অন্ধকারের গল্প
লিখেছেন লিখেছেন এ,এস,ওসমান ২৩ জুন, ২০১৬, ০৪:১১:৫০ বিকাল
মেয়েটার নাম মাসুমা।বয়স ১৫ হলেও দেখতে শুনতে ভাল আর বলিষ্ট স্বাস্থ্যের জন্য যুবতীই মনে হয়।পাঁচ ভাই-বোনের মর্ধ্যের তিন নাম্বার সে।বাবা নুরু মিয়া রিক্সা চালায় ঢাকা শহরে আর মা রাবেয়া একটা হোটেলে রান্না করে।অভাব-অনটনের সাথে খুব ভাল ভাবেই পরিচিত মাসুমা।পাঁচ ভাই বোনের খাবার যোগার করতে প্রতিনিয়ত হিমসিম খেতে হয় মাসুমার বাবা-মাকে।
নুরু মিয়া-রাবেয়ার বিয়ের পরের বছরের মর্ধ্যেই তাদের কোল জুড়ে আসে তাদের বড় ছেলে আসিফ।কিন্তু দূভার্গ্য বলতে যা বোঝায়,তাদের বড় সন্তানটা প্রতিবন্ধী হিসেবে এই পৃথিবীর আলো দেখে।তার দুই বছর পর তাদের দ্বিতীয় সন্তান রফিকও হয় প্রতিবন্ধী।প্রতিবন্ধী দুই সন্তানকে নিয়ে তাদের কষ্টের সীমা যেন আরো বড় হয়।তৃতীয় সন্তান রাবেয়া যখন সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে পৃথিবীতে আসলো তখন তাদের খুশির অন্ত থাকলো নাহ।পরে দুটো সন্তানও তাদের স্বাভাবিক ভাবেই জন্ম নিয়েছে।তবে স্বাভাবিক সন্তান হওয়ার পরও সংসারে আয়ের বৃদ্ধি না পাওয়ায় তাদের কষ্ট যেন কিছুতেই লাঘব হচ্ছিলো নাহ।
রাতে বাড়ি ফিরে নুরু মিয়া ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রাবেয়াকে বলল,বউ খাবার দে তাড়াতাড়ি।খুব ক্ষুদা লেগেছে আজ।
ক্লান্ত স্বামীর জন্য জন্য রাবেয়া তাড়াতাড়ি খাবার বেড়ে দিতে লাগলো।ডাল,লাউ ভাজি আর ভাত সব একসাথে মাখিয়ে খেতে খেতে নুরু মিয়া বলতে লাগলো,আজ এক সাহেবের সাথে দেখা হইছিল।সাহেব অনেক ভাল।৩০ টাকা রিক্সা ভাড়ায় সাহেব আমারে এমনিতেই ১০টাকা বেশি দিছে।আমি একবারও কই নি ১০ টা টাকা বাড়িয়ে দিতে।১০ টাকা বেশী দিয়ে বলল,তোরা রোদে পুড়ে কষ্ট করিস।রাখ,দশ টাকা বেশী।কোন ঠাণ্ডা ডিংক্স কিনে খাস।
তাই নাকি-রাবেয়া অবাক হয়ে বললো।
সাহেবটা আসলেই ভাল দেখছি।এখনকার বড় লোক গুলো যে কি খারাপ,সেইদিনর হাফিজ ভাই এর ঐ ঘটনায় তার আসল প্রমাণ।ভাড়া নিয়ে বনি-বনা না হওয়ার কারণে নাকি ঐ দিনের সাহেব তার গায়ে হাত তুলেছিল।বেচারার বয়স হয়েছে অনেক।সেদিনের গায়ে হাত তুলাটা বেচারার সহ্য করতে কষ্ট হয়েছে; দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো রাবেয়া।
নারে,এই সাহেবটা ভাল অনেক।এত দিনে রিক্সা চালিয়ে অন্ততপক্ষে এডা তো বুঝতে পারছি কোন মানুষটা ভাল আর কোনডা ঘাড় ত্যাড়া।সাহেবের সাথে আমার আরো কথা হয়েছে।সাহেবের বাড়িতে নাকি অল্প বয়সী একটা কামের বেটি লাগবে।আমি কইছি,আমার দুইডা কাম করার মত বিটি আছে।সাহেব আমাকে তার বাসার ঠিকানা দিসে।ভাবছি মাসুমাকে ওখানে কামে দিমু।ভাল বেতন দেওয়ারও কথা দিছে।
মাসুমাকে কামে দিলে রফিক আর আসিফকে কে দেখবে।ওই তো ওদের দেখাশুনা করে।তার চেয়ে ভাল হয় তুমি ময়না রে কামে দেও।ও তো মোটামুটি সব কামই পারে।ওর কাম করতে সমস্যা হওয়ার কথা নাহ।
নাহ নাহ,ময়না এখনো অনেক ছোট।আর মাসুমা চলে গেলে ময়না'ই ওর ভাইদের দেখাশুনা করবে।একটু গম্ভীর স্বরে স্ত্রীর কথার জবাব দিল নুরু মিয়া।
দেখো,তুমি যা ভাল বুঝো।অসহায় গলায় বললো রাবেয়া।
মাসুমাকে রাবেয়া অন্য যে কোন সন্তানের তুলনায় বেশি ভালবাসে।যখন দুই প্রতিবন্ধী সন্তানের পর মাসুমা জন্ম নিলো তখন রাবেয়া যেন তার কোল জুড়ে লক্ষ্মী পেয়েছিল।তার আগে প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য রাবেয়াকে তার স্বামী আর শ্বশুড় বাড়ির লোকের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল।বাস্তবেই মাসুমা ছিল ঘরের লক্ষ্মী।মায়ের অবর্তমানে ঘরের সব কাজ সে গুছিয়ে রাখে।দুই ভাই এর সেবা যত্ন বা খাওয়ানো সে একধারে করেছে।তাই ঘরের কাজ নিয়ে রাবেয়াকে খুব একটা ভাবতে হত নাহ।যেকারনেই মাসুমাকে রাবেয়া অন্যের বাড়িতে কাজে দিতে বাধা দিচ্ছিল।
নুরু মিয়া মা-মেয়ে উভয়কেই বলে দিয়েছে সামনের সপ্তাহে মাসুমা সাহেবের বাসায় কাজ করবে।মাসুমার কথাটা ভাল না লাগলেও জানে তাকে বাবার কথাই মানতে হবে।তাই সে আর কোন প্রতিবাদ করে নি।বাবা মা কাজে চলে যাওয়ার পর ছোট দুই ভাই বোন বস্তির অন্যান্য বাচ্চার সাথে খেলতে গেছে।মাসুমার জীবনে কখনই এই খেলাধুলা বিষয়ক আনন্দগুলো আসে নি।ঘরের কাজ করে কোন খেলার চিন্তা করলেই দেখা যেত তার মা তাকে আবার নতুন করে কোন কাজ দিত।তাই নিজের ইচ্ছা থাকার পরেও কোন এক অজানা জালে তার ইচ্ছা গুলো সব মারা গেছে।
বস্তির পরোপকারী মহিলা কাজল।বস্তির বড়রা তাকে কাজলা দিদি আর ছোটরা কাজলা চাচী বলে।কারু কোন টাকা পয়সা দরকার হলে সবাই সোজা কাজলা দিদির সাথে যোগাযোগ করে।মাসুমার বাবা-মা অনেক বার তার কাছ হতে টাকা নিয়েছে।মাসুমাকেও চিনে কাজল।একবার কাজল মাসুমার বাবা-মাকে প্রস্তাব দিয়েছিল,সে মাসুমাকে ভাল একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিবে।মাসে মাসে ১৫০০/- টাকাও দিবে।কিন্তু মাসুমার বাবা-মা তাতে রাজি হয়নি।কারণ মেয়েকে নাকি একবার কাজে দিলে সহজে আর দেখা সাক্ষাত হবে নাহ।আর কোন জায়গায় কাজে দিবে সেটাও ভাল করে খুলে বলেছিল না কাজল।তাই নুরু মিয়া তার মেয়েকে তখন কাজে দিতে চায় নি।
মাসুমা অন্যের বাড়িতে কাজ করবে শুনে আজ কাজল মাসুমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
কি রে মাসুমা,ঘরে আসিস নাকি?
কে? কাজলা চাচী নাকি!!!
হ
ঘরে আসো,চাচী।
কি রে তুই নাকি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিস? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো কাজলা দিদি।
হ্যাঁ গো চাচী,বাপে নাকি আমার জন্য কোনখানে কামের ব্যবস্থা করেছে। সামনের সপ্তাহে ওখানে চলে যামু।
তোর বাপ রে আমি আগে একখান ভাল কামের কথা কইছিলাম তখন তোকে আমারে দিলো নাহ আর এখন অন্যের বাড়িতে ঠিকই কামে পাঠাচ্ছে...
কি রে মন খারাপ নাকি?
হ,একটু মনডা খারাপ।তোমাদের সবাইকে ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে।
ঘরের মর্ধ্যে এমন ভাবে বসে থাকলে তো মন খারাপ হবেই।এক কাজ কর তুই,একটু পর আমি এক জায়গায় যামু,তুই রেডি হয়ে নে।তুইও আমার সাথে যাবি।বাহিরে একটু ঘুড়লে ঠিকই ভাল লাগবে।
কিন্তু ঘরে তো এখনো অনেক কাম।ভাইদেরও গোসল দিতে .........
আজ নাহি এই গুলো ময়নাই করবে।তুই রেডি হ তাড়াতাড়ি......
আচ্ছা।তাহলে তুমি ময়নাকে একটু ডেকে আনো আমি এদিকে রেডি হচ্ছি।
ঠিক আছে তুই রেডি হ আমি ময়নারে ডেকে রেডি হয়ে আসছি। এই কথা বলে কাজলা দিদি তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল।
মাসুমা আর কাজলা দিদি একটা মাঝারি আকারের হোটেলে বসে আছে।কিছুক্ষণ পর তাদের টেবিলে একজন লোক এসে বসলো।
লোকটি চোখ রাঙ্গিয়ে দিদি কে বলতে লাগলো,দিদি পাখি তো চখাম।
হ,পাখির দামও কিন্তু বেশী এবার।
টাকা পয়সা নিয়ে তোমার সাথে আমার কোন সমস্যা হয়েছে কোন কাল!!!
চল,বাড়ি চল।তারপর বাকিটা দেখা যাবে।
লোকটার কথা বা কাজলা দিদির কথা কিছুই বুঝলো নাহ মাসুমা।শুধু পথের মর্ধ্যে কাজলা দিদি বললো, এ আমার ভাই হয়। আজ ওর বাড়িতে আমার দাওয়াত।
দুপুরের খাবার খেয়ে মাসুমা ঘরের এককোণ বসে টিভি দেখছে।আর ঘরের অন্য কোনে ওই লোকটা আর কাজলা দিদি কি নিয়ে যেন ফিস ফিস করে আলাপ করছে। হঠাৎ কাজলা দিদি হাসতে হাসতে উঠে রান্না ঘরে চলে গেল।কিছুক্ষন পর এক গ্লাস দুধ হাতে করে এনে মাসুমাকে বললো নে মা , দুধটুকু খেয়ে নে।
চাচী দুধ এখন খেতে ভাল লাগছে নাহ।
আরে খা।এ বয়সে খাবি নাতো কবে খাবি।
বিরক্তকর ভাব নিয়ে মাসুমা দুধটা খেয়ে নিলো।
দুধটা খাওয়ার পর হতেই মাসুমার কেন জানি খুব ঘুম ঘুম ভাব লাগতে লাগলো।
চাচী ঘুম লাগছে বাড়ি চল;ঘুম ঘুম চোখে বলল মাসুমা।
আমার আরও কিছু কাজ আছে , তুই পাশের রুমে যেয়ে ঘুমা।যাওয়ার সময় তোরে ডেকে নিবো নি।
মাসুমা পাশের রুমের বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুম যেন আরও বেশী আঁকরে ধরল।চোখ দুটো বন্ধ হওয়ার ঠিক আগ মূহূর্তে ঐ লোকের উদ্দেশ্যে কাজলা দিদিকে বলতে শুনলো,পাখি রেডি, এবার ট্যাকা দেও আমি বাড়ি যামু....
ঘুম চোখেই মনে হঠাৎ ভয় জেগে উঠলো মাসুমার।তাহলে কি,কাজলা দিদি তাকে একা ফেলেই চলে যাচ্ছে? সে প্রতিবাদ করার জন্য উঠে বসতে চায়লো। কিন্তু কিসের প্রভাবে যেন তার হাত পা সব অবশ হয়ে গেছে।তার দুই চোখে অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো যে অন্ধকার তার সামনের জীবনটাকে পৃথিবীর আপনা মানুষদের কাছ হতে হাজার হাজার মাইল দূরে সরিয়ে দিলো।
বিঃদ্রঃ এভাবেই বর্তমান যুগের মেয়েরা সরল মনে কাউকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হচ্ছে অপর কোন মেয়ের কাছ হতেই।এটা শুধু মাত্র নিম্নবৃত্তের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়।প্রতারিত হচ্ছে মর্ধ্যবৃত্ত বা উচ্চবৃত্তের মেয়েরাও।তার হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার কোন শহরে।যেখান হতে তারা কখনই ফিরে আসতে পারে না।সুতরাং আপনি যার সাথে মিশছেন,তাকে একটু বাজিয়ে নিন নতুবা একটা ছোট ভুলই কাদাতে পারে আপনার সারা জীবন।
বিষয়: বিবিধ
৫৮৩৪ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গল্পটি ভালো লাগলো, ধন্যবাদ।
অনেক দিন পর, স্বাগতম!!!
ধন্যবাদ।
এর মানে ঠিক বুঝলাম নাহ
মাসুমাদের জন্য খুব খারাপ লাগে....।
তবে অপকর্ম রোধকল্পে চেষ্টা চলছে ।
তবে অপকর্ম রোধকল্পে চেষ্টা চলছে ।
খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক।আর এটা রোধ করার জন্য আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে
হম,আপনি ঠিকই বলেছেন।আর এভাবেই এদের কার্যকম পর্যায়বৃত্তের ন্যায় ঘুরতেই থাকবে।
এত দিন পর............
মন্তব্য করতে লগইন করুন