ফিবোনাচ্চি সংখ্যা ও প্রকৃতির রহস্য
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধার মেঘমালা ০৯ আগস্ট, ২০১৩, ০৭:১৩:৪৫ সন্ধ্যা
৫/৮/১৩ তারিখটি ছিলো এই শতাব্দীর শেষ ফিবোনাচ্চি সংখার তারিখ (A magical date) । ফিবোনাচ্চি রাশিমালা হলো সংখ্যার খেলা। এই রাশিমালা গণিত ও প্রকৃতির অনেক রহস্যের সমাধান করতে পারে বলে অনেকের ধারনা। সংখ্যাতত্তের ভেলকিবাজি সম্পর্কে গ্রেগ এষ্টারব্রুক বলেছিলেন:
"সংখ্যাকে অত্যাচার কর, তারা যে কোন কিছুই স্বীকার করবে" ।
স্বয়ং ফিবোনাচ্চি রাশিমালার আবিষ্কারক ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিখ্যাত গণিতবিদ লিওনার্দো দা পিসা (ডাকনাম ফিবোনাচ্চি) বলে গেছেন,
“প্রকৃতির মূল রহস্য এ রাশিমালাতে আছে” ।
এই রাশিমালার ক্রম এরকম……………..
০,১,১,২,৩,৫,৮,১৩,২১,৩৪,৫৫,৮৯,১৪৪,২৩৩,৩৭৭, ৬১০,৯৮৭……
এই রাশিমালার বৈশিষ্ট্য (নিজে মিলিয়ে দেখুন,দারুন লাগবে):
১. এই সিরিজের যে কোন সংখ্যা তার পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যার যোগফলের সমান।
যেমনঃ ০+১=১
১+১=২,
২+১=৩,
৩+২=৫,
৫+৩ =৮, … … … ইত্যাদি।
গাণিতিক রাশিমালার সাহায্যে বলা যায়ঃ F(n)=F(n-1)+F(n-2); যেখানে F(0)=0 এবং F(1)=1 । ঠিক বিপরীতভাবে যেকোন সংখ্যা তার পরবর্তী দুটি সংখ্যার বিয়োগফলের সমান।
২. এই সিরিজের যেকোন ৪টি সংখ্যা নেয়া হলে ১ম ও ৪র্থ সংখ্যার যোগফল থেকে ২য় ও ৩য় সংখ্যার যোগফল বিয়োগ দিলে সবসময় ওই ৪ট সংখ্যার ১ম টি পাওয়া যাবে। আবার ১ম ও ৪র্থ সংখ্যার গুনফল থেকে ২য় ও ৩য় সংখ্যার গুনফল বিয়োগ দিলে সবসময় বিয়োগফল ক্রমান্ব্য়ে ১ এবং -১।
যেমনঃ আমরা ফিবোনাচ্চি সিরিজ থেকে যেকোন ৪টি সংখ্যা নিলামঃ ৫,৮,১৩,২১। এখন এর মাঝেঃ
১ম ও ৪র্থ সংখ্যার যোগফল= ৫+২১=২৬
২য় ও ৩য় যোগফল= ৮+১৩=২১
বিয়োগফল= ২৬-২১=৫(ওই ৪টি সংখ্যার ১ম সংখ্যা)
১ম ও ৪র্থ সংখ্যার গুনফল= ৫*২১=১০৫
২য় ও ৩য় সংখ্যার গুনফল= ৮*১৩=১০৪
বিয়োগফল= ১০৫-১০৪=১
আবার পরের চারটি মানে ৮,১৩,২১,৩৪ এর জন্য হিসাব করে দেখুন এক্ষেত্রে বিয়োগফল পাবেন -১। ৩. এবার ফিবোনাচ্চি সিরিজের মজার একটি বৈশিষ্ট্যে যাই, সবগুলি সংখ্যার শেষ ডিজিটে যেই নাম্বার গুলো আছে সেগুলো খেয়াল করুনঃ
০,১,১,২,৩,৫,৮,১৩,২১,৩৪,৫৫,৮৯,১৪৪,২৩৩,৩৭৭,৬১০,৯৮৭,……………….
সেই ডিজিটগুলো আলাদা করিঃ
৩,১,৪,৫,৯,৪,৩,৭,০,৭,……………………
মিলিয়ে দেখুন এরাও ফিবোনাচ্চি ক্রমে আছে।এবং এরাও আগের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে যদি পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যার যোগফল একের অধিক বা দুই ডিজিটের হয় তবে তার শেষ ডিজিট আসবে। ফিবোনাচ্চি সিরিজের প্রতি ৬০টি সংখ্যার পর এই ডিজিটগুলো আবার রিপিট করে। যেমন ফিবোনাচ্চি সিরিজের
৬০ তম সংখ্যা= ১৫৪৮০০৮৭৫৫৯২০
৬১ তম সংখ্যা= ২৫০৪৭৮০৭৮১৯৬১
৬২ তম সংখ্যা= ৪০৫২৭৩৯৫৩৭৮৮১
৬৩ তম সংখ্যা= ৬৫৫৭৪৭০৩১৯৮৪২
৬৪ তম সংখ্যা= ১০৬১০২০৯৮৫৭৭২৩
৬৫ তম সংখ্যা= ১৭১৬৭৬৮০১৭৭৫৬৫
মজার ব্যাপার হল একইভাবে ফিবোনাচ্চি সিরিজের প্রতিটি সংখ্যার শেষ দুই ডিজিট, শেষ তিন ডিজিট ,চার ডিজিট এরকম করে সব ডিজিটের এর মাঝেই ফিবোনাচ্চি সংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলো খুজে পাওয়া যায়।
৪. এখন আমরা কয়েকটি ফিবোনাচ্চি সংখ্যার ভাগ করে দেখিঃ
২/১=২
৩/২=১.৫
৫/৩=১.৬৬৭
৮/৫=১.৬
১৩/৮=১.৬২৫
২১/১৩=১.৬১৫
৩৪/২১=১.৬১৯
অর্থাৎ প্রথম দুটি ভাগফল বাদ দিলে বাকি ভাগফলগুলোর মান প্রায় সমান বা ধ্রুবক। এই ধ্রুবক সংখ্যাটি "সোনালী অনুপাত" বা "স্বর্গীয় অনুপাত", ইংরেজীতে"Giolden Ratio " নামে পরিচিত। Mark Barr নামক একজন গণিতবিদ সোনালী অনুপাত বা স্বর্গীয় অনুপাতকে 'ফাই'(φ) দ্বারা প্রকাশ করেন। এর মান ১.৬১৮০৩৩৯৮৯ (প্রায়)। একে স্বর্গীয় অনুপাত বলার কারন হল মানবদেহের কয়েকটি অংশের অনুপাতের সাথে এর মিলে যাওয়া।যেমনঃ
* আমাদের forearm এর সাথে হাত এর অনুপাতের মান হল ১.৬১৮
* আমাদের মুখের দৈর্ঘ্যের সাথে নাকের প্রস্থের অনুপাত ১.৬১৮
* আমাদের fingertip থেকে এলবোর দৈর্ঘ্য এবং কবজি থেকে এলবোর দৈর্ঘ্যের অনুপাত ১.৬১৮
এই সোনালী অনুপাত পৃথিবীর সুন্দরতম অনুপাত। এটিকে বলা হয় natural beauty-maker। কারন মানবদেহ, ডিএনএ, প্রাণীকুল, উদ্ভিদ, ফুল, ফল, মানুষের তৈরি শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সঙ্গীত সকল জায়গায় এই অনুপাত লক্ষনীয়। আমাদের মুখের অবয়বে এই অনুপাতটি যত নিখুঁত হয় মুখমন্ডলটি দেখতে আমাদের তত ভালো লাগে ।
সামনের দুটি দাতের দৈর্ঘ ও প্রস্থের অনুপাতের নৈপুণ্য আমাদের হাসি সুন্দর করে। প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রিকরা প্রথম Giolden Ratio চিহ্নিত করেন। ফ্রান্স এর অন্যতম প্রাচীন গির্জা Notre Dame, মিশরীয় পিরামিড এর নকশা Giolden Ratio অনুসারে করা হয়েছিল। আধুনিক জাতিসংঘের বিল্ডিংগুলোর নকশা Giolden Ratio তে হয়েছে।
চমকপ্রদ চিত্রকলা ও স্থাপত্য সৃষ্টিতে Giolden Ratio অত্যন্ত গুরুত্ববহ। লিওনার্ডো দা ভিঞ্চির আঁকা Mona Lisa ও The Last Supper এ Giolden Ratio রয়েছে ।
ছবি: আমাদের মধ্যমার হাড়্গুলো।
ছবি: আমাদের মধ্যমার হাড়্গুলো।
এই হাড়গুলোর দৈর্ঘ্য ফিবোনাচ্চি সংখ্যার ক্রম। তাছাড়া আমাদের দুটি হাত ,হাতের আঙ্গুল ৫টি ,তার মাঝে ৮টি আঙ্গুল আছে যেগুলো কিনা তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রতিটিই কিন্তু ফিবোনাচ্চি সংখ্যা !
প্রাণীকুলে খরগোশ, ইদুর, মৌমাছি প্রভৃতির বংশবৃদ্ধি ঘটে ফিবোনাচ্চি সংখ্যার ক্রমে। অনেক ফুলের পাপড়িসংখা গণনা করলে দেখি :
চিত্র : ফুলের পাপড়িতে ফিবোনাচ্চি রাশিমালার মায়াজাল ।
উদ্ভিদের বৃদ্ধিতেও লক্ষ্য করা যায়…………..
চিত্র : উদ্ভিদ
মাকড়সার জাল, ঘূর্ণীঝড়, শামুকের স্পাইরাল, সূযর্মুখী ফুলের পাপড়ির বিন্যাস,পাইন গাছের মোচা, ঝিনুকের খোল ফিবোনাচ্চির নিয়ম মেনে চলে।
প্রকৃতি ও ফিবোনাচ্চি রাশিমালা আমার কাছে রহস্যময়। আমি এই রাশিমালা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদ স্যারের বই পড়ে। আর খানিকটা জানার চেষ্টা করেছি গুগুলিং করে।আগামী ১৯ শে আগস্ট ফিবোনাচ্চি দিবস ।শুভেচ্ছা রইলো ।
বিষয়: বিবিধ
৩৬১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন