ইতিহাস ও জ্ঞান।

লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ২৪ মে, ২০১৩, ০৭:৩৩:৪৬ সন্ধ্যা

একটি জনগোষ্ঠীর জীবনে অতিগুরুত্বপূর্ণ হল তার ইতিহাস। ইতিহাস-জ্ঞান একটি জাতিকে দেয় প্রজ্ঞা, দেয় দূরদৃষ্টি, দেয় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ। যে জাতি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, সে জাতির ভবিষ্যতের পথ চলাটি সঠিক হয় না, সুখেরও হয় না। পদে পদে ভ্রান্তি হয়। বিশ্বাসঘাতকদের বার বার বন্ধু মনে হয়। জাতির জীবনে তখন পলাশি আসে বার বার। তাই শুধু সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম-শাস্ত্র, কৃষি, বাণিজ্য বা চিকিৎসা-বিজ্ঞানের চর্চা বাড়িয়ে একটি জাতির বাঁচা আদৌ সুখের হয় না। এজন্যই ইতিহাস-বিজ্ঞানকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছরে এবং বাংলাদেশে ইতিহাস-চর্চার সাথে সুবিচার করা হয়নি। গুরুত্বও আরোপ করা হয়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশটিতে অনেকগুলো মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, ইঞ্জিনীয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বহু হাজার স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটের কলসহ শতাধিক কলকারখানা। গড়া হয়েছিল বহু শত রাস্তাঘাট। বাংলাদেশের বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে জ্ঞানচর্চা ও উন্নয়নকর্ম কখনই এতটা হয়নি যতটা হয়েছিল পাকিস্তানের ২৩ বছরে। তবে সে জ্ঞানচর্চায় ভয়ানক অসম্পন্নতা ছিল এবং সেটি ছিল ইতিহাসের জ্ঞানে। সে অসম্পন্নতায় দেশবাসীর অজানা রয়ে গেছে দেশটির নিজের জন্মের ইতিহাস। ভারত ভেঙ্গে কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হল, কেন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ পাশের পশ্চিম বাংলার ন্যায় ভারতে যোগ না দিয়ে হাজার মাইল দূরের পশ্চিম-পাকিস্তানীদের সাথে পাকিস্তানে যোগ দিল –সে প্রেক্ষাপট নিয়ে পাকিস্তানের ২৩ বছরে একখানি বইও লেখা হয়নি। কেন বহু লক্ষ বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে খালি হাতে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিল -সে ইতিহাসও লেখা হয়নি। সভ্য-মানুষেরা পাশের বনজঙ্গলে বাস করা পশু-পাখিরও খবর রাখে। কিন্তু প্রতিবেশী হিন্দুস্থানের মুসলমানদের দুরাবস্থার কথা বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চায় কোন গুরুত্বই পায়নি। ফলে লেখা হয়নি ভারতীয় মুসলমানদের দুর্দশা নিয়ে একখানি বইও। অন্ধ মানুষকে এমনকি শিশুও বিভ্রান্ত করতে পারে। তেমনি ইতিহাসের জ্ঞানে অজ্ঞ-ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বা মন্ত্রী হলেও তাকে যে কোন শত্রু-রাষ্ট্র কলুর বলদ বানাতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কলুর বলদের সংখ্যা কি কম?

বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু প্রশ্নেরই সঠিক জবাব নেই। আছে প্রচন্ড মিথ্যাচার। সত্তরে নির্বাচন হল, কিন্তু নির্বাচনের পর কি কোন রাজনৈতীক নিষ্পত্তির পথ খোলা ছিল না? ভয়ানক যু্দ্ধকে কি এড়ানো যেত না? পাকিস্তান সরকারের সামরিক এ্যাকশনের বহু আগেই ৭ই মার্চের জনসভায় শেখ মুজিব কেন যুদ্ধের ডাক দিলেন? ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রীত্বের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেটি কি মিথ্যা ছিল? তিনিও কি নির্বাচনের আগে ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখবেন সে ওয়াদা দেননি? শেখ মুজিব সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাবটি গ্রহণ না করে কেন শুধু পূর্ব-পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবী জানান? এরূপ নানা প্রশ্ন রয়েছে একাত্তরকে ঘিরে। কিন্তু এসব বিষয় বাংলাদেশের ইতিহাসে যথার্থ আলোচনা হয়নি।

একাত্তরে একটি প্রকান্ড যুদ্ধ ঘটে গেল। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রটি খন্ডিত হল – এ বিষয়গুলো যে কোন ঈমানদারের চেতনায় প্রচন্ড ঝাকুনি দিবে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে ক’জন আন্দোলিত হয়েছে? তাতে ক’জন আঘাত পেয়েছে বাংলাদেশে? গড়ার কাজে নয়, বাংলাদেশের মানুষ ভাঙ্গার কাজকে উৎসবে পরিণত করেছে। ক’জন একাত্তরের সে রক্তাত্ব্ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে? অতীত বলে বিষয়গুলোকে কি আস্তাকুঁড়ে ফেলা যায়? ইতিহাস কি হাতের ময়লা যে তাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলা হবে? ইতিহাসের নির্মাণে লক্ষ লক্ষ মানুষে রক্ত ব্যয় হয়, এতে বহু লক্ষ মানুষের চোখের পানি ঝরে। রক্তক্ষয়ী পরাজয় আসলেও তাতে অমূল্য অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। ইতিহাসের গুরুত্ব তাই বিজয়ীদের চেয়ে পরাজিতদের কাছে আরো বেশী। কারণ সেখান থেকেই তারা পায় আগামী দিনের বিজয়ের শিক্ষা। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমান বা ইসলামপন্থিদের মাঝে সবচেয়ে বড় অনাগ্রহ এই ইতিহাস চর্চা নিয়ে। তারা যেমন একাত্তরের পরাজয় থেকে শিক্ষা নেননি, তেমনি সাতচল্লিশের বিজয় থেকেও নয়। ইসলামপন্থি নেতারা তো ১৯৭১য়ের ইতিহাসকে ভূলতে চান। মন থেকে চান, বাংলাদেশের মানুষও সে ইতিহাস ভূলে যাক। এটিও কি কম আহাম্মকি? একাত্তরের পরাজয়ের সে স্মৃতি নিয়ে তারা ভাবতে চান না। এসব নেতারা এখন ভবিষ্যতের কথা বলেন। অথচ অতীতকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের নির্মাণ কি এতটাই সহজ? এটি এক চরম বিভ্রান্তি। এ বিভ্রান্তি নিয়েই তারা এখন নিজেদের একাত্তরের রাজাকার জীবনের ইতিহাস আস্তাকুঁড়ে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে উৎসবে নেমেছে এবং দূরে ছুঁড়ে ফেলেছে প্যান-ইসলামিক চেতনা। তারা এখন একাত্ম হতে ব্যস্ত হতে জাতীয়তাবাদী শিবিরে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু আলোচিত প্রসঙ্গ হল রাজাকার ও মু্ক্তিযোদ্ধার বিষয়। দু'টি প্রসঙ্গই ছড়িয়ে আছে দেশের ইতিহাস, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, রাজনীতিকের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ও পত্রিকার পাতায়। তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রচুর প্রশংসা হলেও রাজাকারদের নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হয়নি। যা হয়েছে তা নিছক পক্ষপাতদুষ্ট গালিগালাজ। গালিগালাজ কোন দেশেই ভদ্রতার পরিচায়ক নয়, এতে কুৎসিত চরিত্রের পরিচয় মেলে তার যে ব্যক্তি এমন গালিগালাজকে রাজনীতি রূপে গ্রহণ করে। এমন গালিগালাজে রাজাকারদের আসল পরিচয়টি জানা অসম্ভব। অথচ আগামী প্রজন্মের কাছে সে প্রসঙ্গটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটি হল আজকের জ্ঞানীদের দায়বদ্ধতা। কিন্তু সে দায়বদ্ধতা আদৌ পালিত হয়নি। কারা এ রাজাকার? কি ছিল তাদের মিশন? কেন তারা বাঙ্গালী হয়েও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় বিরোধীতা করলো এবং রক্ত দিল? কি ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন? কিসে তারা অনুপ্রাণিত হল? এ প্রশ্নগুলি শুধু আজকে নয়, শত শত বছর পরও বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে গালিগালাজ ছাড়া তাদের নিয়ে বিশেষ কিছুর উল্লেখ নেই। ফলে সে প্রশ্নের উত্তরলাভে কোন পথই খোলা রাখা হয়নি।

একাত্তরের লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয়ের পর তারা শুধু দেশের রাজনীতির উপরই দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেনি, দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের ইতিহাস রচনার ন্যায় এ্যাকাডেমিক বিষয়টির উপরও। ফলে রাজাকারদেরও নিজেদের পক্ষে কিছু বলার থাকতে পারে সেটিরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আসামীর কাঠগড়ায় অভিযুক্ত অপরাধিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনে ইচ্ছামত বলার অনুমতি দেওয়া হয়। দেশের ইতিহাস রচনাতেও সে সুযোগটি রাখতে হয়। বিজয়ী পক্ষের সাথে পরাজিত পক্ষের সঠিক পরিচয়টি দিতে না পারলে ইতিহাস চর্চা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। ইতিহাস তখন পক্ষপাতদুষ্ট হয় এবং বিবেকের আদালতে সেটি গ্রহণযোগ্যতা হারায়। এতে অবিশ্বাস জন্মে সমগ্র ইতিহাসের উপর, তখন পুরা ইতিহাস গিয়ে পড়ে আস্তাকুঁড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে সেটাই ঘটেছে।

এ লেখাটির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় বাংলাদেশের ইতিহাসে যে গভীর শূন্যতা ও পক্ষপাতদুষ্টতা, কিছুটা হলেও সেটি দূর করার লক্ষ্যে। দেশটির ইতিহাসে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা – এ দু'টি শব্দের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে একে অপরের প্রতিপক্ষ রূপে। উভয় পক্ষই একাত্তরে প্রচুর রক্ত দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত দিয়েছে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে। রাজাকারেরা রক্ত দিয়েছে অখন্ড পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাতে। এটি ছিল রাজনীতির দুটি ভিন্ন ধারা ও দু'টি বিপরীত দর্শনের বিষয়। প্রতিদেশেই রাজনীতি নিয়ে এরূপ নানা মত থাকে, নানা প্রতিপক্ষও থাকে। তাদের মাঝে সে মত ও পথ নিয়ে লড়াইও থাকে। দেশের কল্যাণের বিষয়টি নিয়ে সবাই একই ভাবে না। বিপরীত মুখি নানা ভাবনা যেমন ১৯৭১ সালে ছিল, তেমনি ১৯৪৭ সালেও ছিল। আজ যেমন আছে, তেমনি আজ থেকে শত বছর বা হাজার বছর পরও থাকবে। এর মধ্যে কেউ হারবে এবং কেউ জিতবে। ইতিহাসে কারো বিজয়ই চিরস্থায়ী হয় না। দিনবদলের সাথে সরকারেও পরিবর্তন আসবে। কিন্তু প্রতিটি বিজয়ী পক্ষই যদি নিজেদের পছন্দমত ইতিহাস লেখা শুরু করে তবে তাতে দেশে বহুরকমের ইতিহাস রচিত হবে। বাংলাদেশে তেমন ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করেছে একাত্তরের বিজয়ী পক্ষ তথা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। দলীয় উদ্যোগে ইতিহাস রচনার সাথে তাই গুরুত্ব পেয়েছে বিপক্ষদলীয় নেতাদের গায়ে কালিমা লেপনের কাজ। রাজাকারকে চিত্রিত করেছে যুদ্ধাপরাধি রূপে, আর নিজেদেরেক চিত্রিত করেছে ফেরেশতা রূপে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কোন মানুষ খুন হয়েছে বা অন্য কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র বিবরণও নেই। হাজার হাজার বিহারী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে যেন আসমান থেকে বাজ পড়ায়! তাদের ঘরবাড়ি, ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে যেন দূরের কোন ঝড়ো হাওয়ায়! বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নাই।

প্রতিটি মানুষের রাজনীতি, কর্ম ও আচরণ পরিচালিত হয় তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন থেকে। এমনকি অতিশয় দুর্বৃত্তও দুর্বৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পায় জীবন, জগত ও ন্যায়নীতি নিয়ে তার বিশেষ ধ্যান-ধারণা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার সে উৎসটি কি? রাজাকারগণই বা কোত্থেকে পেল সে দূর্দিনে জোয়ারের স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর? বাংলাদেশের ইতিহাসে সে সবেরও উত্তর নেই। বস্তুত এসব নানা প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়েই এ লেখাটির সূত্রপাত।

বিষয়: বিবিধ

১১১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File