আমার বন্ধু মরে গেছে
লিখেছেন লিখেছেন এস এম ইমদাদুল ইসলাম ৩০ মে, ২০১৩, ০৩:৩৪:২২ দুপুর
কয়েকদিন হল মন-মেজাজ মোটেই ভাল যাচ্ছে না। ছেলেদের পাহাড় সমান অভিযোগ আমার প্রতি । সবার বাবারা তাদের ছেলে মেয়েদের আম, লিচু কিনে খাওয়াচ্ছে, কেবল তুমি তোমার ছেলেদের জীবন রক্ষার অযুহাতে এই দু'টো মৌসুমী ফল থেকে আমাদের বঞ্চিত করছ । আসলে তুমি হলে মহা কিপটা । অতি ধুরন্ধর চালাক একজন মানুষ । আমাদের জীবন তোমার কাছে বড় না। তুমি আসলে এগুলোর দাম শুনে ভয় পাও । এ কারণেই কিনতে চাও না। এটা এখন সবাই জানে, কেমিক্যাল মুক্ত ফল-মূল, মাছ, তরি-তরকারী -যে খাবারই বল না কেন, পাওয়া সম্ভব না । তাই বলে মানুষ কি না খেয়ে আছে ? সবাইতো খাচ্ছে । তুমি না হয় আমাদের দুই ভায়ের জন্য ২ টা করে ফল কিনে আনতে ।
দুই ছেলের এ অভিযোগ আমাকে মাথায় পেতে নিতেই হল । কোন যুক্তিতেই ওদের অভিযোগ খন্ডন করা যায় না। আমি যতই যুক্তি দেখাই না কেন, এসব যুক্তি ওরা খন্ডন করে দিয়েছে ।
"সবাই যদি স্বাচ্ছন্দে বিষ খেতে পারে, আমাদের খেতে অসুবিধা কোথায়?
অকাট্ট যুক্তি ।
এ যুক্তি খন্ডন করার দুঃস্বাহস আমার হল না। তাই তাদের কথার কোন জবাব না দিয়ে আমি শুধু এতটুকু আশার কথা শোনালাম,
দেখ বাবারা, আমার উপর অভিমান করে দোমরা এসব ফল কিনতে যেও না। আমি শেষবারের মত চেষ্টা করে দেখি, যা খুজছি তা পাই কি না। যদি ব্যর্থ হই , তাহলে তোমাদের আর বারণ করব না।
আমার এ কথায় খুব একটা সন্তোষ্ট হতে পারল না ওরা । বলল, তুমি খুজতে থাক । দেখবে এই অবকাশে এই ঋতুও বরাবরের মত শেষ হয়ে যাবে ।
আমি আর কোন কথা বললাম না । কেবল মনে মনে বললাম, কষ্ট হোক । তবু আমি চাই তোরা বিষমুক্ত থাক । এগুলো না খেলে কি মরে যাবি ? কিন্তু এসব বিষ খেয়ে কেন অকালে মরতে চাচ্ছিস ?
অনেক ঘুরলাম, আম আর লিচুর বাজারে । দাম আমার নাগালের অ-নে-ক দূরে । তবু ভাবি, দুইটা চারটা করে কিনতে পারব , যা হয় কপালে । এক দোকানে একটু সবুজাভাব ফল দেখে এগিয়ে গেলাম ।
-মুরুব্বী, আপনাকে পুরণ দিনের মানুষ মনে করে অনেকটা ভরসা নিয়ে আসলাম, আচ্ছা, আমাকে কিছু পোকায় খাওয়া আম দিতে পারবেন ?
* নারে , বাফু, মোরডে পোহায় খাউয়া কোন আম নাই । আর রাজশাহীর আমে তো পোহাই থাহে না। দেশাল গুটি আমে থাকতি পারে। তা, বাফু, বেবাক সোন্দর সোন্দর আম থাকতি আমনে পোহায় খাওয়াডা বিছরাইতাছেন ক্যান ?
-এটা আপনাকে বোঝানো যাবে না।
* হোনেন, মুই লেহা ফড়া না হেগলে কি অইবে, তয় মোর মনে অয় আমনে যে ক্যান হেই আম বিছরাইতাছেন হ্যা মোর বোজতে বাহি নাই ।
-সত্যিই কি বুঝেছেন ?
ষাটোর্ধ বয়ষ্ক লোকটা আমার দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসলেন ।
* কি যে কন মনু , চুল কি মোর বাতাসে পাগছে ? হেই পাকিস্থান আমলের থন এই ব্যবসা হইরা খাইতেআছি । আমনের কতা মুই বুজুম না, তয় বুজব কেডায় ?
আমি বুঝলাম, চাচা মিয়া, আমার মনের কথা সত্যিই বুঝেছেন । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, চাচা, এই যে এত মানুষ ব্যাগ ভরে ভরে এত টাকা খরচ করে কিনছে, এরা যদি একটিবার এই ফল খাওয়ার খাওয়ার সময় ভাবত, ফলগুলো শতভাগ পোকামুক্ত হয় কি করে, তাহলে এরা আমার মত পাগলের হয়ে পোকায় খাওয়া ফল খুজত ।
*হোনেন বাফু, আজ থাইক্যা ৩০ বছর আগের একখান ঘটনা আফনেরে কই । এক ভদ্দল্লোহের কাছে পাচ সের আম বেচছালাম । বিয়াল বেলায় দেহি বেডায় ফোসাইতে ফোসাইতে মোর দোহানে আইছে। মোরডে আইয়া আমের ঠোংগাডা থুইয়া মোর জামার কলার ধইরা মোর নাক মুখ পাচাইয়া একটা ঠুস্যা মাইরা মোর নাক মুখ দিয়া রক্ত বাইর হইরা দিছে । চোট পাট কইরা আম গুলান মোর দোহানে ঢাইল্যা দিয়া কইল,
--বেটা চোরের বাচ্চা চোর । ভাল আম লুকাইয়া রাইখা আমারে সব পোকা আম দিছস ?
মুই কতা কমু কি, বেডায় আমারে আবার মাইর দিল । মুইতো ভ্যাবা চ্যাকা খাইয়া কইলাম, আপনেইতো বাইচ্ছা লইলেন, মুই কি আমের মইধ্যে ঢুকছি , মুই ক্যামনে কমু, এইডা পোকায় খাইছে ক্যান ? কেডায় হোনে কার কতা । বেডায় মোরথন জোর হইরা টেহা কয়ডা কাইড়া নিইয়্যা গেল ।
অহন স্যার, আমনেই কন, আম যে আইজকাইল পোহায় খায় না, এইয়্যার জন্যি দায়ি কেডায় ?
আমি চাচার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, মুর্খটারে কি আপনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন ?
হারে বাফু , মোগো কি এইডা কোন জীবন ? মোরা অইলাম -- থাউক গা। মেলা কতা কইয়া ফালাইছি । আমনের লগে কতা কইতে যাইয়্যা মোর বেচা-কিনা চাংগি ওটবেনে, তয় হোনেন, আমনে যা খুজতিছেন, হ্যা, হারা জিন্দেগী সাধনা কইরাও পাইবে না । এইয়্যাই বালা কইরা পানির মধ্যি ভিজাই্য়্যা রাইহা খান, কিছু বিষ কম খাইতে পারবেন ।
--আপনাকে অনেক ধন্যবাদ চাচা , আমি সেটা জানি । তবে আপনি যে সত্য কথাটা বলেছেন, এ জন্য আপনাকে আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি । যার কাছেই কিনতে যাই কিরা-কসম খেয়ে বলে, নেন স্যরি, কেমক্যিাল নাই ।
* বেবাকতেই মিথ্যা কতা কয় ।
--হ্যা, ঠিকই বলেছেন । আচ্ছা, চাচা, আপনারা আম, লিচু খান না ?
* (একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) হা, রে বাফু । খাই । মোগো বাড়ি দেশাল গুটি আম অয়, হেইয়া খাই । না অইলে খাই না। রাজশাহীর আড়তের মালিকরা হুনছি নিজেগো খাওয়ার লাইগা দুই এটটা গাছ আলেদা হইরা কিইন্যা রাহে । হেইডাতে কীট নাশক, কার্বাইড মারে না। হেইডা পোহায় খাইয়া খুইয়্যা যা থাহে, তাই হেরা খায় । আমাগো মত ছুডু ব্যাপারীগো হেইয়াতে পোষাইব না । তাই, খাই না। মনরে কই, না খাইলি তো আর মরুম না। কিন্তু জাইন্যা হুইন্যা, ক্যামনে খাই ?
-- তাহলে অন্য মানুষকে খাওয়াচ্ছেন কেন ?
*দ্যাহেন, বাফু,মুই হত্যি কতা কইয়্যা বেচি । মাইনষেই তো পাগলের লাহান কেনে । কেডায় হোনে কার কতা । এই দ্যাশের কাষ্টমাররাই অইল বেকুফ । হেরা বলদ বইল্যাইতো এই রহুম ব্যবসা চলতেয়াছে ।
--হ্যা, আপনি ঠিকই বলেছেন । কি যে করি, চাচা, বাচ্চারা কিছুতেই এ কথা বশ্বিাস করে না। তাদেরকে কি করে জেনেশুনে এগুলো খাওয়াই , বলুন তো ?
* হোনেন, স্যার আফনেরে মুই এট্টা বুদ্ধি দিই । কাইল বেয়ানে হেই আড়তে আইবেন । চেনেন তো ?
--হ্যা চিনি ।
* ঐ হানে হেই আড়তের মালিকের নামে কিছু মাল কার্বাইড ছাড়া আলেদা হইরা আসে। অইহান থাইকা আফনেরে কিছু দেওন যায় কি না, মালিকরে কইয়া দেখমুনি। মালিকের লগে মোর আলেদা একগুয়া খাতিল আছে । আইয়েন । তয় কীট নাশকের গ্যারান্টি নাই । হেইডা কিছু করার নাইক্যা । বালা কইরা পানির মইধ্যে ৩/৪ ঘন্টা চুবাইয়া রাইহ্যা, খাওয়াইয়েন, তাতে বিষ কিছুডা কইম্যা যাইব । কী আর হরবেন ।
-- হ্যা, চাচা, কী ই বা করার আছে । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । কিন্তু আমারতো বেশী আম কেনার সামর্থ নাই, ২/৩ কেজি বেচবে আমার কাছে?
* কষ্ট অইব, ম্যানেজ হরতি । তয় আইয়েন, দেহুমনে ।
মনের কষ্ট মনে লুকিয়ে বাসায় ফিরছি । আর ভাবছি , আম আর লিচুর পোকা আমার , আমাদের জীবনের কত বড় নিরাপদ বন্ধু ছিল । আজ তারা আমাদের জ্ঞান বুদ্ধির তোড়ে মরে গেছে । আমরা কত বড় পন্ডিতির বড়াই করি । অথচ, পোকাদের মাথায় যে বুদ্ধি আছে , তার কানা কড়ি বুদ্ধি আমাদের মাথায় নাই । যে বিষ পোকায় খেতে ভয় পায়, আমরা তাই খাচ্ছি সব জেনেও ।
বিষয়: বিবিধ
২০৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন