বাংলাদেশে সেকুলারিষ্টদের মূল এজেন্ডা ?

লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ০৬ আগস্ট, ২০১৩, ১২:৩৩:১৫ দুপুর

সেকুলারিজমের আভিধানিক অর্থ পার্থিবতা। অর্থাৎ দুনিয়াবী জীবনের কল্যাণ নিয়ে ভাবা, কাজ-কর্ম করা এবং রাজনীতি করা। এবং সে সাথে অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ভূগোল নির্মাণ করা। সেরূপ পার্থিব স্বার্থচেতনা থেকেই সেকুলারিজমের গর্ভ থেকে জন্ম হয় সমাজতন্ত্র, কম্যিউনিজম, জাতিয়তাবাদসহ নানাবিধ মতবাদের। আর এখানেই সেকুলারিজমের সাথে ইসলামের লড়াই। কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো, শুধু ধর্ম-কর্ম নয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, এমন কি রাষ্ট্র নির্মানের প্রেরণা আসতে হবে পরকালীন জীবনে কল্যাণ লাভের আগ্রহ থেকে। তাই মুসলমানের রাজনীতি, অর্থনীতি বা শিক্ষা-সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাষ্ট্রে ইসলামের প্রতিষ্ঠা কতটুকু বাড়লো এবং মুসলমানের পার্থিব কল্যাণের পাশাপাশি পরকালীন সাফল্যই বা কতটুকু অর্জিত হলো সেগুলো। নিজেদের জন্য যদি সে কল্যাণ অর্জন অসম্ভব হয়ে উঠে তবে অন্য মুসলমান ভাইদের জন্য অন্ততঃ সে মহাকল্যাণটি মনেপ্রাণে আশা করবে। প্রয়োজনে তাদের কল্যাণে কোরবানীও দিবে। এমন এক নিরেট ইসলামি চেতনা থেকেই পশ্চিম বাংলা, বিহার, উত্তর-প্রদেশ, মধ্য-প্রদেশ, বোম্বাই, গুজরাত, রাজস্থান, আসামসহ অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানেরা পাকিস্তানের সমর্থন করেছিল। তারা জানতো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের নিজেদের লাভ হবে না। কিন্তু তারা এটিও জানতো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেলে তাতে প্রচন্ড লাভ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর। এতে জন্ম নিবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের। মুসলিম উম্মাহ তাতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হবে, অন্ততঃ উপমহাদেশে। মুসলিম উম্মাহর এমন এক স্বার্থ চেতনায় তারা এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিল যে, পাকিস্তানের দাবীতে কোলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লি, এলাহাবাদ, পাটনার মত শহরে তারা বিপুল সংখ্যায় রাজপথে নেমে আসে। অথচ তারা জানতো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে এসব শহরে অবস্থিত তাদের পৈত্রিক ঘরবাড়ী, ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে পাকিস্তানের অজানা শহরের ছিন্নমূল উদ্বাস্তুর জীবন গ্রহণ করতে হবে। পাকিস্তান দাবীর প্রতি একাত্ম ঘোষণার কারণেই বিহারের হাজার হাজার মুসলমানদেরকে উগ্র হিন্দুদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। শত শত মুসলিম নারীকে ধর্ষিতও হতে হয়েছে।

কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে ইসলাম কি বলে, কোরআন কি বিধান দেয়, নবীজী (সাঃ) কি শিখিয়ে গেলেন, -সেটি নিয়ে সেকুলারদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। আগ্রহ নেই সেটি জানা নিয়েও। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ভূগোলের নির্মাণে ইসলামের কোন প্রভাবকে তারা মানতে রাজী নয়। ধর্মের কর্মসীমাকে তারা জায়নামাযে সীমিত করতে চায়। এক্ষেত্রে তাদের চেতনা কংগ্রেসী হিন্দুদের খেকে অভিন্ন। এজন্যই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি সেকুলারিষ্টদের কাছে অনাসৃষ্টি মনে হয়েছে। ইসলাম উপমহাদেশের ভূগোল ও রাজনীতি পাল্টাতে এতবড় ভূমিকা রাখবে সেটিকে তারা ভাবতে পারেনি। মেনে নিতেও পারেনি। তাই শুরু থেকেই সেকুলার বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের মিত্র হতে পারেনি। বরং সব সময়ই সুযোগের সন্ধানে ছিল এ দেশটির বিনাশে। তাই শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে বেরিয়ে এসে ১০ই জানুয়ারি সহরোওয়ার্দী ময়দানে যখন বললেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন করার কাজ একাত্তর থেকে নয়, শুরু করেছিলাম সাতচল্লিশ থেকে” তখন তিনি মিথ্যা বলেননি। চিন্তা-চেতনা ও মতবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট, ভৌগলিক সীমান্ত মানে না। তাই কোন মতবাদের অনুসারিগণ শুধু দেশেই নয়, প্রতিবেশী দেশে, এমনকি বহু হাজার মাইল দূরেও সতীর্থ বন্ধু পেয়ে যায়। এজন্যই বাংলাদেশের সেকুলারেরা ঘনিষ্ট বন্ধু পেয়ে যায় ভারতে এবং আরো বহু দেশে। তাদের সাথে গড়ে উঠে তাদের রাজনৈতিক মিত্রতা ও সামরিক সহযোগিতাও। সে মিত্রতাই তাদেরকে ১৯৭১য়ে ভারতীয় সৈনিকদের সাথে একই রণাঙ্গণে হাজির করে এবং সেটি একটি মুসলিম দেশের বিনাশে।

মুসলমান হওয়ার অর্থ, জীবনের প্রতি পদে কোরআনী রোডম্যাপের অনুসরণ। সেটি যেমন নামায-রোযার ক্ষেত্রে, তেমনি রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও আইন-আদালতের ক্ষেত্রে। আল্লাহর কোন বিধানকে কি অমান্য করা যায়? কিন্তু সেকুলারিষ্টগণ ইসলামের এমন পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে রাজী নয়। তারা রাজনীতি-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-আইন-আদালতসহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোকে আল্লাহর বিধানমুক্ত রাখতে চায়। তাদের যুক্তি, এগুলো পার্থিব বিষয়, ধর্ম ও পরকালের ভাবনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তাদের লক্ষ্য, পার্থিব এ ক্ষেত্রগুলোতে নিজেদের নিরংকুশ দখলদারিত্ব। ইসলামপন্থিদের সাথে সেকুলারিষ্টদের মূল বিবাদ এখানেই। বাংলাদেশে এ বিবাদের শুরু পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই। বাংলাদেশের এমন সেকুলার দর্শনের অন্যতম গুরু ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা এবং সে সাথে কলামিষ্ট। সেকুলারিজমের পক্ষে তিনি বহু লিখেছেন। এক সময় তিনি পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য, “যারা ধর্মকে রাজনীতি সাথে একীভূত করতে চায় তারা নতুন কিছু বলে না। মানবসভ্যতার শুরু থেকে দুটোই একীভূত ছিল। যুগের দাবী ও যুগের অভিজ্ঞতা দুটোকে আলাদা করতে শেখায়। মানুষের কল্যাণ ও ধর্মের কল্যাণের স্বার্থেই দুটো পৃথক। -(ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা কীরূপে? দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা ফেব্রেয়ারি ১৯৭০) ধর্ম ও রাজনীতি সভ্যতার শুরু থেকে যে একীভূত ছিল - আবুল মনসুর আহমদের সেটা অজানা ছিল না। তিনি জানতেন, নবীদের আমলেও সেটি ছিল। হযরত দাউদ (আঃ) ও সুলাইমান (আঃ) একাধারে যেমন নবী ছিলেন, তেমনি শাসকও ছিলেন। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) নিজে রাসূল ছিলেন, আবার শাসকও ছিলেন। নবী-জীবনের বড় সূন্নত হল এটি। সাহাবাগণ সে সূন্নতের আজীবন অনুসরণ করে গেছেন। ঈমানদারদের জন্য সর্বকালে ও সর্বস্থানে সেটি অনুকরণীয়। কিন্তু আবুল মনসুর আহমদদের দাবী, ধর্ম ও রাজনীতি -এ দুটোকে অবশ্যই পৃথক করতে হবে। কারণ, যুগের অভিজ্ঞতা নাকি সেটাই শেখায়। তাঁর কাছে যুগের অভিজ্ঞতাই গুরুত্বপূর্ণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিক্ষা নয়। ধর্ম ও রাজনীতির এমন বিভক্তিকে তিনি মানুষের জন্য ও ধর্মের জন্য কল্যাণকর বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নবীগণ রাজনীতি ও ধর্মকে একীভূত করে কোন অকল্যাণটি করেছেন? সে বিবরণ তিনি দেননি। প্রশ্ন হলো, যুগের দাবী ও যুগের অভিজ্ঞতা বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন? যুগ কি নিজে কথা বলতে বা দাবী জানাতে জানে? কোন একটি যুগে বাস করে নানা জাতের ও নানা মতের বিভিন্ন মানুষ। সেখানে পাপাচারি কাফের-মুনাফিক যেমন থাকে, তেমনি ঈমানদার মুসলমানও থাকে। নিছক কাফের বা বেঈমানদের দাবীকে কি যুগের দাবী বলা যায়? তাদের অভিজ্ঞতাকে কি যুগের অভিজ্ঞতা বলতে চান? পাশ্চাত্যের নাস্তিক পাপাচারি বা ভারতের কাফেরগণ যা বলছে আবুল মনসুর আহমদ সেটিকেই যুগের দাবী বলেছেন। তাদের অভিজ্ঞতাকে বলছেন যুগের অভিজ্ঞতা। আর তাদের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে জনাব আবুল মনসুর আহমদ ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে আস্তাকুঁড়ে ফেলতে বলছেন।

সংগৃহীত:

বিষয়: বিবিধ

১৭০৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File