সব ইস্যুই চাপা পড়ে যাচ্ছে।

লিখেছেন লিখেছেন আইল্যান্ড স্কাই ০৮ মে, ২০১৩, ০৭:০১:১২ সন্ধ্যা



সব ইস্যু চাপা পড়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তিতে ইস্যু গিলে খাচ্ছে ইস্যুকে। একটা দুর্ঘটনা শেষ না হতেই অপর দুর্ঘটনা আগের ঘটনাকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো দুর্ঘটনারই পরিসমাপ্তি আসছে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরুতেই বড় ধরনের হোঁচট খায় বিডিআর হত্যাকা- নিয়ে। সরকারের শুরুতে এই দুর্ঘটনা ছিল বার্নিং ইস্যু। ওই ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, দুজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, নয়জন বিডিআর সদস্য, একজন পুলিশ ও তিনজন পথচারী। দেশের ইতিহাসে এটা ছিল অন্যতম বিয়োগান্তক ঘটনা। এই ইস্যুটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বে টান দেয়। এই ইস্যুর রেশ টানতে না টানতেই সারাদেশে শুরু হয় ছাত্রলীগের তা-ব। দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় কলেজগুলোতে ছাত্রলীগ দখলবাজি করতে গিয়ে আলোচনায় উঠে আসে। শুরু হয় টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি। এক সময় ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। ক্ষমতার প্রথম দুবছর ছাত্রলীগ আলোচনা-সমালোচনার অন্যতম ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। একটা সময় ছাত্রলীগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছাত্রশিবির বেপরোয়া হয়ে ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দখল করতে গিয়ে তারা ছাত্র হত্যা করে ম্যানহোলে ফেলে রাখে। ঘাতক শিবিরের নৃশংসতায় পুরো জাতি থমকে ওঠে। তাদের এই তা-ব মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়ে দেয়। তাদের এই বর্বরতা ’৭১ সালের ভয়াবহতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিডিআর ইস্যু, ছাত্রলীগ ও শিবিরের তা-বের পর শুরু হয় শেয়ারবাজার পতন। এই ইস্যুতে সরকার নাজেহাল হয়ে পড়ে। ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি দুপুর ১টায় দেশের শেয়ারবাজারের পতন ঘটে। পাঁচ মিনিটে সূচক নেমে যায় ৬শ পয়েন্টে। এর পর শুরু হয় ধারাবাহিক পতনের কাহিনী। শেয়ারবাজার ইস্যুতে দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুজন পুঁজি হারিয়ে আত্মহত্যা করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের মতে, শেয়ারবাজার থেকে রেকর্ডসংখ্যক ৪০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মধ্যে ধীরে ধীরে উঠে আসে পদ্মা সেতু ইস্যু। সেতু নির্মাণে ২০১১ সালে ২৮ এপ্রিল সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে। একই বছর ১৮ এবং ২৪ মে সরকার চুক্তি করে জাইকা এং ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু ইস্যুতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তি বাতিলও করে দেয়া বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতু ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নিকটজন, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা জড়িয়ে পড়েন। এই ইস্যুটি সরকারের অনেক অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। পদ্মা সেতু যে সময় বার্নিং ইস্যু সে সময়ই সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়। এই ইস্যুটি বেশ কিছুদিন আলোচনায় ছিল। এই ঘটনা সরকারের ইমেজ অনেকটা বৃদ্ধি করে। এরই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয় ও পাটের ক্ষতিকর ছত্রাকের জিন কোড আবিষ্কার ইস্যুও বেশ কিছুদিন আলোচনায় ছিল।

২০১২ সালে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন সরকারের সমালোচক হিসেবে কাজ করা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ওবায়দুল কাদের। পদ্মা সেতুতে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ায় আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভেঙে যোগাযোগ ও রেল মন্ত্রণালয় করা হয়। রেলমন্ত্রী হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ওবায়দুল কাদের হন যোগাযোগমন্ত্রী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কিছুদিন যেতে না যেতেই ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। তার এপিএস ওমর ফারুক ৭০ লাখ টাকাসহ বিজিবি হেড কোয়ার্টারে ধরা পড়েন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেল থেকে কালো বিড়াল তাড়াতে গিয়ে নিজেই কালো বিড়ালে পরিণত হন। তিনি ঘুষ কেলেঙ্কারির মধ্যেই বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী বনানী থেকে সাদা পোশাকধারীদের হাতে অপহৃত হন। সুরঞ্জিতের ঘুষ কেলেঙ্কারি ইস্যুতে ইলিয়াস গুম ইস্যু চাপা দিয়ে দেয়। বিএনপি সক্রিয় হয়ে ওঠে টানা হরতাল পালনে। পুলিশ ও বিএনপিকর্মীদের সংঘর্ষের মাঝে সুরঞ্জিতের ঘুষ কেলেঙ্কারি ইস্যু চাপা পড়ে যায়। যদিও ১৬ এপ্রিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেন। পরে অবশ্য তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী বানানো হয়।

এ সময় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকা- ইস্যুটি অন্যতম আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের কথা বললেও তা আর সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ প্রায় এক বছর পার হলেও আজো সাগর-রুনি হত্যাকান্ডে জড়িত প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করা হয়নি। সাগর-রুনি হত্যাকা- ও ইলিয়াস গুম ইস্যুকে চাপা দিতে সক্ষম হয় হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি। প্রায় একই সময় এই ইস্যু দুটি মাঠে আসে। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক জড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম এবং হলমার্কের কয়েক শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। এই কেলেঙ্কারির রেশ শেষ না হতেই বেরিয়ে আসে ডেসটিনির প্রতারণা ইস্যু। একই সময় মাল্টি পারপাস ব্যবসার নামে ডাকাতি করার বিষয় উঠে আসে। এতে ডেসটিনির এমডি রকিফুল আমিন ও প্রেসিডেন্ট লে. জে. (অব.) হারুন-অর-রশিদকে গ্রেফতার করে দুদক। রফিকুল আমিন কারাগারে থাকলেও জামিনে বের হয়ে এসেছেন লে. জে. (অব.) হারুন-অর-রশিদ। হলমার্ক ও ডেসটিনির কেলেঙ্কারি ঘটনা বাজারে চলমান অবস্থায় রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত এ হামলা ও ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনায় বিভিন্ন মহলের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও মূল রহস্য আজো উন্মোচিত হয়নি। রামু ট্র্যাজেডির মাঝেই পুলিশ নির্যাতন বেপরোয়া হয়ে যায়। অক্টোবর মাসে কুষ্টিয়ায় মা-মেয়েকে অন্ধকার ঘরে ছয়দিন আটকে রেখে নির্যাতন চালায় পুলিশ। একই সময় ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে বাবা-মায়ের সামনেই মেয়ের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে পুলিশ। পুলিশের এ নারী ধর্ষণের চেষ্টার কোনো বিচার আজো হয়নি। পুলিশের নারী ধর্ষণের ইস্যু শেষ হতে না হতে ৫ ও ৬ নভেম্বর আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে শিবির। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে ৫ ও ৬ নভেম্বর সারা দেশে বেপরোয়া তা-ব চালায় শিবির কর্মীরা। তাদের জঙ্গি কর্মীরা, পুলিশ, সাংবাদিক ও নিরীহ পথচারীদের ওপর হামলা চালায়। শিবির কর্মীরা পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে ও পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ওই অস্ত্র দিয়ে পুলিশদের পিটিয়ে আহত করে। তারা পুলিশের গাড়িতে হামলা করে। সংঘবদ্ধভাবে বাঁশ দিয়ে বেয়নটের আদলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পুলিশ সদস্যকে হত্যার চেষ্টা করে। তাদের এই তা-ব ’৭১-এর আল-বদর, আল শামসের অপকর্মের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। শিবিরের পৈশাচিকতার মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে ম্লান করে দেয়।

শিবিরের তা-বের মাঝেই আবার আলোচনার ইস্যু হয়ে যায় ছাত্রলীগ। সারাদেশ জুড়ে শিবির যে তা-ব চালিয়েছে তা ম্লান করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্তৃক বিশ্বজিৎ হত্যাকা-। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। বিশ্বজিৎ হত্যাকা- ইস্যু সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। সরকার প্রথমে ছাত্রলীগের জড়িত থাকার বিষয় অস্বীকার করলেও মিডিয়ার ভূমিকার কারণে খুনিদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছে। এই ইস্যুর মাঝে আবার সরকারি দল ও বিরোধী দলের দুই নেত্রীর কাদা ছোড়াছুড়ি রাজনীতির ইস্যু মাঠে হাজির হয়েছে। একদিকে খালেদা জিয়া সরকারপ্রধান, তার মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও এমপিদের ‘চোর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনা যশোরের সমাবেশে বিরোধী দলের নেত্রীকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেছেন। উভয় নেত্রীর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে বিশ্বজিৎ হত্যা ইস্যু হারিয়ে যেতে বসেছে।

এর আগে আলোচিত যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচার ইস্যুতে পদত্যাগ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারপতি মো. নিজামুল হক। তার স্থলে নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি এটিএম ফজলুল কবীরকে। এই ইস্যুতে সরকারের ঘোষণা ছিল ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত একজনের বিচার কাজ সম্পন্ন করা। কিন্তু বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করায় তা আর সম্ভব হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে এলজিআরডি মন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী বিজয় দিবসের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ সম্পন্ন হবে। তবে এই ইস্যুটিও ঝুলে পড়েছে।

বাঙালি বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। খুব সহজেই সবকিছু দ্রুত ভুলে যায়। এই ভুলে যাওয়া মানসিকতার কারণে রাজনীতিকরা একেক সময় একেকটা ইস্যু মাঠে ছেড়ে দেয়। এসব ইস্যু বা ঘটনার বিচার সুরাহা না হওয়ার আগেই নতুন ঘটনা বা ইস্যু মাঠে এসে যায়। এসব ঘটনার নেপথ্যে যারা কাজ করে, উসকানিদাতা যারা, তাদের কখনো খুঁজে বের করা হয় না। বরং বিভিন্ন ইস্যুতে জড়িতদের রক্ষা করতেই নতুন ইস্যু মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে ইস্যু গিলে খায় ইস্যুকে। কোনো ইস্যুরই সঠিক সুরাহা হয় না।

বিষয়: বিবিধ

১০৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File