অবিরাম গুলি আর টিয়ার শেলে ঘুম ভাঙে হেফাজত সদস্যদের ?
লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ১৫ মে, ২০১৩, ০৫:৪৫:৩৩ বিকাল
অভিযান শেষে রাজপথ ও বিভিন্ন ভবন ছিল লণ্ডভণ্ড।
৬ মে ভোর রাতে মতিঝিলে যখন অভিযান চালানো হয় তখন হেফাজতে ইসলামের বেশির ভাগ সদস্যই ছিলেন ঘুমন্ত। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির অভিযান প্রতিরোধ করার চেষ্টা পর্যন্ত তারা করেননি। হাজার হাজার রাউন্ড গুলি, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের মুখে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় তারা অসংখ্য মানুষকে রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখেছেন। তবে তাদের মধ্যে কতজন মারা গেছেন তা নিশ্চিত করতে পারেনি কেউ। কিছু কিছু মিডিয়া ইতোমধ্যে এই অভিযান নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে দেড় লক্ষাধিক রাউন্ড গোলাবারুদ ব্যয় হয়েছে এই অভিযানে। ৫ মে থেকে ৬ মে ভোর পর্যন্ত এই গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়। তবে পুলিশ সদর দফতর ও ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গোলাবারুদ কী পরিমাণ ব্যবহার হয়েছে তার হিসাব এখনো নিরূপণ করা হয়নি। এখানে পুলিশের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ, দাঙ্গা পুলিশ, রিজার্ভ পুলিশসহ বিভিন্ন শাখার সদস্যরা অংশ নেন এই অভিযানে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো কী পরিমাণ গোলাবারুদ ওই দিন ব্যবহার হয়েছে তার হিসাব কষছে। একই সাথে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং র্যাব সদস্যরাও অংশ নেন ওই অভিযানে। তারাও ব্যবহার করেছেন গোলাবারুদ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারদলীয় সমর্থকেরাও উপস্থিত ছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫ মের অবরোধ কর্মসূচির আগেই নেতাকর্মীদেরকে ঢাকায় আনা হয় বলে জানা গেছে।.
৫ মে ভোরেই যখন রাজধানীর আশপাশের সব প্রবেশপথ হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা বন্ধ করে দেন তখন থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান গ্রহণ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বঙ্গভবনের পাশের রাস্তায়। যাত্রাবাড়ী থেকে হেফাজতে ইসলামের একটি মিছিল মতিঝিল আসার চেষ্টা করলে পুলিশ সেখানে বাধা দেয়। সেখানে পুলিশের সাথে হেফাজতে ইসলাম সদস্যদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। সেখানে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এরপর দিনভর পল্টন ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে হেফাজতে ইসলামের অনেক সদস্যকে মারধর করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পল্টন এলাকায় রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত টানা সংঘর্ষ চলে। এরপর সেখান থেকে হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা পিছু হটে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত চলে যান। এর পরও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরা থেমে থেমে গুলিবর্ষণ, সাউন্ড গ্রেনেড চার্জ এবং টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেন। রাত ১০টার দিকে হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা সিটি সেন্টার পর্যন্ত হটে যান। ওই দিকে বক চত্বরও তখন পর্যন্ত তাদেরই দখলে ছিল। রাত ১০টার পর থেকেই পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা মতিঝিল থানার সামনে পর্যন্ত অবস্থান সুদৃঢ় করেন।
