রাজাকারদের চেতনার মূল বৈশিষ্ট ?
লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ২৩ মে, ২০১৩, ০৩:৫৫:২৭ দুপুর
রাজাকারের চেতনার মূল বৈশিষ্ট প্যান-ইসলামিজম বা বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। যার মূল কথা ভাষা, বর্ণ, ভৌগলিক সীমারেখার উর্দ্ধে উঠে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ চিন্তায় কাজ করা। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাদের বিবেচনাতেই আসেনি। কোনরূপ গুরুত্বই পায়নি। তাদের কাছে যেটি গুরুত্ব পেয়েছিল সেটি হল ভাষা ও অঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধিতে কাজ করা। তারা এটিকে ফরজ দায়িত্ব রূপে ভেবেছে। তাদের সামনে আদর্শ শেখ মুজিব ছিল না, ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম যাদের শতকরা ৬০ ভাগ রক্ত ব্যয় করেছেন ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী উম্মাহ গড়ায়, নিছক নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত পালনে নয়। ভাষার নামে যুদ্ধ করা ইসলামে ফরজ নয়, নবীজীর সূন্নতও নয়। একাজে প্রাণ দিলে শহীদ হওয়ারও সম্ভাবনাও নাই। তাই নবীজী (সাঃ)র কোন সাহাবী ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে প্রাণ দান দূরে থাক, সামান্য শ্রম, সময় বা অর্থ দান করেছেন সে প্রমাণ নেই। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার নামে মুসলমানদের বহু রাষ্ট্র হয়েছে। কিন্তু তাতে শুধু পরাধীনতা, অপমান আর পরাজয়ই বেড়েছে। গৌরব বা স্বাধীনতা বাড়েনি। ফলে ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণে ভাষা ও ভূগোলের ক্ষুদ্রতা ছেড়ে উর্দ্ধে উঠার বিষয়টি রাজাকারের চেতনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। ১৯৪৭-য়ে এমন একটি দর্শনের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। আর দর্শন তো অমর। ফলে সে দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দেশ মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে প্রয়োজন ফুরিয়ে ফেলবে, সেটি কি কোন মুসলমান মেনে নিতে পারে? ফলে সেটি ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য কম্যিউনিষ্ট, নাস্তিক, বাঙালীবাদী রাজনীতিবিদ, বিদেশের দালাল ও সেকুলারগণ মেনে নিলেও কোন ধর্মপ্রাণ রাজাকার মেনে নিতে পারেনি। মুক্তিযু্দ্ধের চেতনাধারিদের থেকে রাজাকারদের মূল পার্থক্য বস্তুতঃ এখানেই।
বিশ্বে হিন্দুদের বেশী রাষ্ট্র নেই। রাষ্ট্র মাত্র দু'টি। অথচ জনসংখ্যাতে তারা শতকোটি। বাংলার মত প্রায় এক ডজন ভাষা রয়েছে ভারতে। সে ভাষাগুলি নিয়ে ভারতে বাংলাদেশের মত ১০টি বাংলাদেশ নির্মিত হতে পারতো। অথচ তেমন ধারণা তাদের মাথায় ঢুকেনি। ১৯৪৭-য়ে যেমন নয়, আজও নয়। মাত্র একটি রাষ্ট্র গড়ার কারণেই তারা আজ বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু কোরআন পড়তে শেখা নয়, নিছক নামাজ-রোযা পালনও নয়। বরং সেটি ভাষা-বর্ণ-ভৌগলিকতার উর্ধ্বে উঠে অন্য ভাষা, অন্যবর্ণের মুসলমানদের সাথে একাত্ব হয়ে মুসলিম উম্মাহ গড়ার সামর্থ। বিজয় আসে এরূপ একতার পথেই। এমন একতা প্রতিষ্ঠার হুকুম এসেছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। ফলে নামায-রোযা পালনের ন্যায় একতার লক্ষ্যে কাজ করাও ইসলামে ফরজ। বাঙ্গালী মুসলমানদের বড় ব্যর্থতা শুধু এ নয় যে, বিশ্বের ৬শত কোটি মানুষের সবাইকে ছাড়িয়ে দুর্বৃত্তিতে তারা বিশ্বে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বরং বড় ব্যর্থতা হল, অন্যভাষার মুসলমানদেরকে তারা আপন রূপে গ্রহন করতে পারেনি এবং সেটি চরম আকার ধারণ করে একাত্তরে। একতা গড়া কাফেরদের ধর্মীয় দায়িত্ব নয়। অথচ মুসলমানদের উপর একতা গড়া ফরজ। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো কসমোপলিটান হওয়া, তথা নানা ভাষাভাষী মানুষদের নিয়ে সমাজ গড়া। অথচ তারা ইতিহাস গড়েছে Xenophobia তথা ভিন্ন ভাষার মানুষের প্রতি ঘৃণাবোধে। ফলে ভারতের হিন্দুরা যেরূপ ভাষার উর্দ্ধে উঠে ভারতব্যাপী একতা গড়তে পেরেছে বাঙ্গালী মুসলমানরা তা পারেনি। তাই বাংলাদেশে আজও নিগৃহীত হচ্ছে কয়েক লাখ বিহারী। দুরাবস্থায় পড়েছে বার্মা থেকে প্রাণ বাচাতে আসা রোহিঙ্গারা। অথচ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ইতিহাস গড়েছিল রাজাকারেরা। প্যান-ইসলামী চেতনায় পরিপুষ্ট হওয়ার কারণে পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, সিন্ধি মুসলমানগণ তাদের কাছে শত্রু মনে হয়নি। বরং তাদেরকে তারা ভাই হিসাবে গ্রহণ করেছে। তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাকে তারা ঈমানী দায়িত্ব ভেবেছে। এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার যে কোন উদ্যোগকে তারা হারাম মনে করেছে। সেটি শুধু কিশোরগঞ্জের প্রখ্যাত আলেম জনাব আতাহার আলীর একার ঘোষণা ছিল না। ছিল প্রতিটি রাজাকারের। এলক্ষ্যে প্রাণদানকে তারা শাহাদত মনে করতো। অপর দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ইসলামের প্রতি এমন অঙ্গিকার চিত্রিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা রূপে। তাদের চেতনায় গুরুত্ব পেয়েছিল ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণের বিষয়টি এবং আদর্শ রূপে প্রাধান্য পেয়েছিল ভাষাভিত্তিক জাতিয়তাবাদ, সেকুলারিজম ও সমাজতন্ত্র। ফলে গুরুত্ব পেয়েছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের ক্ষতি সাধনে ইসলামের শত্রুদের সাথে কোয়ালিশন গড়াটিও। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারতীয় হিন্দু নেতা ইন্দিরা গান্ধী, শিখ জেনারেল অরোরা, পারসিক জেনারেল মানেক শ', ইহুদী জেনারেল জ্যাকব অতিশয় আপনজন মনে হয়েছে। এবং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এমনকি নিজ দেশ ও নিজ ভাষার মুসলিম হত্যাটিও বীর-সুলভ মনে হয়েছে। হাজার হাজার নিরস্ত্র রাজাকারকে হত্যা করা হয়েছে তো এমন এক চেতনাতেই এবং আজও তেমন একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে।
তবে এমন ভাষাভিত্তিক সেকুলার ধারণাটির জন্ম নিছক একাত্তরে হয়নি। এমন চেতনার প্রবল উপস্থিতি ১৯৪৭য়েও ছিল। সেময় সেটির ধারক ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও চল্লিশের দশকে বেঙ্গল মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা জনাব হোসেন শহীদ সহরোওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। তারা বাংলা ভাষাকে কেন্দ্রকরে একটি ভাষাভিত্তিক সেকুলার নেশন স্টেটের প্রস্তাব রেখেছিল। তাদের সে প্রস্তাব তৎকালীন বেঙ্গল কংগ্রেসের নেতা শরৎ বোস (সুভাষ বোসের ভাই) এবং কিরন সরকার রায়ের সমর্থন পেলেও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতা গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেলের সমর্থন পায়নি। সমর্থন পায়নি মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের থেকেও। তবে তার সুস্পষ্ট কারণও ছিল। কারণ ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের ধারণা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস কারো কাছেই নীতিগত ভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের ধারণাটি ছিল নিছক ইউরোপীয়। তেমন একটি ধারণা ভারতে তখনও বাজার পায়নি। এমনকি যে বাংলা ভাষা নিয়ে এমন একটি চিন্তা শুরু হয়েছিল সেখানেও ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্রের কোন অতীত ঐতিহ্য ছিল না। মোঘল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলিবর্দী খান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তার ভিত্তি কোন ভাষা ছিল না। এমন কি বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পূর্বে সেন রাজাদের শাসনামলেও রাষ্ট্রের ভিত্তি বাংলা ভাষা বা অন্যকোন ভাষা ছিল না। সেন রাজারা এসেছিল দক্ষিণ ভারতের কর্নাটাকা থেকে। তাই স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে অভিনব মনে হয়েছিল। তাছাড়া এমন ধারণা প্রশ্রয় পেলে কংগ্রেসের অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার ধারণাটিই আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়তো। তারা তো তখন স্বপ্ন দেখতো পেশোয়ার থেকে বার্মার পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার। তারা স্বপ্ন দেখছিল হিন্দু ভারতকে বিশ্বশক্তি রূপে দাঁড় করানোর। এজন্যই ১৯৩৫ সালে বৃটিশ সরকার যখন ভারত শাসন আইনে সংস্কার এনে বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করে দেয়, কংগ্রেস নেতৃবিন্দু তাতে খুশি হতে পারেননি। তীব্র ভাষায় তারা ব্রিটিশ সরকারের এ সিদ্ধান্তকে নিন্দা করেছিলেন। তাছাড়া ভাষার উপর ভিত্তি করে স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা মেনে নিলে তেলেগু, মালয়লাম, কানাড়া, পাঞ্জাবী ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী উঠতো। ফলে কংগ্রেস নেতৃবিন্দু তেমন স্বাধীন রাষ্ট্রের নির্মাণে বাধা দিবে সেটি সহজেই বোধগম্য ছিল। অপর দিকে মুসলিম লীগের পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিই ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব ও প্যান-ইসলামিক চেতনা। ভাষাভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের দাবী মেনে নিলে পাকিস্তান দাবীর আর কোন ভিত্তিই থাকে না। ভিত্তি থাকে না ভারত-বিভক্তিরও। হিন্দুরা যেমন বিশ্বশক্তি রূপে আবির্ভাবের স্বপ্ন দেখতো তেমনি এক বিশাল স্বপ্ন দেখতো সে সময়ের পাকিস্তানপন্থি রাজাকারেরাও। সে সময় তেমন একটি স্বপ্ন নিয়েই তারা রাজপথে রাজনৈতিক লড়াই শুরু করেছিলেন। তখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের সে দাবীর প্রচন্ড বিরোধীতা হয়েছিল মুসলিম লীগের পত্রিকা দৈনিক আজাদ ও ইংরেজী সাপ্তাহিক কমরেড পত্রিকার তরুণ বুদ্বিজীবীদের পক্ষ থেকে। ফলে সে পরিকল্পনা সেদিন বিজয়ী হতে পারেনি।
বিষয়: বিবিধ
১৫৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন