জাস্টিস হারিড জাস্টিস বারিড

লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ০১ আগস্ট, ২০১৩, ০১:৫৭:১৮ রাত



ন্যায় বিচারের প্রসঙ্গ উঠলেই সবার মনে পড়ে যায় এ আপ্তবাক্যটি—জাস্টিস হারিড ইজ জাস্টিস বারিড। এর অর্থ বিচারে তাড়াহুড়ো করলে ন্যায় বিচারকে কবর দেয়া হয়।

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ মামলায় অভিযুক্ত ও দণ্ডিতদের ‘রায় কার্যকর’ করার জন্য আওয়ামী লীগ এবং এর রাজনৈতিক মিত্রদের তাড়াহুড়ো দেখে আশঙ্কা হচ্ছে না জানি এখানেও ‘জাস্টিস বারিড’ হয়।

যুদ্ধাপরাধ মামলায় এখনও কোনো চূড়ান্ত রায় হয়নি। শুধু জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার আপিল শুনানি শেষ হয়েছে। যে কোনো দিন রায় ঘোষণা হতে পারে। আদালতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন আবার দণ্ডিতও হতে পারেন। কেউ জানে না কি হবে। অন্যান্য মামলায় আপিল নিষ্পত্তিতে আরও বহুদিন লাগতে পারে। কিন্তু সরকারের বাঘা বাঘা নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন ঈদের পরই রায় কার্যকর হবে। তারা এটা বলছেন কিসের ভিত্তিতে?

প্রথম কথা হলো, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে দেশ বিদেশের সবাই বলছে ‘কনট্রভার্সিয়াল’ বা বিতর্কিত। বিশ্বের কোনো মানবাধিকার সংগঠন একে বৈধতা দেয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হলেও বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেয়া তো দূরের কথা, বিভিন্ন সময় কড়া সমালোচনা করেছে। অথচ এসব সংগঠন নীতিগত এবং আদর্শিকভাবে জামায়াতের রাজনীতির বিরোধী।

সর্বশেষ অন্তত দুটো ঘটনা ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্যতাকে তলানিতে নিয়ে গেছে। এর একটি স্কাইপ কেলেঙ্কারি, যেখানে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নিজামুল হক মামলা শেষ করার আগেই রায় লেনদেন করেছে বেলজিয়াম প্রবাসী ঘাদানিকের তাত্ত্বিক নেতা আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে। এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ওই বিচারপতি পদত্যাগও করেছেন। এর আগে সুখরঞ্জন বালি অপহরণ ঘটনাও বিচারকে মারাত্মকভাবে কলঙ্কিত করেছে।

এই যখন অবস্থা তখন রায় কার্যকর করা নিয়ে আওয়ামী লীগের এই মাতামাতি জনমনে এই সংশয় সৃষ্টি করেছে, যে কোনো মূল্যে দেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের মূল আদর্শিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করাই তাদের উদ্দেশ্য।

সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান আক্ষেপ করে বলেছেন, যুদ্ধপরাধে বিচার হওয়া দরকার। তাতে কেউ শাস্তি পেতে পারে অথবা নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারে। তা নিয়ে মাথাব্যথা কাম্য নয়।

এসব সুবচনে কান দেয়ার পাত্র মহাজোটের নেতারা নয়। তারা ফাঁসি দিতে বদ্ধপরিকর। তাদের সমর্থনে আছে শাহবাগিরা। যদিও এ সংগঠনটি এখন কার্যত মৃতপ্রায়। তারা ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো সাজা জীবন দিয়ে হলেও প্রতিরোধ করতে চায়।

কথিত যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর হলেই ৪২ বছরের দায় শোধ হবে না। বরং অনেকের কাছে প্রত্যাশিত এ বিচারকে আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রহসনে পরিণত করেছে তার দায় দলটিকে বহন করতে হবে হয়তো আরও ৪২ বছর।

বিতর্কিত রায় কোনো সুফল বয়ে আনে না। জনমনে যখন ধারণা জন্মে যে ন্যায় বিচার হয়েছে আসলে সেটিই ন্যায় বিচার। অপরাধ প্রমাণিত হয়নি অথচ ফাঁসি দেয়া হয়েছে—এমন নজিরও বিরল নয় এ অঞ্চলে।

আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে বলে ফেব্রুয়ারিতে তার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার পর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছে তার পরিবার।

যেমন এতে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালে কাদের মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে অবস্থান করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৪-’৭৫ সালে তিনি ঢাবির প্রাণকেন্দ্রে অবিস্থত উদয়ন উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সরকার তাকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে লক্ষাধিক লোককে গ্রেফতার এবং ৩৭,৪৭১ জনের নামে মামলা করলেও তার নামে একটি জিডিও করা হয়নি। এতে আরও প্রশ্ন করা হয় যে, সাংবাদিক আবু তালিবের খুনি হলে কাদের মোল্লা কীভাবে ১৯৮২-৮৩ সালে অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

পরিবারের পক্ষ থেকে এসব দাবি করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর। এখন পর্যন্ত কেউ এসব দাবি চ্যালেঞ্জ করেনি। আশা করি এখন আপিল আদালত এসব বিষয় বিবেচনা করবেন। মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায় নিয়েও আছে ব্যাপক সমালোচনা। তার ফাঁসির রায় যখন ঘোষণা করা হয় তখন শাহবাগি আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। অনেকেই শাহবাগি আন্দোলন ও সাঈদীর রায়ের মধ্যে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেছেন। দৃশ্যত, সাঈদীর রায় গ্রহণযোগ্য হয়নি বলেই বহু সাধারণ মানুষও ইসলামের এই মহান প্রচারকের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে।

আদালতের হাত অনেক লম্বা। কাজেই রায়ের সমালোচনা করতে হলে বিপদের ঝুঁকি থেকে যায়। প্রতিকার পাওয়ার পথও নেই বললেই চলে। তবে রাস্তাঘাটে মানুষ ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে কী বলে সে কথা আদালতের কানে গেলে হয় তারা উত্তেজিত অথবা লজ্জিত হতেন।

বিচারের নামে অবিচার নতুন কোনো ঘটনা নয় এ অঞ্চলে। আদালত একদেশদর্শী হলে নিরপরাধ মানুষও ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে পারেন।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী নেতা আফজল গুরুকে ভারত ফাঁসি দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলেছিল আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে দুঃখজনকভাবে এরপরই বলা হয়, ‘ওই ঘটনায় বিপুল সংখ্যক হতাহত এবং এতে গোটা জাতি আলোড়িত হয়েছে। সমাজের সম্মিলিত বিবেক সন্তুষ্ট হবে যদি অভিযুক্তকে ফাঁসি দেয়া হয়।’ এরকম বিচার আর যাই হোক কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। অভিযোগ ছিল তিনি তার এক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছেন। আদালত রায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেনি কিন্তু ফাঁসির রায় দেয়। সুপ্রিমকোর্টে শুনানির পর যখন নয় বিচারপতির ৫ জনই ভুট্টোকে খালাস দেয়ার পক্ষে মত দেন তখন প্রধান বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার মুলতবি করেন। এরপর সেই বিচারপতিরা অবসরে গেল নতুন করে শুনানি হয়। তখন ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তার ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়েছিল। এমনকি ফাঁসির আগেও ভুট্টোর শেষ উক্তি ছিল ‘আমি নির্দোষ।’ সেই আদালতকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলে মন্তব্য করেছিল সবাই। ভুট্টোর ওই ফাঁসির মাধ্যমে পাকিস্তান বিশ্ববাসীর সামনে বর্বর হিসেবে পরিচিত পায়।

উইলিয়াম শেক্সপিয়র বলেছেন, শাসকের ইচ্ছা যখন আইনে পরিণত হয় তখন সেটিই হলো আইনহীনতা। ভুট্টোকে ফাঁসি দেয়ার ক্ষেত্রে ঘটেছিল এমন ঘটনাই। সেনাশাসক জিয়াউল হক চেয়েছিলেন ভুট্টোর ফাঁসি—তা তিনি দোষী হোন আর নাইবা হোন। প্রেসিডেন্টের এই ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারেনি বলেই আপিল বিভাগ বলেছিল, প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে ভুট্টোকে ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে পারেন। এ আবেদন সেনাশাসক জিয়াউল হকের কাছে করা হলে তিনি বলেছিলেন, তিনি সেটি হারিয়ে ফেলেছেন। জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসি দিয়েছিলেন বটে, তবে তার করুণ মৃত্যুর কথাও সবার জানা।

আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগকে চরমভাবে রাজনীতিকরণ করেছে বলে দাবি করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর (বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে) এবং অনেক খ্যাতনামা মানবাধিকার সংগঠন। এ অবস্থায় যুদ্ধাপরাধ মামলায় সরকারের রাজনৈতিক এবং আদর্শিক প্রতিপক্ষকে কঠোর শাস্তি দেয়া হলে এবং তড়িঘড়ি করে সেই ‘রায় কার্যকর’ করলেও তা দেশ-বিদেশে অনেকের কছেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

এরই মধ্যে আপিল আদালতে কাদের মোল্লার শুনানি শেষ হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে রায় ঘোষণা হতে পারে। ১ আগস্ট থেকে শুরু হবে বরেণ্য আলেম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল শুনানি। তাকে সেই বিতর্কিত বিশা বালী হত্যা মামলায় ফাঁসি দেয়া হয়েছে। বিশা বালীর ভাই গত নভেম্বরে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অপহৃত সুখরঞ্জন বালী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন—আদালতে তিনি বলতেন যে, মাওলানা সাঈদী তার ভাইকে হত্যা করেনি। অবশ্য তিনি সেই সাক্ষ্য দিতে পারেননি। তার আগেই তাকে প্রথমে অপহরণ এবং পরে ভারতে পাঠিয়ে দেয় নিরাপত্তা বাহিনী। এখনও তিনি কলকাতার কারাগারে বন্দি বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

এ প্রসঙ্গে দুটো নিবন্ধের কথা উল্লেখ করতে চাই। এর একটি ভারতের ভিন্নমতাবলম্বী খ্যাতিমান লেখক অরুন্ধতী রায়ের লেখা, যেটি ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এবং ১২ ফেব্রুয়ারি আমার দেশ-এ নিবন্ধটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ মামলার ঘটনাবলীর সঙ্গে ভারতের আফজাল গুরুর ফাঁসির বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন অনেকে।

অন্যটি আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমানের লেখা। এটি আমার দেশ-এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয় ২২ জুলাই। এই দুটো নিবন্ধের উল্লেখযোগ্য অংশই প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে তুলে ধরা হলো।

অরুন্ধতী রায়ের নিবন্ধ-আফজাল গুরুর ফাঁসি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক (দ্য হ্যাংগিং অব আফজাল গুরু ইজ এ স্টেন অন ইন্ডিয়া’স ডেমোক্র্যাসি)

শনিবার ভারতে বসন্ত এসেছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরই আইন তার নিজস্ব পথ ধরেছে। এদিন প্রাতরাশের কিছুক্ষণ আগেই ভারত সরকার আফজাল গুরুকে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে ফাঁসি দেয়। ২০০১ সালে সংসদ ভবনে হামলার জন্য প্রধান অভিযুক্ত তিনি। ফাঁসির পর তাকে তিহার জেলে দাফন করা হয়েছে। এখানে ১২টি বছর তিনি নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন কাটিয়েছেন।

ফাঁসির কথা আফজালের স্ত্রী ও সন্তানদের অবহিত করা হয়নি। তবে ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব দাবি করেছেন, দু্রত ও রেজিস্ট্রি ডাকের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে অবহিত করে। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের মহাপরিচালককে বলা হয়েছে তারা চিঠিটি পেয়েছে কি-না, তা খুঁজে দেখতে। এ নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে! তারা তো একজন কাশ্মীরি সন্ত্রাসবাদীর পরিবার মাত্র।

আফজালের ফাঁসির পর পুরো ভারতে এক নজিরবিহীন ঐক্য দেখা যায়। বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দল, যেমন কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ডঙ্কা পিটিয়ে আইনের শাসনের উত্সব পালন করেছে। টিভি চ্যানেলগুলো ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ হিসেবে একে চিত্রিত করে আফজালের নানা ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করেছে। উগ্র হিন্দুবাদীরা ফাঁসির উত্সব উদযাপনের জন্য মিষ্টি বিতরণ করেছে এবং যেসব মেয়ে দিল্লিতে প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হয়েছিল, তাদের পিটিয়েছে। এমনকি আফজালের ফাঁসি কার্যকর করার পর টিভির ভাষ্যকার ও রাস্তার জনতা কাপুরুষের মতো উল্লাস করেছে। তারা সম্ভবত ভেতরে ভেতরে বুঝতে পেরেছিল যে, তারা ভয়ঙ্কর কোনো ভুল করছে।

ঘটনাটি কি? ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ৫ সশস্ত্র ব্যক্তি গাড়িবোমা হামলা চালায়। তাদের চ্যালেঞ্জ করা হলে গাড়ি থেকে বের হয়ে তারা গুলিবর্ষণ করে আট নিরাপত্তাকর্মী ও এক মালিকে হত্যা করে। পরে বন্দুকযুদ্ধে হামলাকারী ৫ জনই নিহত হয়।

এরপর আফজাল গুরুকে দিয়ে হামলাকারীদের নাম বলাতে বাধ্য করে পুলিশ। তাদের নাম আমাদের সবারই জানা ছিল। তত্কালীন বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আদভানি বলেছিলেন, তাদের পাকিস্তানিদের মতো দেখায়। সিন্ধুতে জন্ম নেয়া আদভানি তো জানবেনই পাকিস্তানিরা দেখতে কেমন।

শুধু পুলিশি হেফাজতে আফজালের স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করেই (প্রক্রিয়াগত বিষয় লঙ্ঘনের দায়ে যাকে সুপ্রিমকোর্ট পরে বাতিল বলে ঘোষণা করেছিল) বিজেপি সরকার পাকিস্তান থেকে ভারতের হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং পাকিস্তান সীমান্তে ৫ লাখের মতো সৈন্য সমাবেশ করে। এ সময় পারমাণবিক যুদ্ধের হুঙ্কার দেয়া হয়। পাকিস্তান সফরের ওপর সতর্কতা জারি করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ অচলাবস্থা কয়েক মাস বহাল ছিল এবং এতে ভারতের হাজার হাজার কোটি রুপি খরচ হয়েছে।

ওই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এনকাউন্টার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য কুখ্যাত দিল্লি পুলিশ স্পেশাল সেল দাবি করে যে, তারা ঘটনার আসল পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে পেয়েছে। এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর দিল্লি থেকে অধ্যাপক এসএআর গিলানি, কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে শওকত গুরু ও তার চাচাতো ভাই আফজাল গুরুকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর গ্রেফতার করা হয় শওকতের স্ত্রী আফসান গুরুকে।

ভারতীয় গণমাধ্যমে সোত্সাহে পুলিশের ভাষ্যই প্রচার করা হয়। যেমন কয়েকটি শিরোনাম ছিল—‘দিল্লি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকের বাসায় বোমা হামলার পরিকল্পনা’, ‘ভার্সিটির ডন ফিদাইনদের পরিচালক’, ‘অবসর সময়ে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে ফ্রি লেকচার দিতেন ডন’ প্রভৃতি। জিটিভি ১৩ ডিসেম্বরের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। এতে দাবি করা হয়, এটি পুলিশের চার্জশিটের ওপর ভিত্তি করে তৈরি সত্য কাহিনী। প্রশ্ন ওঠে, পুলিশি ভাষ্যই যদি সত্য হবে, তবে আদালত কেন?

তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ও আদভানি প্রকাশ্যে ওই তথ্যচিত্রটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেটি প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অস্বীকৃতি জানায় সুপ্রিমকোর্ট। কোর্টের মন্তব্য গণমাধ্যম বিচারকদের প্রভাবিত করতে পারবে না। গিলানি, শওকত ও আফজালকে একটি দু্রত আদালতে ফাঁসি দেয়ার মাত্র ক’দিন আগে তথ্যচিত্রটি প্রচার করা হয়। তবে হাইকোর্টে খালাস পান গিলানি ও আফসান গুরু। সুপ্রিমকোর্টও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। তবে ২০০৫ সালের ৫ আগস্ট রায়ে সুপ্রিমকোর্ট আফজাল গুরুকে তিনবার যাবজ্জীবন ও দুবার মৃত্যুদণ্ড দেয়।

বিজেপি অবিলম্বে ফাঁসি কার্যকর করার দাবি জানায়। দলটির অন্যতম নির্বাচনী স্লোগান ছিল—দেশ আবি শরমিন্দা হ্যায়, আফজাল আভিভি জিন্দা হ্যায় (বিদ্রূপাত্মক ছন্দে)। এর অর্থ হলো, আফজাল এখনও বেঁচে থাকা আমাদের জাতির জন্য লজ্জা। এই স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার জন্য শুরু হয় মিডিয়া প্রচারণা। বর্তমানে বিজেপির এমপি ও সে সময় পাইওনিয়ার সংবাদপত্রের সম্পাদক চন্দন মিত্র লেখেন, ‘২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে হামলার অন্যতম সন্ত্রাসী ছিলেন আফজাল গুরু। তিনিই প্রথমে নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। নিহত ছয়জনের মধ্যে তিনজনকেই হত্যা করেন আফজাল।’ যদিও পুলিশের চার্জশিটে আফজাল গুরু সম্পর্কে এমন কথা বলা হয়নি। সুপ্রিমকোর্টও তার রায়ে বলে যে, আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে দুঃখজনকভাবে এরপরই বলা হয়, ‘ওই ঘটনায় বিপুলসংখ্যক হতাহত এবং এতে গোটা জাতি আলোড়িত হয়েছে। সমাজের সম্মিলিত বিবেক সন্তুষ্ট হবে, যদি অভিযুক্তকে ফাঁসি দেয়া হয়।’

সংসদ ভবনে হামলার ঘটনায় আমাদের সম্মিলিত বিবেককে কে চিত্রিত করেছে? সংবাদপত্রের তথ্য? টিভির তথ্যচিত্র?

আইনের শাসনের গুণকীর্তন করার আগে চলুন জেনে নিই আসলে কী ঘটেছিল।

যেসব লোক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে উত্সবে মাতোয়ারা, তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, ভারতের আদালত গিলানিকে খালাস ও আফজালকে শাস্তি দেয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিচার স্বচ্ছ হয়েছে।

২০০২ সালের মে মাসে দ্রুত আদালতে বিচার শুরু হয়। তখন বিশ্ব ওয়ান-ইলেভেনের উন্মত্ততায় কাঁপছে। অসময়েই আফগানিস্তানে বিজয় হয়েছে দাবি করে উল্লাস করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারির শেষদিকে গুজরাট রাজ্যে পুলিশ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় মুসলিম নিধন শুরু হয়ে তখনও বিক্ষিপ্তভাবে চলছিল। বাতাসে ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। এ অবস্থায় সংসদ ভবনে হামলার বিচার শুরু হয়। ফৌজদারি মামলার বিচারের ঠিক চরম মুহূর্তে যখন হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টে বিচার চলে, সাক্ষীদের জেরা করা হয়, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়, আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়; কিন্তু তখন তো আর নতুন কোনো প্রমাণ হাজির করা যায় না।

আফজাল গুরুকে এ সময় হাই সিকিউরিটি সেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বন্দি করে রাখা হয়। তার কোনো আইনজীবী ছিল না। আদালত এক জুনিয়র আইনজীবীকে নিয়োগ দিলেও তিনি একটিবারের জন্যও আফজাল গুরুর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেননি। আফজালের সমর্থনে কোনো সাক্ষীকেও হাজির করা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করেননি তিনি। ওই পরিস্থিতিতে কোনো কিছু করার সামর্থ্য নেই বলে মন্তব্য করেন বিচারক।

তারপরও কিছু তথ্য বের হয়ে আসে। কয়েকটি উদাহরণ হলো—গ্রেফতারের সময় জব্দ করা একটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। তবে আইন অনুযায়ী সেগুলো সিলগালা করা হয়নি। বিচারের সময় ফাঁস হয়ে যায় যে, ল্যাপটপের হার্ডডিস্কে গ্রেফতারের পরও হাত দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায়, সংসদ ভবনে প্রবেশের সময় ভুয়া অনুমতিপত্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং আফজাল তার সব তথ্য মুছে ফেলেছেন।

পুলিশ দাবি করেছে, মোবাইল নম্বর দিয়ে হামলাকারীদের সঙ্গে ২০০১ সালের ৪ ডিসেম্বর যোগাযোগ করেছেন আফজাল। তবে রাষ্ট্রপক্ষের কল রেকর্ডে দেখা যায়, সিমটি ২০০১ সালের ৬ নভেম্বরের পর আর চালু ছিল না।

পুলিশ কীভাবে আফজালকে গ্রেফতার করেছিল? পুলিশ বলেছিল, গিলানির সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তবে পুলিশি রেকর্ডে দেখা যায়, গিলানিকে গ্রেফতারের আগেই আফজালকে গ্রেফতার করা হয়। হাইকোর্ট একে স্ববিরোধী বললেও এ নিয়ে আর সামনে আগায়নি।

এভাবে মিথ্যা আর সাজানো তথ্যের পাহাড়ের ওপর ভিত্তি করে প্রমাণ হাজির করা হয়। আদালত এসব বিষয় স্বীকার করলেও পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।

কেউ যদি রহস্যাবৃত সেই সংসদ ভবনে হামলার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চান, তাকে এসব প্রমাণ অনুসরণ করে এগুতে হবে। কেউই এটা করেনি। ফলে ষড়যন্ত্রের আসল হোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি।

আফজাল গুরুর সত্যিকার কাহিনী ও ট্র্যাজেডি শুধু আদালতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, প্রকৃত ঘটনা জানতে হলে কাশ্মীর উপত্যকার ঘটনাবলী জানতে হবে। এটি একটি পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকরণ করা এলাকা। এখানে রয়েছে ভারতের পাঁচ লাখ সৈনিক। প্রতি চারজন বেসামরিক নাগরিকের বিপরীতে একজন সৈন্য! আবু গ্রাইবের আদলে এখানকার আর্মি ক্যাম্প এবং টর্চার কেন্দ্রগুলোই কাশ্মীরিদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের বার্তাবাহক। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে সংগ্রামরত কাশ্মীরিদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে এখন পর্যন্ত ৬৮ হাজার কাশ্মীরিকে (মুসলমানকে) হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ হাজারকে গুম করা হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে আরও অন্তত এক লাখ লোক।

আফজালের হত্যাকাণ্ডটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জেলে যে হাজার হাজার কাশ্মীরিকে হত্যা করা হয়েছে, আফজালের জীবন ও মৃত্যু নিয়েও সেরকম অন্ধ খেলা চলেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানই আফজাল গুরুকে হত্যায় ভূমিকা রেখেছে।

এখন তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আমি আশা করি আমাদের সম্মিলিত বিবেক এখন সন্তুষ্ট হয়েছে। নাকি এখনও আমাদের রক্তের কাপের অর্ধেকটা খালি?

অলিউল্লাহ নোমানের নিবন্ধ—লম্বা হাতের ভয়

দেখিয়ে বিতর্ক এড়ানোর চেষ্টা

যে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে মৃতুদণ্ড বা জেলদণ্ড ঘোষণা করছে এবং লম্বা হাতের হুশিয়ারি দিচ্ছে, তা নিয়ে রয়েছে অনেক বিতর্ক। এই বিতর্ক এড়াবেন কেমন করে! বিদেশি গণমাধ্যমগুলো প্রথম রায় থেকেই আখ্যায়িত করেছে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল হিসেবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ট্রাইব্যুনালকে খেতাব দিয়েছে বিতর্কিত বলে। ট্রাইব্যুনাল আইনের শিরোনাম অনুযায়ী এর টাইটেল হচ্ছে—‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ সংক্ষেপে আইসিটি। মুখে মুখে প্রচারিত নাম হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সরকারি মন্ত্রীদের ভাষায় ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। লোকমুখে বলা হয় যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য এ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের শিরোনাম নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। সোজা বাংলায় যাকে বলা হয়—নামেরই ঠিক নেই।

ট্রাইব্যুনালের শিরোনামে আন্তর্জাতিক অপরাধ বলা হলেও বিচার হচ্ছে দেশে তৈরি একেবারে ভিন্ন একটি আইনে। কারণ বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি দণ্ডবিধি এখানে কার্যকর নয়। দেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনও কার্যকর নয় এ ট্রাইব্যুনালে।

বিভিন্ন নামে অভিহিত এ ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়েও রয়েছে বিতর্কের ঝড়। এই ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে রাজপথে যা ঘটেছে, অতীতে কোনো বিচারের রায় নিয়ে এতটা হৈচৈ ঘটেনি। তবে আগের আওয়ামী জামানায় একটি বিচারকে কেন্দ্র করে সুপ্রিমকোর্টের বিরুদ্ধে মন্ত্রীদের নেতৃত্বে লাঠি মিছিল হয়েছিল। এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতিবাদে শাহবাগে জড়ো হওয়া একশ্রেণীর ইসলামবিদ্বেষীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় এখনও থামেনি।

কোনো বিচারের রায়ের প্রতিবাদে রাজপথে কোনো দেশে কখনও এত লোক জীবন দেয়নি। শুধু ফেব্রুয়ারিতেই একটি রায়কে কেন্দ্র করে প্রতিবাদী ১৭০ জনের বেশি লোক রাজপথে খুন হয়েছেন পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডারদের আক্রমণে। যারা এই প্রতিবাদ করতে বের হয়েছিলেন, তাদের দাবি হচ্ছে—বিচার সঠিক হচ্ছে না। এজন্য প্রতিবাদে রাস্তায় বের হয়ে আসেন তারা। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় তাদের ওপর। শুধু ২৮ ফেবু্রয়ারি পুলিশের গুলিতে খুন হয়েছিল ৮০ জনের বেশি আদম সন্তান। পৃথিবীর কোনো দেশের ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় ঘোষণার পর এরকম খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে অন্তত আমার জানা নেই।

এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এই বিতর্কগুলোর জন্ম দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল নিজে বা সরকার। সরকারের মন্ত্রীরা আগেই বলে দিচ্ছেন রায়ে কী হবে। ট্রাইব্যুনাল গঠন করার পর থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। প্রথম চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সক্রিয় নেতাদের একজন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে গঠন করা গণআদালতের তিনি একজন তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। এ কারণে তার ওপর শুরুতেই অনাস্থা দিয়েছিল আসামিপক্ষ। কারণ যিনি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথিত গণআদালতের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন, তিনি একই ব্যক্তিদের বিচারে নিরপেক্ষ হতে পারেন না। এই যুক্তির ভিত্তিতে অনাস্থা জানিয়েছিল আসামিপক্ষ। এ নিয়ে শুনানির পর দুই বিচারক তার বিবেকের ওপর বিষয়টি ছেড়ে দেন। বিবেকের তাড়নায় তিনি ঘোষণা করলেন দায়িত্ব পালন করে যাবেন। যত অনাস্থাই থাকুক, তিনি দায়িত্ব ছাড়বেন না।

তার আগে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার পরই বিতর্ক ওঠে। এই বিতর্কের কারণে প্রথম তদন্ত কর্মকর্তাকে শুরুতেই পদত্যাগ করতে হয়েছিল। প্রথম তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি রাজাকারদের পক্ষের লোক ছিলেন।

আল্লামা সাঈদীর বিচার চলাকালীন সরকারপক্ষের তালিকাভুক্ত কয়েকজন সাক্ষী উপস্থিত করা হলো না। তাদের নামে তদন্ত কর্মকর্তার জমা দেয়া জবানবন্দিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ নিয়ে বিতর্ক ওঠে। কারণ সাক্ষীর উপস্থিতি ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার জমা দেয়া জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের নজির আগে কোনো বিচারে দেখা যায়নি। সরকার পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালকে জানানো হয়েছিল ৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে অনেকেই নিখোঁজ। কাউকে আবার হাজির করা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এজন্য তদন্ত কর্মকর্তা তাদের নামে যে বক্তব্য সাক্ষ্য হিসেবে জমা দিয়েছেন সেটা গ্রহণের আবেদন জানানো হয়। উভয়পক্ষে এ নিয়ে শুনানি হলো। ট্রাইব্যুনাল ১৫ জনের জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু পরে অনুসন্ধানে দেখা গেল এসব সাক্ষীকে সরকারি সেফ হোমে এনে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন। তাদের মধ্যে কাউকে আবার ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত পৌঁছানো হয়েছিল। প্রসিকিউশনের কক্ষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন অনেকে।

কিন্তু সরকারপক্ষের শিখিয়ে দেয়া সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় তাদের ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। এ বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। কে কত দিন সেফ হোমে ছিলেন সব ডায়রিভুক্ত রয়েছে। পুলিশের নিয়ম অনুযায়ী তা ডায়রিভুক্ত করে রাখা ছিল। সেই ডায়রি নিজেই বড় প্রমাণ। পত্রিকায় ডায়রির সূত্র ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি আমারই লেখা ছিল। কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি সরকার বা প্রসিকিউশনের পক্ষে। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সেফ হোমে কর্তব্যরত থেকে ডায়রিতে স্বাক্ষর করেছেন তাদের নাম এবং ব্যাজ নম্বরও প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। সেই পুলিশ সদস্যদের কেউ প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করলেন না। সেটা আদালতে উপস্থাপন করে ১৫ জনের নামে তদন্ত কর্মকর্তার লেখা জবানবন্দিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হলো।

সেফ হোমের ডায়রি হাজির করা হলো আদালতের সামনে। যাদের নাম প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই পুলিশ সদস্যদের ট্রাইব্যুনাল তলব করল। ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করা হলো। তারা কেউ স্বাক্ষর অস্বীকার করেননি। শুধু প্রসিকিউশন অস্বীকার করল এবং বলল, এ ধরনের কোনো সেফ হোমের অস্তিত্ব নেই। গোলাপবাগের সেফ হোমের জলজ্যান্ত প্রমাণকে অস্বীকার করল প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনাল এ নিয়ে প্রসিকিউশনের কথাই আমলে নিয়ে আদেশ দেয়। কিন্তু আদেশের দিন বিচারক একেএম জহির অনুপস্থিত। পরে জানা গেল তিনি এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। এজন্য তিনি আদেশ দেয়ার সময় অনুপস্থিত থাকেন। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হলো বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ স্ক্যান্ডাল প্রকাশ হওয়ার পর। তিনি স্পষ্ট করলেন, আইনমন্ত্রী ডেকে নিয়ে বিচারক একেএম জহিরের পদত্যাগপত্র রেখে দিয়েছেন। বিচারক ও বিচারের ওপর সরকারি প্রভাব কতটা রয়েছে তা প্রকাশ পায় এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার মাধ্যমে। এ বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল নিজেই। পক্ষ-বিপক্ষের কেউ এ বিতর্কের জন্ম দেয়নি।

শুধু তা-ই নয়, যে ১৫ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বা ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করানো কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল বলে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তাদের দু’জন আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এলেন। এর মধ্যে গণেশ নামে এক হিন্দু ভদ্রলোক আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন। অথচ তিনি ছিলেন সরকারপক্ষের তালিকাভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। অনেক আওয়ামী মিডিয়া তখন শিরোনাম করেছিল—গণেশ উল্টে গেছে।

