Star Starভালো লাগা কবিতা সমগ্র(১৬টি নির্বাচিত কবিতা)Star Star

লিখেছেন লিখেছেন সন্ধার মেঘমালা ১৮ জুলাই, ২০১৩, ১২:১৭:০১ রাত





১। বোধ - জীবনানন্দ দাশ

আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!

স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!

আমি তারে পারি না এড়াতে

সে আমার হাত রাখে হাতে;

সব কাছ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,

সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয়!

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!

কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে

সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা

কে বলিতে পারে আর! — কোন নিশ্চয়তা

কে জানিতে পারে আর? — শরীরের স্বাদ

কে বুঝিতে চায় আর? — প্রাণের আহ্লাদ

সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!

সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর

স্বাদ কই! — ফসলের আকাঙক্ষায় থেকে,

শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,

শরীরে জলের গন্ধ মেখে,

উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে

চাষার মতণ প্রাণ পেয়ে

কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে?

স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়,কোন এক বোধ কাজ করে

মাথার ভিতরে!

পথে চলে পারে — পারাপারে

উপেক্ষা করিতে চাই তারে:

মড়ার খুলির মতো ধ’রে

আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে

তবু সে মাথার চারি পাশে!

তবু সে চোখের চারি পাশে!

তবু সে বুকের চারি পাশে!

আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে!

আমি থামি —

সেও থেমে যায়;

সকল লোকের মাঝে বসে

আমার নিজের মুদ্রাদোষে

আমি একা হতেছি আলাদা?

আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আমার পথেই শুধু বাধা?

জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে

সন্তানের মতো হয়ে —

সন্তানের জন্ম দিতে দিতে

যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়

কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়

যাহাদের ; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে

জন্ম দেবে — জন্ম দেবে বলে;

তাদের হৃদয় আর মাথার মতন

আমার হৃদয় না কি? — তাহাদের মন

আমার মনের মতো না কি?

–তবু কেন এমন একাকী?

তবু আমি এমন একাকী!

হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল?

বালটিকে টানি নি কি জল?

কাস্তে হাতে কতবার যাই নি কি মাঠে?

মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে

ঘুরিয়াছি;

পুকুরের পানা শ্যালা — আঁষটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে

গিয়েছে জড়ায়ে;

–এই সব স্বাদ

–এ সব পেয়েছি আমি — বাতাসের মতন অবাধ

বয়েছে জীবন,

নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন

একদিন;

এই সব সাধ

জানিয়াছি একদিন — অবাধ — অগাধ;

চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে —

ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,

অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,

ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;

আমার সে ভালোবাসিয়াছে,

আসিয়াছে কাছে,

উপেক্ষা সে করেছে আমারে,

ঘৃণা করে চলে গেছে — যখন ডেকেছি বারেবারে

ভালোবেসে তারে;

তবুও সাধনা ছিল একদিন — এই ভালোবাসা;

আমি তার উপেক্ষার ভাষা

আমি তার ঘৃণার আক্রোশ

অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র — নক্ষত্রের দোষে

আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়ে গেছে বাধা

আমি তা ভুলিয়া গেছি;

তবু এই ভালোবাসা — ধুলো আর কাদা — ।

মাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয় — প্রেম নয় — কোনো এক বোধ কাজ করে।

আমি সব দেবতার ছেড়ে

আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,

বলি আমি এই হৃদয়েরে;

সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?

অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?

কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ

পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ

মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!

মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!

শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!

এই বোধ — শুধু এই স্বাদ

পায় সে কি অগাধ — অগাধ!

পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ

চায় না সে? করেছে শপথ

দেখিবে সে মানুষের মুখ?

দেখিবে সে মানুষীর মুখ?

দেখিবে সে শিশুদের মুখ?

চোখে কালোশিরার অসুখ,

কানে যেই বধিরতা আছে,

যেই কুঁজ — গলগন্ড মাংসে ফলিয়াছে

নষ্ট শসা — পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,

যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে

— সেই সব।



২।আট বছর আগের একদিন- জীবনানন্দ দাশ



শোনা গেলো লাশকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হলো তার সাধ।

বধূ শুয়ে ছিলো পাশে - শিশুটিও ছিলো;

প্রেম ছিলো, আশা ছিলো - জোৎস্নায়, - তবু সে দেখিল

কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি !

রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি

আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার;

কোনোদিন জাগিবে না আর।

‘কোনোদিন জাগিবে না আর

জানিবার গাঢ় বেদনার

অবিরাম - অবিরাম ভার

সহিবে না আর - ‘

এই কথা বলেছিলো তারে

চাঁদ ডুবে চলে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে

যেন তার জানালার ধারে

উটের গ্রীবার মতো কোনো-এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও তো প্যাঁচা জাগে;

গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায় - অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে

চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;

মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;

সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন বিকীর্ণ জীবন

অধিকার করে আছে ইহাদের মন;

দূরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ

মরণের সাথে লড়িয়াছে;

চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে

এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা - একা;

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

এই জেনে।

অশ্বথের শাখা

করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে

করেনি কি মাখামাখি?

থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে

বলেনি কি : ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?

চমৎকার! -

ধরা যাক দু -একটা ইঁদুর এবার!’

জানায়নি প্যাঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

জীবনের এই স্বাদ - সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের -

তোমার অসহ্য বোধ হলো;

মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো

মর্গে - গুমোটে

থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!

শোনো

তবু এ মৃতের গল্প; - কোনো

নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিত জীবনের সাধ

কোথাও রাখে নি কোন খাদ,

সময়ের উর্ধ্বতনে উঠে এসে বধূ

মধু - আর মননের মধু

দিয়েছে জানিতে;

হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে

এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের’পরে।

জানি - তবু জানি

নারীর হৃদয় - প্রেম - শিশু - গৃহ - নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় -

আরো এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে;

ক্লান্ত - ক্লান্ত করে;

লাশকাটা ঘরে

সেই ক্লান্তি নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বথের ডালে বসে এসে,

চোখ পালটায়ে কয় : ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?

চমৎকার !

ধরা যাক দু - একটা ইঁদুর এবার -’

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার?

আমিও তোমার মতো বুড়ো হব - বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব

কালীদহে বেনো জলে পার;

আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।



৩।শীতরাত - জীবনানন্দ দাস

এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;

বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,

কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।

শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে -

সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।

এদিকে কোকিল ডাকছে - পউষের মধ্য রাতে;

কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব'লে?

কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?

তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ'য়ে যেতে দেখেছি,

তারা কিশোর নয়,

কিশোরী নয় আর;

কোকিলের গান ব্যবহৃত হ'য়ে গেছে।

সিংহ হুঙ্কার ক'রে উঠছে:

সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,

স্থবির সিংহ এক - আফিমের সিংহ - অন্ধ - অন্ধকার।

চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে

মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।

সিংহ অরন্যকে পাবে না আর

পাবে না আর

পাবে না আর

কোকিলের গান

বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ'শে খ'শে

চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।

হে পৃথিবী,

হে বিপাশামদির নাগপাশ, - তুমি

পাশ ফিরে শোও,

কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।



৪.আমাকে একটি কথা দাও - জীবনানন্দ দাস

আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো

সহজ মহৎ বিশাল,

গভীর; - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে

মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,

আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।

সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:

সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন

সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে

অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।



৫. মনে হয় একদিন আকাশের - জীবনানন্দ দাস

মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর;

দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন

নিভে যায়; দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন,

শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার

আমার চোখের কাছে; লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার

পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়; হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ;

সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন

বেজে ওঠে : বুঝিব না-গঙ্গাজল, নারকোলনাডুগুলো তার

জানি না সে কারে দেবে- জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস

হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কি না…

আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার-আমি তা জানি না-

মৃত্যুরে কে মনে রাখে?-কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস

নতুন ডাঙার দিকে-পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা

দিন তার কেটে যায়- শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?