এ দিকে রাত ৮টার পর থেকেই পুলিশ সদর দফতরসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি স্থানে একের পর এক বৈঠক চলে। কিভাবে মতিঝিল থেকে হেফাজতে ইসলাম সদস্যদের সরিয়ে দেয়া যায় সে বিষয়ে রণকৌশল ঠিক করা হয়। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা প্রথমে চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। কিন্তু রাত ১০টার পর তারা বুঝতে পারেন হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা মতিঝিল ছাড়বেন না। রাত ১২টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওপরের নির্দেশে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন। এ সময় একাধিক সভায় মতিঝিলে গুলিবর্ষণ না করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে মত দেন। সূত্র জানায়, ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের আশঙ্কা ছিল গভীর রাতে বিস্তর লোক হতাহত হবে। গুলিতে মারা না গেলেও লাখ লাখ মানুষ যখন পালাতে যাবে তখন পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে অনেকে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
সূত্র জানায়, রাতে অভিযান চলবে এই সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হয় তখনই দৈনিক বাংলা, মতিঝিল ও আরামবাগ এলাকার বেশির ভাগ স্ট্রিট লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন হেফাজতে ইসলামের অনেক সদস্যের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জানা গেছে লাইট নিভিয়ে দেয়ার পর ঢাকায় যাদের থাকার সুযোগ ছিল তাদের অনেকেই চলে যান।
সূত্র জানায়, রাত আড়াইটার দিকে যখন ‘অপারেশন সিকিউরড মতিঝিল’ শুরু হয় তখন হেফাজতে ইসলামের বেশির ভাগ সদস্য ছিলেন ঘুমন্ত। এসব সদস্য ২০-২৫ কিলোমিটার হেঁটে মতিঝিল এসেছিলেন। এশার নামাজ আদায়ের পরই তাদের অনেকে ঘুমিয়ে পড়েন। দৈনিক বাংলা মোড়ের যে স্থানে পুলিশের গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরিত হচ্ছিল সেখানেও অনেককে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। আরামবাগ পুলিশ বক্স থেকে শুরু করে এক দিকে ইত্তেফাক মোড় এবং অপর দিকে দৈনিক বাংলা এবং দিলকুশার বিভিন্ন ফুটপাথ, অফিসের বারান্দা ও সিঁড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন হাজার হাজার মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত আড়াইটার দিকে যখন তিন দিক থেকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও সাউন্ড গ্রেনেড বর্ষণ শুরু হয় তখন অনেকেই দিকভ্রান্ত হয়ে দিগি¦দিক ছুটতে থাকেন। মতিঝিলে উপস্থিত আতিকুল ইসলাম নামে এক হেফাজতকর্মী জানান, এ সময় শাপলার নিচের পানিতে ঝাঁপ দিয়েও অনেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। পুলিশ সেখান থেকেও খুঁজে খুঁজে বের করে আনে হেফাজতকর্মীদের।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শেষ পর্যন্তও হেফাজতের নেতারা মঞ্চের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিলেন যাতে কর্মীরা রাস্তা থেকে উঠে না যান। কিন্তু পরপর যখন কয়েকটি টিয়ার শেল মঞ্চের ওপর পড়ে তখন নেতারাই মঞ্চ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, সেখানে অবিরাম গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শুনতে পান তারা। দিন-রাত মিলিয়ে সেখানে দেড় লাখের মতো গোলাবারুদ ব্যবহার হয়েছে বলে একটি সূত্র উল্লেখ করেছে। তবে পুলিশ সদর দফতর এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, এখনো হিসাব চূড়ান্ত হয়নি।
সূত্র জানায়, ভোর রাত সাড়ে ৫টা পর্যন্ত গুলির শব্দ শোনা যায়। এর মধ্যে অনেককেই দেখা গেছে বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে। আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পিটিয়ে রাস্তায় শুইয়ে দিয়েছে এমন দৃশ্যও নজরে আসে। রাস্তায়, সিঁড়িতে ও বিভিন্ন ভবনের বারান্দায় রক্তাক্ত অবস্থায় অনেককে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তবে তারা মৃত কী জীবিত তা তখন বোঝা যায়নি। তাদের অনেককে গাড়িতে উঠানোর দৃশ্যও দেখা গেছে। বেশির ভাগকে রক্তাক্ত অবস্থায় হেফাজতে ইসলামের সদস্যরাই কাঁধে করে নিয়ে গেছেন বলে জানা যায়।
বিষয়: বিবিধ
১২১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন