্রথমেই করতে হয় আমার মায়ের নামে। আর কেউ এটা না বুঝুক, আমি তো বুঝি। এমন দু'জনকে কাঠগড়ায় ওঠাতে হয়, যাদের চোখের দিকে দম্ভের দৃষ্টিতে তাকানোও অন্যায় । আমার এক যুক্তিতে ঘরে বাইরে এ দু'জনের জীবনে যে শিক্ষা্ আজ হয়েছে , সেটিইতো তাদের বিচারের জন্য যথেষ্ট। আর কেন ?

তখন আমি খুব ছোট । এখনো ছবির মত ভেসে ওঠে সে দৃশ্য । প্রথম যেদিন আমার মহৎপ্রাণ বাবা আমার দাদীকে গ্রাম থেকে আমাদের বাসায় এনেছিলেন , সেদিনই আমার মায়ের চোখে দেখেছি সে কি আগুনের জ্বালা ! পারলে তখুনি সে আগুনে আমার বাবাকে জালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেন। নকল সম্মান প্রদর্শন করে দাদীকে তার ঘরে বিশ্রাম নিতে দিয়ে এসে আমাদের বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি তখন স্বরবর্ণগুলো লেখা শেষ করে কেবল 'ক' আর 'খ' লেখা শেষ করেছি। আমার মা সেদিন কী কান্ডটাই না করলেন!

-তাহলে তুমি তোমার জিদ বজায় রাখলে ?

একে তুমি জিদ বলছ কেন ? এ আমার অবশ্য কর্তব্য । এ কর্তব্য থেকে বিরত থাকলে আমার অনেক বড় পাপ হবে। তোমার আপত্তির কারণে আমি নিশ্চই হাসতে হাসতে জাহান্নামের আগুনে ঝাপ দিব না, তেমনি আমাকে ভালবেসে তুমিও নিশ্চই একই কাজ করবে না, কি বল ? ঠিক কি না ?

-রাখ, তোমার লেকচার ? তুমিতো তোমার মাকে নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছ। সময় পেলেই গ্রামে গিয়ে মাকে দেখে আসছ। এটিই তো যথেষ্ট। শহরে এই এতটুকু একটা ফ্ল্যাটে আমাদের নিজেদেরই কত কষ্ট করে থাকতে হয়, তার মধ্যে উনাকে এখানে স্থায়ীভাবে রাখার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক ?

শোন, আমি এ নিয়ে তোমার সাথে কোন কথা বলতে আগ্রহী নই। তোমার যদি ভাল না লাগে , তো খুব সংক্ষেপে সহজ করেই বলছি, দরজা খোলা আছে। তুমি স্বাধীনভাবেই তোমার সিদ্ধান্ত নিতে পার।

- তার মানে ? তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ ? বটে ! এত দম্ভ তোমার ?

এতে দম্ভের কি দেখলে ? আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। আমার মনে হয় আমি তোমার জীবনের কোন চাহিদাই অপূর্ণ রাখিনি। আশা করি মহান আল্লাহ তা'য়ালা আমাকে হায়াতে তয়্যিবা দান করলে ভবিষ্যতেও তার কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। আমিতো তোমার কোন স্বাধীন মতামতকে অসম্মান করিনি, তাহলে তুমি কেন অযাচিতভাবে আমার স্বাধীনতায় অনধিকার হস্তক্ষেপ করছ ? যদি শিষ্টাচার আর ভব্যতার এতটুকুও অবশিষ্ট থেকে থাকে , তাহলে তুমি এ নিয়ে আর একটা কথাও বলবে না। আমি খুব স্পষ্ট করে বলছি শোন, আমার মায়ের জন্য তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তিনি তোমার কষ্টের কোন কারণ হবেন না। কিন্তু আমি যেন উনার মুখ থেকে তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না শুনি। অবশ্য এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, আমার মা তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আমার কাছে তো নয়ই, বরং দুনিয়ার কারো কাছে কোনদিন তুলবেন না। আমি এটা নিশ্চিত জেনেই তোমার এত বিরোধিতা স্বত্বেও এখানে উনাকে নিয়ে এসেছি। আমার মাকে ভালবেসে আমি হয়তো তাঁকে জাহান্নামের অগি্নকুন্ডের উপর বসালাম। কিন্তু এটুকু বিশ্বাস আমার আছে যে, সে আগুনের তাবদাহে আমি যেহেতু তেমন কোন যন্ত্রনা পাইনি, আমার মাও পাবেন না। আমি দেখেছি, তিনি অনেক কঠিন পরীক্ষিত একজন মহিয়সী।

- আমাকে তুমি জাহান্নামের আগুনের সাথে তুলনা করলে ? এত বড় কথা ?

এতে রাগ হবার কি আছে ? তুমি আমাকে এর চেয়ে কঠিনতম ভাষায় কিছু বল না ? কঠিনে কঠিনে কাটাকাটি হয়ে হয়ে যাক।

হুহ , যে গন্ডারের চামড়া তোমার ! কোন অনুভুতি আছে ? এত বলি, তোমার লজ্জা করে না ?

-একটুও করে না। কেন করে না, সে বোধ-শক্তি যদি তোমার থাকতো তাহলে তো কোন সমস্যাই হত না। পৃথিবীটা অন্য রকম হয়ে যেত।

- উহ ! ন্যাকা । কথার যাদুকর । শিখেছ তো খালি গাল ভরা কথা । বুদ্ধি আছে ঘটে ? মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে কিছু ভাবনা চিন্তা আছে তোমার ?

বললাম তো, অকারণে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই।

-তবে, যাই বল, তোমার মায়ের কারণে আমার মেয়ের আচার আচরনে যদি কোনরকম গেঁয়ো প্রভাব পড়ে , তাহলে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।

সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে, কেমন ? এখন তোমার ঠোটের জীপার টেনে দাও, প্লীজ ।

আমার কচি মন, সেদিন থেকেই মায়ের সে আচরণকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। গর্ভধারিনী মা। মাকে তো আর ঘৃণা করতে পারি না। তাই নিরবতা পালন করি। খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া মায়ের সাথে তেমন কথা বলি না। আমার এ আচরণ মায়ের জন্য অনেক বড় আপমানজনক শাস্তি। সে অপমানের সব যন্ত্রণার অগি্নকুন্ডলী নিক্ষেপ করেন আমার সহজ, সরল বাবার উপর। আমার বাবা সব কিছু বুঝে মাকে এড়িয়ে চলেন খুব সুকৌশলে।

প্রায়ই বচসা হতে দেখেছি। মা যত রাগেন, বাবা ততই হাসি ঠাট্টা মিশ্রিত বাক্যবানে মাকে আরো রাগিয়ে তুলতেন। তার পর মুখ টিপে হাসতে হাসতে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যেতেন। সত্যি , আমার বাবার এ এক অসাধারণ গুন। মা-বাবার সে পরিনতিহীন ঝগড়া আমার আজো মনে আছে। উপায় অন্ত না পেয়ে মা সব রাগ ঝাড়তেন আমার দাদীর উপর। এতে দাদী অনেক আহত হন। কিন্তু তিনিও আমার বাবার মত একই ফর্মুলা মেনে চলেন। আর তা হচ্ছে সহজ-সরলতা, নিরবতা এবং সুকৌশলে এড়িয়ে চলা। ব্যাস, মা আর যাবেন কোথায়? নিজেই নিজের চুল ছেড়েন । মায়ের বোকামী দেখে মাঝে মাঝে আমি একাকী চুপটি করে একটু হেসে নেই। এক চিলতে ডিগ্রীর বড়াই করে আমার মা নিজেকে অনেক দামী মানুষ মনে করেন। মা ভাবতেন, দাদী কোন না কোনদিন বাবার কাছে মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে সংসারে তুলকালাম একটা কিছু ঘটিয়ে দিবেন। আর বাবা সংসারের শান্তির স্বার্থে দাদীকে এখান থেকে গ্রামে রেখে আসতে বাধ্য হবেন। কিন্তু মায়ের সব প্রচেষ্টাই আমার দাদী আর বাবার প্রজ্ঞার সামনে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । আমার মা বুঝতেই পারতেন না যে, প্রতিনিয়ত তিনি নিজেকে কতটা মূল্যহীন করে তুলেছেন। আমার দাদী আর বাবার চরিত্রের মান দন্ড এতটাই উঁচু যে সেদিকে চোখ তুলে তাকাবার মত যোগ্যতা আমার মায়ের ছিল না।

আদর্শ শিক্ষা বলতে যা বোঝায়। একজন মুসলমান কন্যা সন্তানের যেভাবে বেড়ে উঠতে হয়, আমার দাদী আমাকে তার জীবনের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে আমাকে বড় হতে সহায়তা করেছেন । তার সমস্ত শিক্ষা-দীক্ষা আমার জীবন নদীতে বিলিন করে দিয়ে আমাকে একজন খাঁটি , সচেতন, সদা জাগ্রত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আমি আমার অবুঝ সময়ের কথা সব কিছু মনে করতে পারি না। তবে যে সব বিশেষ ঘটনা মনে রেখাপাত করেছে, তা ছবির মতই মনে পড়ে। দাদীর সাজানো ফুল বাগিচার কুসুম কলিটা দল মেলে পত্র-পল্লব বেষ্টিত হয়ে প্রথম যখন সুর্যের মুখ নতুন করে দেখার অনুভুতি বুঝতে পেরেছে তখন তাঁর সুনিপুন পরিচর্চায় এত বেশী সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে উঠেছে যে পুরো ফুল বাগিচা অসাধারণ সৌরভে ভরিয়ে গিয়েছে। এতগুলো বছর দুর্গন্ধময় পরিবেশের পাশাপাশি অবস্থান করেও সে সৌরভ এতটুকুও ম্লান হয়ে যায়নি। আমি অবাক হয়ে ভাবি, পুষ্পকলিটা যার পরিচর্যায় নিরাপত্তার বেষ্টনিতে বেড়ে উঠবে সে ছিল একেবারেই উদাসীন । আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম, আমার সে মূল শক্তি এতটাই দুর্বল যে, প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া দূরে থাক, সামান্য বাতাসেও তা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবার কথা। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আমার দাদীকে হায়াত দান করেছেন এবং মায়ের অযোগ্যতার বিষয় অনুধাবন করে আমার বাবা আমার নিরাপত্তার বিষয়টা অনেক আগেই নিশ্চিৎ করেছিলেন।

প্রিন্সিপ্যাল স্যার যেদিন আমার সাথে অস্বাভাবিক আচরণ করে বিতর্কিত হন , সেদিন আমার মা খুব খুশী হয়ে আমার বাবাকে বলেছিলেন,

-দেখলে তো ? তুমো কেবল আমারই দোষ দেখতে পেয়েছ। তোমাদের অজ্ঞতা আর মুর্খতা নিয়ে কি কেবল আমি একাই বলি ? কলেজের প্রিন্সিপ্যালও আজ বলেছেন । তিনি কি কেবলই একজন মাষ্টার ? ভাব তো একবার, কত বড় একজন আর্মী অফিসার ! তিনিও ঠিকই বুঝেছেন। বোঝনি কেবল তোমরা দুই মায়ে-পুতে। আর তোমাদের মুর্খতায় বেড়ে ওঠা মেয়েটা । কি চেয়েছিলাম, আর কি হল ? সবই আমার পোড়া কপাল !

কেন, কি হয়েছে ?

-এই তো, তোমার মেধার দৌড় । সারা দেশ তোল পাড় হয়ে গেল, আর তুমি এর কিছুই জান না ? আমিতো আগেই বলেছিলাম, তোমার মায়ের প্রভাবে মেয়েটা সেই সেকেলে আচার আচরণ অনুকরণ করবে, তাই করেছে তো ?

-আহা ! খুলেই বল না ।

আরে, বাবা, কলেজের নিয়ম কানুন তো মেনে চলতে হবে, তাই না ? এ যুগে সবাই যেভাবে চলে সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলতে শিখতে হয়। সেটাই হচ্ছে আধুনিক শিক্ষা। এ শিক্ষায় যে পিছিয়ে থাকবে সেই হবে এ সমাজের অযোগ্য, অচল । তাই তো হল। সেকেলে যবু-থবু বোরকা পরে স্কুলে যাবার ছবক শিখেছে দাদীর কাছে। এখন দেখ, সে শিক্ষার কি হাল হল !

মুখ টিপে আমি হাসলাম। আমার বাবা এতক্ষন মায়ের এ কথাগুলো যেন হা করে গিলেছেন আর চোখ বড় করে নিজে বোকা হবার ভান করছেন। মায়ের উচ্ছসিত কথা শেষ হলে আমার দিকে একপলক চেয়ে নিজের মুখের হাসিটা দমন করে বললেন,

ও, আচ্ছা । এই কথা ! কী সাংঘাতিক ! তোমার মেয়ের জীবনে এত বড় একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল, অথচ আমি জানতেই পারি নি ? তাইতো বলি, আজ তোমাকে খুব খুশী খুশী লাগছে। মনে হচ্ছে যেন প্রিন্সিপ্যাল ওরফে অত বড় প্রজ্ঞাবান আর্মী অফিসার সাহেব আজ তোমাকে আমার সংসারে বিজয়ী ঘোষণা করে দিয়ে আমাকে একেবারে পরাজয়ের ব্যাকপুটে ফেলে দিয়েছেন । সত্যিই তো, আমি বড় বোকা।

- কিন্তু সেটা বুঝতে তোমার অনেক দেরী হয়ে গেল। মেয়েটার জীবন মাটি করে তবে তোমার জ্ঞান ফিরল।

হ্যা , তা যা বলেছ । যা হবার তা তো হয়েছে, এখন কি করা যায় বল তো ?

- আমি এখন আর কোন কথাই বলব না। তোমাদের যা খুশী তোমরা তাই তাই করবে।

ঠিক ? কোন কথা বলবে না তো ?

- না, আমি কোন কথাই বলব না।

কথা দিলে কিন্তু, আজ থেকে আমরা আমাদের যা খুশী তাই করব, তুমি কোন কথা বলবে না।

ধরা পড়ে যাওয়া মাছটার মত নিজের কথার জালে আটকে পড়ে মা ছট ফট করছেন । বাবা বললেন,

আগামী কাল সকাল দশটায় সনামধন্য প্রিন্সিপ্যালের রুমে তোমার দাওয়াত আছে, সেটা কি তুমি জান ?

-না, আমি তো কোন নিমন্ত্রণ পত্র পাই নি।

আচ্ছা, আমি তাদের পক্ষ থেকে দাওয়াতটা তোমাকে দিলাম ।

-কেন ? কি হয়েছে ?

সেটা ওখানে গেলেই বুঝবে।

মানে ?

মনেটাতো আমি নিজেও জানি না। যেয়ে জানা যাবে , কেমন ?

নামী দামী পত্রিকার রিপোর্টাররা বসে আছেন । আমার মা বাবাকে বসার জন্য দুটো চেয়ার রাখা আছে। পাশে আমাকে বসার জন্যও একটা সীট রাখা হয়েছে। পরিবেশটা বেশ গম্ভীর । প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তার অবস্থান পরিস্কার করলেন,

-দেখুন, বিষয়টা নিয়ে কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী কালার দিচ্ছে। আমি তাকে কেবল প্রতিষ্ঠানের ভেতরে এসে শুধু তার মুখ থেকে নেকাব খুলে রাখতে বলেছি । কারণ সে যে এ কলেজের ছাত্রী, সেটাতো নিশ্চিৎ করতে হবে আমাকে, তাই না ?

কিন্তু এটাতো কম্বাইন্ড স্কুল এন্ড কলেজ। শুধু মেয়েদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। তাহলে আপনি তো তাকে তার নেকাব খুলতে বাধ্য করতে পারেন না।

-মানছি। কিন্তু নেকাব পরিহিত সুইসাইড স্কোয়াডের কোন সদস্য যদি প্রবেশ করে কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তার দায় দায়িত্ব কে বহন করবে ? বলুন ?

এটা কোন যুক্তির কথাই হল না। আপনার স্কুলে মহিলা শিক্ষক আছেন অনেকেই। সেরকম সন্দেহ হলে আপনি অবশ্যই তাদের মাধ্যমে সেটা নিশ্চিৎ করতে পারেন।

- একটা মাত্র মেয়ের জন্য আমাকে এমন বাধ্যতামূলক ডিউটি সিডিউল করতে হবে ?

এটা তার অধীকারের প্রশ্ন। আচ্ছা, আপনার সাথে পরে কথা বলছি।

প্রিন্সি্প্যালের পক্ষে সাফাই গাইতে আর এক সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন,

আচ্ছা, শবনম, আপনি তো আগে শুধু হিজাব পরতেন। আপনার মা বলছিলেন, আপনর দাদীর পরামর্শেই নাকি হঠাৎ করে নেকাব পরা শুরু করেছেন ?

-না। আমার দাদী আমাকে কোনদিন হিজাব পরতে বলেন নি, এমনকি নেকাবও নয়।

দাদীকে পরতে দেখে ইন্সপায়ার্ড , নিশ্চই ?

-না, তাও নয়। আসলে আমি হিজাব পরতাম নিজের ইচ্ছায়। আর সমপ্রতি নেকাব পরতে উৎসাহিত করেছে আমারই এ কলেজের এক সিনিয়র ভাই। আমি তার নাম বলে তাকে ছোট করতে চাই না। তবে তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

একটু খুলে বলবেন কি ?

- হ্যা, বলছি। এ কলেজের একজন ছাত্র প্রায়ই আমার রূপের প্রশংসা করতেন। আমার সমস্ত অবয়ব নিয়ে তিনি নানারকম বিশেষনে এমনভাবে বিশেষায়িত করতেন যে তা শুনে যে কোন মেয়েরই পাগোল হয়ে যাবার কথা। আমি প্রথম দিকে উনাকে অনেকবার সতর্ক করেছি । বিষয়টা নিয়ে যাতে উচ্চ পর্যায়ে যেতে না হয় তার জন্য আমি তাকে অনেকবার সাবধান করেছি। কিন্তু তিনি এমনই নির্লজ্জ যে, কোন নসিহতই তাকে এ বদ অভ্যাস থেকে ফেরাতে পারছিল না। আমি এসব নিয়ে কাউকে কিছু বলিনি। কেননা আমার রুচিতে বাধছিল। আমি জানি, কীট পতংগের হাত থেকে কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হবে । তাই আমার নিজের অস্ত্রই আমি নিজে ব্যবহার করেছি। এটা আমার অধীকার। আমার এ অধীকার থেকে কেউ আমাকে বঞ্চিত করতে পারেন না।

উত্তক্ত করার দায়ে এখন অনেক শাস্তির আইন হয়েছে, আপনি তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে সহায়তা কেন করছেন না?

-কথাটা শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছে । দেখুন, আমি যেটা বুঝি তা হল কোটি কোটি মৌমাছি ধেয়ে আসছে ফুল থেকে মধু আহরনের জন্য । সেটা আইন করে বন্ধ করবেন কিভাবে ?

তাহলে তো মিটেই গেল। আপনি যদি স্বীকার করে নেন, সে কথা, তাহলে মৌমাছিদের আর দোষ কি? এটাতো ন্যাচারালী মেনে নিলেই হয়।

-হ্যা, তা হয়। কিন্তু দু'টি ফুলের পার্থক্য এবং তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আপনাদের অজ্ঞতা দেখে অবাক লাগছে। একটা ফুলকে আল্লাহ বিকশিত করেন কোটি কোটি কীট পতংগের জন্য। যার মূল উদ্দেশ্য প্রজনন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা এবং মহামূল্যবান রোগপ্রতিরোধকারী প্রতিষেধক উৎপাদন করে ব্যাপক মানুষের কল্যান করা। আর একটা ফুল সৃষ্টি করেছেন মাত্র একটি পতংগের জন্য । যার মাধ্যমে আপনাদের মত এরকম বড় বড় জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, সমাজের দর্পন- সাংবাদিক জন্ম হয় তার জন্য । সে ফুলকে যদি কোটি কোটি পতংগদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হত, তাহলে আপনিই বলুন, আপনার পরিচয় কি হত ?

লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল সবার ।

পাশের চেয়ারে উপবিষ্ট মায়ের চোখে চোখ পড়তেই দেখি তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন।

বিষয়: বিবিধ

১৬৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File