রাজাকার এবং মুক্তিযোদ্ধা ?
লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ২২ মে, ২০১৩, ০৭:৩০:১৯ সন্ধ্যা
রাজাকার শব্দটি একটি ফার্সী শব্দ। ফার্সি থেকে এসেছে উর্দুতে। রাজাকার বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা কোন ব্যক্তিস্বার্থে নয়, বরং রাষ্ট্র বা জনগণের কল্যাণে স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে কোন যুদ্ধ বা সমাজ-কল্যাণে অংশ নেয়।
১৯৭১এ বাংলাদেশে দু’টি প্রধান ও প্রবল চেতনা বা দর্শন কাজ করেছিল। একটি হল প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন- এ থেকেই জন্ম নিয়েছিল রাজাকারের চেতনা। অপরটি ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদী দর্শন- মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার মূল উৎস হল এটি। একাত্তরের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষনে এ দু’টি চেতনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে। নইলে বিচারে প্রচন্ড অবিচার হতে বাধ্য। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কর্মে, আচরণে, রুচীবোধে ও রাজনীতিতে যে ব্যাপক পার্থক্য তা তো এই চেতনার পার্থক্যের কারণেই, খাদ্য-পানীয়, শারীরিক বৈশিষ্ট বা জলবায়ুর কারণে নয়। তাই একই রূপ খাদ্যপানীয় ও একই জলবায়ুতে বেড়ে উঠে কেউ রাজাকার হয়েছে এবং কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। ব্যক্তি ক্ষণজন্মা, কিন্তু চেতনা বেঁচে থাকে শত শত বছর। তাই আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন বেঁচে আছে তেমনি বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। এ দু’টি চেতনা ১৯৭১য়ে যেমন ছিল, তেমনি একাত্তরের পূর্বে ১৯৪৭য়েও ছিল। তেমনি বহু শতবছর পরও থাকবে।
চেতনার নির্মাণে যেটি কাজ করে সেটি হল একটি জীবন-দর্শন। আর দর্শন তো বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে। আর তা যদি হয় ইসলামী দর্শন তবে সেটি তো মৃত্যূহীন। ব্যক্তি তার দর্শন থেকেই কর্মে, ত্যাগে ও প্রাণদানে প্রেরণা পায়। রাজাকারের চেতনায় সে দর্শনটি ছিল পবিত্র কোরআনের। একাত্তরে বাংলা ভাষার নামে যখন পৃথক রাষ্ট্রগড়ার যুদ্ধ হচ্ছিল, সে সময় বহু হাজার বাঙ্গালী যুবক পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় প্রাণ দিয়েছে, জেল খেটেছে ও নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে। এবং তাদের ত্যাগের পিছনে কাজ করেছিল বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন। এ দর্শন নির্মূল করে দেয় ভাষা, ভূগোল ও বর্ণভেদের প্রাচীর। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের কাছে যেখানে অবাঙ্গালী মাত্রই ছাতুখোর শত্রু এবং ঘৃণার যোগ্য ও হত্যাযোগ্য, রাজাকারদের কাছে সেটি মনে হয়নি। সাতচল্লিশে যেমন মনে হয়নি, তেমনি একাত্তরেও নয়। আজ যে বহু লক্ষ অবাঙ্গালীকে নিজেদের ঘর থেকে বের করে বস্তিতে বসানো হয়েছে, তাদের ঘরবাড়ী, ব্যবসাবাণিজ্য ও সহায়সম্পদ ঢালাও ভাবে ছিনতাই করা হয়েছে -সেটি তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফল। বিশ্বের কোন সভ্যদেশে এর নজির নেই। কোরআনের দর্শনকে সাম্প্রদায়িকতা বলে মুক্তিযোদ্ধারা আল্লাহর প্রদর্শিত পথকে নিজেদের রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহে কম্পাস রূপে গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ প্রতি কর্মে কোরআনকে অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ। কোরআন ব্যক্তিকে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উপরে উঠতে নির্দেশ দেয় এবং এসব ক্ষুদ্রতার ভিত্তিতে বিভক্তি গড়া ইসলামে ফৌজদারি অপরাধ। ইসলামের সে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের কারণেই মুক্তিযোদ্ধদের হাত থেকে অসহায় অবাঙ্গালী পরিবারদের বাঁচাতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছে রাজাকারেরা এবং এ চেতনাটি ধারাবাহিকতা পেয়েছিল সাতচল্লিশ থেকেই। সে সময় এ চেতনাটির প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে, ভারত থেকে তাড়া খাওয়া অবাঙ্গালীদের জন্য ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের বহুনগরে পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। তখন বাঁধনটি ছিল ঈমানের; ভাষা, বর্ণ বা ভূগোলের নয়। অসহায় অবাঙ্গালীদেরকে বাঁচানোর কাজটিকে তারা পবিত্র ইবাদত মনে করতো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিদের বড় সাফল্য যে, সাতচল্লিশের সে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে তারা পরাজিত করেছে। ফলে সাতচল্লিশের যে চেতনায় কায়েদে আজম, আল্লামা ইকবাল, সলিমুল্লাহ, নাযিমুদ্দীন, লিয়াকত আলী খান, আকরম খানরা শ্রদ্ধেয়জন মনে হত, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এখন আর তা মনে হয় না। একাত্তরের রাজাকারদের সাথে তাঁদেরকে তারা একাকার করে দেখে। কারণটি হল, সাতচল্লিশের নেতৃবৃন্দ ও একাত্তরের রাজাকারেরা যে চেতনায় অভিন্ন -সেটি তারা বুঝতে ভূল করেনি। অভিন্ন ছিল তাদের মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ও রাজনীতি। ফলে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধরা শুধু রাজাকার হত্যাতেই আনন্দ পায়নি, আনন্দ পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে ৪৭-য়ের মুসলিম নেতাদের নাম মুছে ফেলতেও। অন্যদিকে তাদের কাছে অতি আপনজন মনে হয়েছে গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, চিত্তরঞ্জন সুতোর, ম্যানেক শ' ও অরোরা। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হল হয়ে গেছে সূর্য সেন হল। অথচ সাতচল্লিশে বাংলার মানুষ যদি কায়েদে আজম, নাযিমুদ্দীন, লিয়াকত আলী খানদের বাদ দিয়ে গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরামের পথ ধরতো তবে আজকের বাংলাদেশই হত না। কাশ্মীরের মুসলমানদের মত তখন তাদেরও ফিবছর অসংখ্য দাঙ্গার শিকার হতে হত, এবং মুসলিম রমনীদের ধর্ষিত হতে হত। একটি চেতনা যে শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে মানবের মনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা হল তার জ্বলন্ত নমুনা। এ চেতনার ফলেই আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে রাজপথে নামা পাশের বাড়ীর বা পাশের গ্রামের দাড়ী-টুপিধারী বাঙ্গালী যুবকটিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিদের কাছে হত্যাযোগ্য মনে হয়। এজন্য তাকে পাঞ্জাবী বা বিহারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
চেতনা বেঁচে থাকে নতুন প্রজন্মের ধ্যান-ধারণা, কর্ম ও রাজনীতির মাঝে। ফলে ভারতের অর্থ ও অস্ত্রে ভারতীয় সেপাহিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অখন্ড-পাকিস্তানের সমর্থকদের হত্যার যে চেতনা একাত্তরে পরিচর্যা পেয়েছিল সেটি এখনও বেঁচে আছে। বেঁচে আছে এমনকি একাত্তরের বহু পরে জন্ম নেওয়া তরুন সেকুলারিস্টদের মাঝেও এবং তাদের কারণেই আজও প্রবল ভাবে বেঁচে আছে ভারতের সেবাদাস চরিত্রের রাজনীতি। একই প্রক্রিয়ায় বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। আধিপত্যবাদি ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে আজও যে প্রবল প্রতিরোধের লড়াকু জজবা সেটি তো সে অভিন্ন চেতনা থেকেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকৃত লড়াই মূলতঃ এ দু'টি চেতনার। এটি বহু বাংলাদেশী না বুঝলেও ভারত ষোলআনা বুঝে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেবাদাস চরিত্রটি বাঁচাতে ভারত সরকার ও ভারতভক্ত সেকুলার বাংলাদেশীদের এত কসরৎ। বাংলাদেশের শিল্পে কোন বিণিয়োগ না করলে কি হবে, বহু হাজার কোটি টাকা তারা বিণিয়োগ করেছে এ চেতনা বাঁচাতে। অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দলকে তারা বাংলাদেশে রাজনীতি ও সংস্কৃতির ময়দানে নামিয়েছে। শত শত পত্র-পত্রিকা, বহু শত এনজিও, বহু টিভি প্রতিষ্ঠান এক যোগে কাজ করছে এ লক্ষ্যে। বাংলাদেশের সীমান্তে মোতায়েনকৃত ভারতীয় সেনাদের চেয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়োজিত এসব এজেন্টদের সংখ্যা এজন্যই কম নয়। বরং ভারতের পক্ষে মূল যুদ্ধটি লড়ছে তো তারাই। এজন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিপাই মুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের পক্ষে কথা বলতে কোন ভারতীয় লাগে না।
একাত্তরে রাজাকারের চেতনায় যেটি প্রবল ভাবে কাজ করেছিল সেটি হল ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও সামরিক আগ্রাসন থেকে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাঁচানোর প্রেরণা। বিশ্বশক্তি রূপে মুসলমানদের উত্থানে সাধ্যমত ভূমিকা রাখা। ভারত বিপুল সংখ্যক মানুষকে সেদিন বিভ্রান্ত করতে পারলেও রাজাকারদের বিভ্রান্ত করতে পারিনি। ভারতের মুসলিম বিরোধী ভূমিকাকে তারা ১৯৪৭য়ে যেমন দেখেছে, তেমনি ৪৭য়ের পরেও দেখেছে। মুসলমানদের প্রতি ভারতীয় শাসকচক্রের কুকর্মগুলো তারা নিয়মিত দেখেছে সেদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বহু সহস্র সহিংস দাঙ্গায়। সে সব দাঙ্গায় উগ্র হিন্দুদের কাছে প্রচন্ড উৎসব গণ্য হয় মুসলিম হত্যা, নারীধর্ষণ ও লুটপাট। এসব দাঙ্গায় ভারতীয় সরকার ও পুলিশের ভূমিকা হয় নীরব দর্শকের। ফলে হাজার হাজার মুসলমান নিহত ও শত শত মুসলিম নারী ধর্ষিত হলেও ভারতীয় পুলিশ কোনবারেই অপরাধী খুঁজে পায়নি। যেন সেদেশে কোন অপরাধই সংঘটিত হয়নি। একইভাবে সরকারি চাকুরিতে মুসলমানদেরকে বঞ্চিত করাটিও সেদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে একটি স্ট্রাটেজী রূপে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ১৬ ভাগ হলেও সরকারি চাকুরিতে তাদের সংখ্যা দুই ভাগও নয়।
ভারতের শত্রুতা পাকিস্তানের জন্ম থেকেই। দেশটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠারই শুধু বিরোধীতা করেনি, জন্মের পর সব সময় চেষ্টা করেছে দেশটিকে সমূলে বিনাশে। সে শত্রুতা যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিরদ্ধেও। পূর্ব পাকিস্তানকে মরুভূমি করতেই তারা নির্মাণ করেছে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতের আগ্রাসী আচরণটি দেখা গেছে কাশ্মিরে, হায়দারাবাদে ও মানভাদরে। দেখা গেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ ও ১৯৬৫এর যুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনায় কাজ করেছিল এমন আগ্রাসী ভারতকে সাহায্যকারি বন্ধুরূপে গ্রহণ করার প্রেরণা। কিন্তু রাজাকারেরা এমন চিহ্নিত শত্রুপক্ষকে কখনই বন্ধু রূপে গ্রহণ করতে পারেনি। শত্রু রূপে দেখেছে যেমন সাতচল্লিশে, তেমনি একাত্তরেও। ভারতও যে মুসলমানদের কল্যাণে কিছু করতে পারে সেটি তারা বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ, তেমন কল্যাণে আগ্রহ থাকলে সেটির শুরু হওয়া উচিত ছিল ভারতের মুসলমানদের কল্যাণে কিছু করার মধ্য দিয়ে- একটি প্রকান্ড যুদ্ধ, সে যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও একটি রাষ্ট্রের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নয়। আর রাজাকারদের ধারণা যে কতটা সত্য সেটি প্রমাণিত হয়েছিল একাত্তরের পর।
একাত্তরে দুই বিরোধী শিবিরেই সেদিন লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী জীবনের ঝুকি নিয়ে রণাঙ্গনে নেমেছিল। অথচ এমন একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কাউকেই কেউ বাধ্য করেনি। উভয় পক্ষই পরিচালিত হয়েছে নিজ নিজ জীবনদর্শন ও চেতনার বল থেকে। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন স্বেচ্ছায় ভারতে গেছে এবং তাদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানের ধ্বংস ও পাকিস্তানীদের নিধনে যুদ্ধে নেমেছে তেমনি লক্ষাধিক বাঙ্গালী যুবকও স্বেচ্ছায় পাকিস্তান বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছে। রাজাকার শব্দটি একটি ফার্সী শব্দ। ফার্সি থেকে এসেছে উর্দুতে। রাজাকার বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা কোন ব্যক্তিস্বার্থে নয়, বরং রাষ্ট্র বা জনগণের কল্যাণে স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে কোন যুদ্ধ বা সমাজ-কল্যাণে অংশ নেয়। একাত্তরে তাদের সে মিশনটি ছিল, ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর। পাকিস্তানে অবিচার ছিল, বঞ্চনা ছিল, জুলুমও ছিল। রাজনৈতিক অনাচারও ছিল। তবে সমাধান যে ছিল না তা নয়। দেহের যক্ষা বা ম্যালেরিয়া সারাতেও সময় লাগে। বহু দেশে এমন সমস্যা কয়েক যুগ ধরে চলে। যেমন পাকিস্তানের বয়সের চেয়ে অধিক কাল ধরে চলছে ইংল্যান্ডে আয়ারল্যান্ডের সমস্যা। কয়েক যুগ ধরে চলছে সূদানের দারফোরের সমস্যা। ভারত কাশ্মিরের সমস্যা বিগত ৬০ বছরেও সমাধান করতে পারেনি। অথচ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার যে অভিযোগ সেটির অস্তিত্ব মার্চের ১৯৭০-য়ের মার্চের একমাস আগেও ছিল না। এমন একটি অভিযোগ পাশ্ববর্তী মায়ানমারে দেড় দশক ধরে চলছে। সেদেশের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী অং সাঙ সূচীর হাতে সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাকে গৃহবন্দী করে রেখেছে। কিন্তু তার জন্য কি দেশে গৃহযুদ্ধ নেমে এসেছে ? বরং ভারত সে দেশের সামরিক জান্তার সাথে সদ্ভাব বজায় রেখেছে এবং পুরাদস্তুর বাণিজ্যও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও তার দোসররা নির্বাচন পরবর্তী সে সমস্যার সমাধানে পাকিস্তানকে আদৌ সময় দিতে রাজী ছিল না। সেটিকে বাহানা বানিয়ে দেশটির বিনাশে হাত দেয়। এটি ছিল অন্যদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে অতিশয় ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
দেশ বাঁচলেই দেশের রাজনীতি বাঁচে। একাত্তরে ইস্যু ছিল চিহ্নিত শত্রুর হামলা থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটিকে বাঁচানোর দায়বদ্ধতা। তখন এমন দায়ব্ধতা থেকেই নিজ নিজ সামর্থ নিয়ে প্রাণপনে ময়দানে নেমে আসে হাজার হাজার আত্মত্যাগী তরুন। এরাই পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজাকার। তাদের অধিকাংশই ছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বহু হাজার ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। অনেকে ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থক। বাংলার হাজার বছরের মুসলিম ইতিহাসে বাংলাভাষী মানুষ একটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় এভাবে কাফের বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে সে ইতিহাস খুব একটা নেই। বরং ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনী যখন বাংলা দখল করে নেয় তখন বাংলার কোন তরুন একটি তীরও ছুড়েনি। কেউ প্রাণ দিয়েছে সে নজিরও নেই। তিতুমীরের প্রতিরোধ এসেছে অনেক পরে। একাত্তরের বহু হাজার রাজাকার প্রাণ হারিয়েছে। অনেকে পঙ্গু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার –এ দুই পক্ষের মাঝে সবচেয়ে বেশী প্রাণ হারিয়েছে এবং নির্যাতীত হয়েছে এই রাজাকারেরা। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যা কিছু হয়েছে তা হয়েছে লড়াইয়ের মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালে। কিন্তু রাজকারদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলেছে একাত্তরের পরও। বরং তাদের উপর লাগাতর হামলা হচ্ছে বিগত ৩৮ বছর ধরে। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা ও ইতিহাসের বইয়ে রাজাকারদের বিরুদ্ধে শুধু গালিগালাজই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তারাও যে একটি চেতনা ও দর্শনের অধিকারি ছিল, বাংলার মুসলমানদের কল্যাণে তাদেরও যে একটি রাজনৈতিক কৌশল বা স্ট্রাটেজী ছিল -সে সত্যটিকে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। রাজাকারদেরও অধিকার দিওয়া হয়নি তাদের চেতনা ও দর্শনের কথাগুলো লোক-সম্মুখে তুলে ধরার। অথচ সেটিও বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ।
বিষয়: বিবিধ
১১৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন