রাজাকারেরা কোন একটি বিশেষ দলের নয় একিই ভাবে মুক্তিযোদ্ধারাও ?

লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ০২ জুন, ২০১৩, ০৪:২৫:০১ বিকাল

কোন একটি চেতনা পরাজিত হলেও তার মৃত্যু ঘটে না। তাই সাতচল্লিশে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনাটি পরাজিত হলেও তা বেঁচেছিল। কায়েদে আজমের মৃত্যূর পর সহরোওয়ার্দী ভারত ছেড়ে পাকিস্তান চলে আসেন। তখন তার চারপাশে ১৯৪৭ য়ের বাঙ্গালীবাদীরা জড় হয়। শুরু হয় ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রও। সেটি মুজিব ১৯৭১ য়ের ৯ই জানুয়ারি পাকিস্তানের জেল থেকে ফিরে সহরোওয়ার্দ্দী উদ্দানে জনসভাতে বলেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশ নির্মাণে কাজ একাত্তরে নয়, সাতচল্লিশ থেকে শুরু করেছিলাম।” ১৯৭১ য়ে সে প্রোজেক্ট বিজয়ী হয়েছিল মাত্র। ফলে মুজিবের কথার মধ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তান ভাঙ্গার অবিরাম ষড়যন্ত্রেরই সত্যতা মেলে। তাই পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে ইয়াহিয়া খানের সামরিক এ্যাকশনের কারণে – একথা যারা বলেন তারা সত্য বলেন না। তবে বলা যায়, পাকিস্তান সরকার সমুহের পুনঃ পুনঃ রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা শত্রুদের সুযোগ করে দেয়।

মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ একটি দলের ছিল না, ছিল একটি চেতনার প্রতিনিধি। তারা ছিল প্রধানত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কম্যিউনিষ্ট পার্টির কর্মী ও এসব দলের ছাত্রসংগঠনেরর সদস্যরা। ছিল বহু নির্দলীয় ব্যক্তিও। একই ভাবে রাজাকারেরা কোন একটি বিশেষ দলের ছিল না। তারা ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি, নেজামে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামি দলের কর্মী ও তাদের ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা। রাজাকারদের দলেও ছিল বহু নির্দলীয় ব্যক্তি। ছিল বহু পীরের মুরীদ। তাদের কাছে পাকিস্তান ছিল স্বপ্নের দেশ। অন্য যে কোন দেশের ন্যায় সে দেশটিতে অনেক সমস্যা ছিল, কিন্তু তারা সে সমস্যার সমাধানে আশাবাদীও ছিল। কিন্তু যে সমস্যাটি সবচেয়ে জটিল ছিল এবং যার সমাধান পাকিস্তানের হাতে ছিল না তা হল বৈদেশিক। সেটি যেমন অর্থনৈতিক ছিল না, তেমনি রাজনৈতিকও ছিল না। তা হলো পাকিস্তানকে মেনে নেয়ায় ভারতের অসম্মতি। ভারতের সে আজন্ম শত্রুতাই পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলছিল। অনেকে বলেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার মূল কারণ, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা। যারা একথা বলেন তারা সেটি বলেন উপমহাদেশের রাজনীতির নিয়ে নিরেট অজ্ঞতা থেকে। তারা ভূলে যান, একাত্তরের ১৬ই মার্চ থেকে ২২ মার্চ অবধি একটি রাজনৈতিক আপোষের লক্ষ্যে শেখ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়া খানের আলোচনার বিষয়টি। ভূলে যান, শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী, ভূট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পরারাষ্ট্রমন্ত্রী করে ইয়াহিয়া একটি আপোষ ফর্মুলা দেন সেটিও। (সূত্রঃ অখন্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলী, জি. ডব্লিও চৌধুরী, ১৯৭৪) ইয়াহিয়া খানের এ প্রস্তাবের কথা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকও এক সাক্ষাতকারে বলেছেন। কিন্তু শেখ মুজিব ক্ষমতা হস্তান্তরের সে প্রস্তাবটিকেও নাচক করে দেন। তিনি দাবী করলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা তার হাতে হস্তান্তর করতে। এর অর্থ, পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করে পূর্বাংশের শাসনক্ষমতাকে তার হাতে তুলে দিতে হবে। শেখ মুজিব তার নিজের ৬ দফাকেও আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেন। ফলে ষড়যন্ত্র করে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি সেটিও নিরেট মিথ্যা তা কি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে ? মুজিবের লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নয় বরং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া। সে জন্যই তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গাকে জরুরী মনে করেন।

কোন দেশের সেনাবাহিনী কি নিজ দেশের বিভক্তিকরণের এমন দাবীকে মেনে নিতে পারে ? পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্বাচিত উপজাতীয় নেতারা যদি শেখ মুজিবের মত বলে, “আমরা এ অঞ্চলের নির্বাচিত প্রতিনিধি, অতএব পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বময় ক্ষমতা আমাদের হাতে হস্তান্তর করতে হবে” তবে কি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সে দাবীর মুখে আনন্দে ডুগডুগী বাজাবে ? তাছাড়া মুজিব নির্বাচিত হয়েছিলেন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে। পাকিস্তান ভাঙ্গার সে দাবী নিয়ে তিনি কোনরূপ গণরায় বা রেফারেন্ডাম নেননি। নির্বাচনী কোন জনসভায় সে কথা তিনি মুখেও আনেননি। তেমন একটি রেফারেন্ডামের প্রস্তাব শেষ দিকে ইয়াহিয়া খানও রেখেছিলেন। তিনি প্রস্তাব রেখেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যদি সত্যসত্যই আলাদা হতে চায় তবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সেটি মেনে নিবে। তবে এজন্য শুধু্ এ বিষয়টির উপর একটি রেফারেন্ডাম হতে হবে। ইয়াহিয়া খানের সে প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানে নবনিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় দূত জয় কুমার অটাল ত্বড়িৎ দিল্লি যান। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধি সে প্রস্তাব মানেননি। (সূত্রঃ অখন্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলী, জি. ডব্লিও চৌধুরী, ১৯৭৪) তখন বাংলাদেশের রাজনীতির সিন্ধান্ত এমনকি আওয়ামী লীগের হাতিও থাকেনি। তখন সেটি শেখ মুজিবের মূল পৃষ্ঠপোষক ভারতের হাতে চলে যায়। ইয়াহিয়া খানের সে প্রস্তাবে ইন্দিরা গান্ধি বলেছিলেন, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ই হল সে রিফারন্ডাম। তার দাবী ছিল, পাকিস্তান সরকারকে সে রেফারেন্ডাম মেনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিতে হবে। অথচ কথাটি সত্য ছিল না। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই বিভিন্ন বিশেষ ইস্যু থাকে। সত্তরের নির্বাচনেও ছিল। ১৯৭০ য়ের নির্বাচনটি হয়েছিল পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরী ও সে শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনকে নিশ্চিত করার বিষয়টি সামনে রেখে। নির্বাচন হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের দেওয়া লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক মেনে নিয়ে। সেখানে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার শর্ত ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতায় অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া। আওয়ামী লীগ সেটি মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। দলটির নির্বাচনী ইশতেহারের কোথাও পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করে পৃথক বাংলাদেশে নির্মাণের সামান্যতম উল্লেখ ছিলনা। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগকে পাকিস্তানের দাবীতে নির্বাচন জিততে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবীতে আওয়ামী লীগ কোন নির্বাচন জিতেনি। বরং সত্তরের নির্বাচনী জনসভাগুলোতে শেখ মুজিব পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়েছেন। অতএব ইন্দিরা গান্ধি কি করে বলেন, সত্তরের নির্বাচনই ছিল সে রেফারেন্ডাম। এটি কি ম্যাকিয়াভিলিয়ান নীতিহীনতা নয় ? আর মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি ছিল এমন এক নীতিহীনতা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুঝতে হলে অপরিহার্য হল, ভারতের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপালনের বিষয়টিকে জানা। ভারতীয় লেখক মি. অশোক রায়নার লিখিত 'Inside R.A.W' বইটি যারা পড়েছেন তাদের কাছে এবিষয়টি অজানা থাকার কথা নয়, ভারতীয় গুপ্তচরেরা একাত্তরের বহু আগে থেকেই পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে লিপ্ত ছিল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা কিভাবে ভারতীয় সামরিক অফিসারদের থেকে প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহয়তা পেয়েছে বইটিতে সে বিবরণও এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে তাই ভারতের প্রতি নিমকহালালীর বিষয়টি অনিবার্য ভাবেই এসে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাত্তরের সেক্টর কমান্ডারদের এত ভারতপ্রীতির মূল কারণ তো এখানেই। এরাই টিপাই মুখ বাঁধ নির্মিত হলে সুরমা-কুশিয়ারায় পানি থৈ থৈ করবে সে গল্প শোনায়। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে সে বাণীও শোনায়। এমন এক অভিন্ন চেতনাতেই শেখ মুজিব সীমান্ত বাণিজ্যের নামে সীমান্ত খুলে দেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীরর বহু হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ভারতের হাতে তুলে দেন। অথচ সে অস্ত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থে কেনা। প্রশ্ন হল, শেখ মুজিব যে পরিমাণ অস্ত্র ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সে পরিমাণ অস্ত্র কি বাংলাদেশ আজও কিনতে পেরেছে ? মুজিব তো তার চার বছরের শাসনামলে একখানি ট্যাংক, একখানি বিমান, এমন কি একখানি কামানও কিনতে পারেননি। এভাবে তিনি অরক্ষিত করেছিলেন বাংলাদেশের সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব। প্রতিরক্ষা এভাবে অরক্ষিত হলে কি সে দেশের স্বাধীনতা থাকে ? কথা হল, স্বাধীনতার চেতনা বলতে শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা কি এর চেয়ে বেশী কিছু বুঝতেন ?

মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকারদের আরেকটি বড় পার্থক্য হল, রাজাকারদের জন্ম তাদের নিজ মাতৃভূমিতে, মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় কোন চিহ্নিত কাফের দেশে নয়। কোন কাফের সরকারের পয়সা ও প্রশিক্ষণেও নয়। ফলে কোন কাফের দেশের প্রতি নিমক হালালীর বিষয়টি রাজাকারের চেতনা রাজ্যে স্থান পায়নি। বরং তারা যে চেতনারটিরই উত্তরসূরী সেটিই ১৯৪৭ সালে তাদের মাতৃভূমিকে আজাদী দিয়েছিল। রাজাকার হওয়ার অর্থ, ইসলামী চেতনার অনুসারি হওয়া এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া। এমন অভিন্ন চেতনার রাজাকারেরাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। রাজাকারের চেতনার মূল বৈশিষ্ট, নিজ ভাষা ও নিজ ভৌগলিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে অন্য ভাষা ও অন্য অঞ্চলের মুসলমানদের সাথে একাত্ম হওয়ার সামর্থ। এ সামর্থ প্রবলভাবে দেখা গিয়েছিল নবীজীর সাহাবী কেরামের মাঝে। সেখানে আরবের আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ), আলী (রাঃ) একাত্ম হতে পেরেছিলেন আফ্রিকার বেলাল (রাঃ), ইরানের সালমান ফারসী (রাঃ) ও রোমের শোয়ায়েব (রাঃ) দের সাথে। ১৯৪৭ য়ে সে চেতনাটিই পরিচর্যা পেয়েছিল ভারতবর্ষে। ফলে করাচীর জিন্নাহ, বাংলার নাযিমুদ্দিন, উত্তর প্রদেশের লিয়াকত আলী খান্ ও সীমান্ত প্রদেশের আব্দুল কাউয়ুম খান তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একত্রে কাজ করার সার্মথ পেয়েছিলেন। ফলে বিজয় এসেছিল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তান নির্মিত হয়েছিল তো তেমন একতার বলেই। নইলে পাকিস্তান নির্মাণ দূরে থাক, বাংলাদেশের মত একটি ছোট্ট দেশের প্রতিষ্ঠাও কি সে সময় সম্ভব হত ? বাংলার পশ্চাদপদ মুসলমানদের পক্ষ্যে কি একাকী সম্ভব হতো স্বাধীনতা অর্জন ?

বিষয়: বিবিধ

১৩৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File