আমি আল্লাহ্‌র দিকে কীভাবে প্রত্যাবর্তন করব ?

লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ৩১ জুলাই, ২০১৩, ১২:৪২:০৬ দুপুর



জানা-অজানা, ছোট-বড়, প্রকাশ্য-গোপন, বুঝে-না বুঝে, ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, দিনে-রাতে আমরা যত পাপ করেছি, যতবার আল্লাহর অবাধ্য হয়েছি, অকৃতজ্ঞ হয়েছি(১) তাতে সামনে যত দূর চোখ যায় শুধু ঘোর অমানিশার অন্ধকারই দেখতে পাই। কখনও মনে হয়- আল্লাহ্‌ যে তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য মৃত্যুর পর চিরসুখের জান্নাত তৈরি করে রেখেছেন, তা কি আর আমাদের মতো মহাপাপীদের জন্য ? আল্লাহ্‌ কি আর আমাদের মতো অকৃতজ্ঞদের কৃপা করবেন ? আমাদের মতো অবাধ্যদের আশার বাণী শোনাবেন? আমাদের অভয় দেবেন ? আমাদের মতো বাড়াবাড়ি করা মানুষদের পাপ ক্ষমা করে দিয়ে ভালো মানুষ হয়ে যাবার সুযোগ দেবেন ?

প্রিয় বন্ধু, এতো সব প্রশ্নের উত্তর পরম দয়ালু আল্লাহ্‌ তাঁর মহিমান্বিত কুর’আনের একটি আয়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

“বল- হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা। আল্লাহ্‌ সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি অতিক্ষমাশীল ও অতিদয়ালু।”(২)

আমার তো অজস্র পাপঃ আল্লাহ্‌ কি আমার মতো পাপীকে ক্ষমা করবেন? লেখাটিতে আপনাদের সাথে আলাপ চলছিল আল্লাহ্‌র কাছ থেকে আমরা কীভাবে আমাদের পাপগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পারি। আমরা তার উত্তর বের করেছিলাম- “তাওবাহ”।হ্যাঁ, বন্ধু আমাদের মতো আত্ম-স্বীকৃত পাপীদের জন্য শুধু একটাই দরজা খোলা রয়েছে­ পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র দিকে প্রত্যাবর্তনের – তাওবাহ।

দিকভ্রান্ত পথিকক সেই তিমির-কালো অমানিশা নিশিতে আলোর পথ দেখাতে জ্বলজ্বল করা জোনাকি যেন তাওবাহ। উত্তাল সমুদ্রে নিঃস্ব নাবিকের প্রাণ-বাঁচানো ভেলা যেন তাওবাহ। তাওবাহ যেন দুর্বার ঘূর্ণিঝড়ে একটি বটবৃক্ষ, দুরারোগ্য কোনো ব্যাধির যেন মহৌষধ। আমরা তো মনঃস্থির করেই ফেলেছি যে আমরা এবার তাওবাহ করেই ফেলব, আল্লাহ্‌র দিকে চলেই আসব, অনেক বিলম্ব হয়েছে আর না। কিন্তু বলি কি বন্ধু, নতুন কিছু একটা জীবনে গ্রহণ করবার আগে সে সম্বন্ধে একটু জেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ না ? আসুন তাহলে তাওবাহ নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক।

তাওবাহ করলে কি আল্লাহ্‌ খুশি হন ?

আমাদের প্রিয় নবী, বিশ্বমানবতার রোল মডেল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে আমাদের এর উত্তর বুঝিয়েছেন।

মনে করুন একটা লোক মরুভূমির মধ্যে দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। হঠাৎ তার উটখানা সেই মরুভূমিতে হারিয়ে গেল। লোকটা পড়ল বিশাল বিপাকে- উট মানে তো শুধু উট নয়, খাদ্য পানীয় তাঁবু বিছানা সবই উটের পিঠে বোঝাই করে রাখা। আর মরুভূমির ফুটন্ত বালুর মধ্যে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছনোর তো প্রশ্নই আসে না। উট আর জীবন সেখানে মোটামুটি সমার্থক। প্রচুর খোঁজাখুজি করেও সেই উটের সন্ধান পেল না সে। নিরাশ হয়ে সে বুঝতে পারল, এ যাত্রা আর ফেরা হবে না, জীবনের শেষটা এই বালুর মধ্যেই হল। এরকম একটা মানসিকতা নিয়ে সে কোন গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল- হয়ত এই শেষ শোয়া ভেবে।

হঠাৎ করে সে চোখ খুলে দেখে- তার সেই প্রাণবাহী উট তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। বেচারা তো সাথে সাথে উটের লাগাম ধরে ফেলল। আনন্দ আর কৃতজ্ঞতার ধাক্কায় তার মুখে কথাই সরছিল না। এর মধ্যেই সে ফস করে বলে বসল- হে আল্লাহ ! তুমি আমার বান্দা, আর আমিই তোমার প্রভু ! মানে অতিরিক্ত আনন্দের চোটে যা হয় আর কি।

আল্লাহর রাসূল বলেছেন- এই যে এই লোকটা তার জীবন ফিরে পেয়ে যেরকম খুশি হল, আল্লাহ তোমাদের তাওবাহ দ্বারা তার চেয়েও বেশি খুশি হন। (৩)

ভাবুন তো বন্ধু, যে মানুষটির জীবনই বিপন্ন হয়ে গিয়েছিল, অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল; সে যখন আবার প্রাণের আশা ফিরে পাবে তার কতটুকু খুশি লাগবে? অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে জীবন পুনরায় ফিরে পেলে আপনি কেমন আনন্দ প্রকাশ করবেন? কতটুকু খুশি হলে একটা মানুষ আল্লাহ্‌কে তার বান্দা বলে ফেলে! নিজেকে আল্লাহ্‌র প্রভু বলে ফেলে আনন্দের আতিশয্যের কোন পর্যায়ে গেলে! আল্লাহ্‌ সে ব্যক্তিটার চেয়েও বেশি খুশি হবেন যদি আমি- আপনি আল্লাহ্‌র কাছে তাওবাহ করি।

আল্লাহ্‌ তাওবাহ করার কেমন সুযোগ দেন ?

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা তার ক্ষমার হাত প্রসারিত করতে থাকবেন, যেন দিনের পাপী ব্যক্তিরা রাতে তাওবাহ করে নিতে পারে। আর তিনি সারাদিন ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতের পাপী ব্যক্তিরা রাতে তাওবা করে নিতে পারে।(৪)

তাহলে কি মানে দাঁড়ালো বন্ধু ? আল্লাহ্‌ দিন-রাত সারাক্ষণই ক্ষমার হাত বিস্তৃত করে বসে আছেন, অফুরন্ত সুযোগ দিয়ে রেখেছেন আমাদের। এখন শুধু সে সুযোগের সদ্ব্যবহারের পালা।

আল্লাহ্‌ কতক্ষণ তাওবাহ কবুল করবেন ?

কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আল্লাহ্‌ ঠিক কতক্ষণ পর্যন্ত তাওবাহ গ্রহণ করবেন। এরকম সংশয় থাকতে পারে- আমি এত এত পাপ করে ফেলেছি, আমার তাওবাহর সুযোগ বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। আল্লাহর রাসূল (সঃ) কিন্তু বলেছেন অন্য কথাঃ

“যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক হতে সূর্যোদয়ের পূর্বে অর্থাৎ কিয়ামতের পূর্বে (তার গুনাহ হতে) তাওবাহ করে, আল্লাহ তায়ালা তার তাওবাহ কবুল করেন।”(৫)

আরেকটি হাদিসে এসেছে-

হজরত আবু আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা থেকে বর্ণিত, রসূল সঃ বলেছেন, “গরগর করে মৃত্যুর লক্ষণ প্রকাশের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহ বান্দার তাওবাহ কবুল করে থাকেন।”(৬)

অর্থাৎ এখনও আমাদের তাওবাহ করার সুযোগ আছে। শুধু সদিচ্ছা প্রয়োজন।

রাসূল (সাঃ) নিজেও কি তাওবাহ করতেন ?

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “হে লোক সকল, তোমরা আল্লাহ্‌র কাছে তাওবাহ কর এবং ক্ষমা চাও। কেননা আমি প্রতি দিন ১০০ বার তাওবাহ করে থাকি।” (৭)

আচ্ছা বন্ধু, রাসূল (সাঃ) এর তো অগ্র-পশ্চাতের সমস্ত পাপ আল্লাহ্‌ মাফ করে দিয়েছিলেন। তিনি পাপ করতেনও না। তাঁর কি তাওবাহ করবার দরকার ছিল। অথচ তিনি নিজেই বলছেন তিনি দিনে ১০০ বার তাওবাহ করতেন। এখানে ১০০ বলতে সংখ্যার আধিক্য বোঝানো হয়েছে। স্বয়ং পাপমুক্ত রাসূলই (সাঃ) যখন এতবার তাওবাহ করতেন, সেখানে আমাদের মতো পাপ- পঙ্কিলতায় হাবুডুবু খাওয়া নাবিকদের কত কোটিবার তাওবাহ করা উচিত ?

অনেকক্ষণ তত্ত্বীয় আলোচনা হল, তাই না বন্ধু ? এবার চলুন আরেকটা গল্প শুনি। সত্য গল্প।

এক পাপী মহিলা তার পাপের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবাহ করেছিলেন এবং আল্লাহর রাসূলের কাছে তার পাপ স্বীকার করেছিলেন। তার কৃতকর্মের জন্য আইন অনুসারে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার মৃত্যুর পর আল্লাহর রাসূল তার জানাযার নামাজ পড়লেন। উমার (রাঃ) এসে রাসূলকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল ! আপনি ব্যাভিচারিণীর জন্য জানাযার নামাজ পড়ছেন ?

আল্লাহর রাসূল প্রত্যুত্তরে বললেন, এই নারী এমন তাওবাহ করেছে যা সত্তর জন মদিনাবাসীর মধ্যে ভাগ করে দিলেও তা তাদের মুক্তির জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত। যে নারী তার নিজের প্রাণকে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করে দেয় তার এরকম তাওবাহ অপেক্ষা উত্তম কাজ তুমি পেয়েছ কি ? (৮)

তাওবাহর নগদ কোনো লাভ আছে কি ?

“সবই বুঝতে পারলাম, তাওবাহ করলে আল্লাহ্‌ অনেক খুশি হবেন, সমস্ত পাপ মাফ করে দেবেন- কিন্তু তাওবাহ এখন আমার কী কাজে আসবে? নগদ কী লাভ দেবে?”–এ ধরণের প্রশ্ন আসতেই পারে। কারণ, আমরা মানুষ, নগদে বিশ্বাসী। নগদ লাভ না পেলে কোনো কাজে অগ্রসর হতে চাই না। আল্লাহ্‌ও আমাদের এ স্বভাবের কথা জানেন। তাই তো তিনি ঘোষণা করলেনঃ

ওহে যারা ঈমান এনেছে !

তোমরা আল্লাহ্‌র কাছে তাওবাহ কর- আন্তরিক তাওবাহ সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলকে তোমাদের থেকে মুছে দেবেন, আর তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে যার তলদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝর্ণাধারা। (৯)

অর্থাৎ তাওবাহকারীর পাপ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়ে তাকে জান্নাত দান করবেন। এর চেয়ে বড় লাভ আর কী হতে পারে বন্ধু ?

কুর’আনের আরেক স্থানে আল্লাহ্‌ তাওবাহর লাভ সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন-

আমি বলেছি – তোমরা তোমাদের রব্বের কাছে ক্ষমা চাও, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল।

(তোমরা তা করলে) তিনি অজস্র ধারায় তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন

তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তানাদি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন। (১০)

বিষয়: বিবিধ

১৬৬২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File