দ্বিতীয় আরেকজন এলেন সুখরঞ্জন বালি নামে। প্রথম দিন তাকে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত করা হয়। ট্রাইব্যুনাল সেদিন তার সাক্ষ্য নেয়নি। পরের দিন ট্রাইব্যুনালে আবার তাকে উপস্থিত করানোর জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাইব্যুনাল গেটে আইনজীবীর গাড়ি থেকে নামিয়ে অপহরণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ট্রাইব্যুনালকে সেটা জানানো হলো। কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

সরকারপক্ষ যেভাবে বলেছে ট্রাইব্যুনাল সেটাই গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী আদেশ দেয়। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার বিখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে নিশ্চিত হওয়া গেল সুখরঞ্জন বালি সম্পর্কে। এতে বলা হলো সুখরঞ্জন বালিকে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করে ভারতে অনুপ্রবেশ করিয়েছে। তিনি ভারতের কারাগারে রয়েছেন সেটা নিশ্চিত করল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা চাইল মানবাধিকার সংস্থাটি। এ বিতর্ক কিন্তু আসামিপক্ষ জন্ম দেয়নি। সরকার এবং ট্রাইব্যুনাল মিলে এ বিতর্কের সুযোগ করে দিয়েছে।

সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে বিতর্কের ঝড় ওঠে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও তার বন্ধু ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশের পর। এ কথোপকথনে উঠে আসে কীভাবে সরকার ট্রাইব্যুনালকে প্রভাবিত করছে। সাজানো ছকে কীভাবে রায় ঘোষণার প্রস্তুতি রয়েছে। বিভিন্ন আদেশ ও চার্জ গঠনের বিবরণী কীভাবে আহমদ জিয়াউদ্দিন লিখে দিচ্ছেন—সেই বিষয়ও উঠে আসে স্কাইপ কথোপকথনে। সে লিখিত চার্জগুলো আহমেদ জিয়াউদ্দিনের পাঠানো ই-মেইল থেকে উদ্ধার করা হয়। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় এ কথোপকথন ধারাবাহিক ৩ দিন প্রকাশের পর বিচারপতি নাসিম পদত্যাগ করেন। কথোপকথনের সেই প্রতিবেদনগুলো আমারই অনুসন্ধানী লেখা। এই বিতর্কের জন্মও কিন্তু আসামিপক্ষ বা অন্য কেউ দেয়নি। এ বিতর্কের জন্মও দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল নিজে। দুনিয়ার কোনো ট্রাইব্যুনালে বা আদালতে এরকম ঘটনা ঘটেছে এমন নজির নেই। পরিণতিতে আমার দেশ-এর প্রেসে তালা ঝুলানো হলো, সম্পাদককে রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। আমার কপালে জুটেছে নির্বাসন।

এ বিতর্কের ঢেউয়ে ট্রাইব্যুনালের অবস্থা ছিল টালমাটাল। সরকার ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করল। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের লিখে পাঠানো চার্জ গঠনের বিবরণী ও আদালতে পাঠ করা বিবরণী উপস্থাপন করা হলো আল্লামা সাঈদী ও গোলাম আযমের পক্ষ থেকে। সেটা আদালত নাকচ করে দিল। কারণ, অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে শুনানিতে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সুন্দর করে। চমত্কার যুক্তি। সেটা হলো অবৈধ উপায়ে এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। এজন্য গ্রহণ করা নাজায়েজ। বিষয়গুলো সত্য না অসত্য তা নিয়ে অনুসন্ধান বা তদন্তের জন্য কোনো কিছুই করা হলো না। ওই যে ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স।

আহমেদ জিয়াউদ্দিনের লিখে পাঠানো এবং বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের আদালতে পঠিত চার্জেই শেষ পর্যন্ত বিচার সমাপ্ত হলো। এ বিচারে রায় হলো একজনের মৃত্যুদণ্ড এবং আরেকজনের ৯০ বছরের জেল। কেউ যদি এখন বলেন বিদেশ থেকে ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের লিখে পাঠানো চার্জে জেল ও মৃত্যুদণ্ড দিল টাইব্যুনাল, তখন হয়তো ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স বলে তাকে আবার দণ্ড দিতে পারবে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত লম্বা হাতে। সুতরাং একথা বলে আর দণ্ড নিতে চাই না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিতর্কের অবসান হবে কীভাবে। লম্বা হাতের ভয় দেখিয়ে কী বিতর্ক এড়ানো সম্ভব!

...........................................................সূত্র আমার দেশ

বিষয়: বিবিধ

১১৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File