৬. তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও - জীবনানন্দ দাস

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে

র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;

দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে

ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে

নেচে চলে-একবার — দুইবার — তারপর হঠাৎ তাহারে

বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;

দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ — শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে

শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে,

খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্ কাহিনীর দেশে –

‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,

কল্মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীরে –

নীরবে পা ধোয় জলে একবার — তারপর দূরে নিরুদ্দেশে

চ’লে যায় কুয়াশায় — তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে

হারাব না তারে আমি — সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।



৭. আমি যদি হতাম – জীবনানন্দ দাশ

আমি যদি হতাম বনহংস;

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে

ছিপছিপে শরের ভিতর

এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে

ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে

আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে

আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-

তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-

নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,

শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে

সোনার ডিমের মতো

ফাল্গুনের চাঁদ।

হয়তো গুলির শব্দঃ

আমাদের তির্যক গতিস্রোত,

আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,

আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!

হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ

আমাদের স্তব্ধতা,

আমাদের শান্তি।

আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:

থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;

আমি যদি বনহংস হতাম,

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে।



৮। কুড়ি বছর পরে – জীবনানন্দ দাশ

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়

আবার বছর কুড়ি পরে-

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

কার্তিকের মাসে-

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী

নরম নরম শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !

অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,

ব্যস্ততা নাই আর,

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

পাখির নীড় থেকে খড়

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে

সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের

ঝাউয়ের-আমেরঃ

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার !

তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে-

বাবলার গলির অন্ধকারে

অশথের জানালার ফাকে

কোথায় লুকায় আপনাকে !

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-

সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-

কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !



৯। অন্য প্রেমিককে - জীবনানন্দ দাস

মাছরাঙা চ'লে গেছে -- আজ নয় কবেকার কথা;

তারপর বারবার ফিরে এসে দৃশ্যে উজ্জল।

দিতে চেয়ে মানুষের অবহেলা উপেক্ষায় হ'য়ে গেছে ক্ষয়;

বেদনা পেয়েছে তবু মানুষের নিজেরও হৃদয়

প্রকৃতির অনির্বচনীয় সব চিহ্ন থেকে দু' চোখ ফিরিয়ে;

বুদ্ধি আর লালসার সাধনাকে সব চেয়ে বড় ভেবে নিয়ে।

মাছরাঙা চ'লে গেছে -- আজ নয় কবেকার কথা;

তারপর বারবার ফিরে এসে ডানাপালকের উজ্জলতা

ক্ষয় ক'রে তারপর হয়ে গেছে ক্ষয়।

মাছরাঙা মানুষের মতো সূর্য নয়?

কাজ করে কথা ব'লে চিন্তা করে চলেছে মানব;

যদিও সে শ্রেষ্ঠ চিন্তা সারাদিন চিন্তানাশা সাগরের জলে

ডুবে গিয়ে নিঃশব্দতা ছাড়া আর অন্য কিছু বলে?



১০. তুই কি আমার দুঃখ হবি?- আনিসুল হক

তুই কি আমার দুঃখ হবি?

এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল

রুখো চুলে পথের ধুলো

চোখের নীচে কালো ছায়া

সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।

তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?

মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?

তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর

নির্জনতা ভেঙে দিয়ে

ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে

ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?

একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা

কেমন যেন বিষাদ হবি?

তুই কি আমার শুন্য বুকে

দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?

নরম হাতের ছোঁয়া হবি?

একটুখানি কষ্ট দিবি,

নীচের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?

একটুখানি কষ্ট দিবি

প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়

কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?

একটুখানি কষ্ট দিবি

তুই কি একা আমার হবি?

তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?



১১। চিঠি দিও -মহাদেব সাহা

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও

আঙ্গুলের মিহিন সেলাই

ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,

এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো

অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।

চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...

বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!

আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,

আসবেন অচেনা রাজার লোক

তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ....

এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! ...

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি

দিও খামে

কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস

একটি ফুলের ছোট নাম,

টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে

সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প

খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !



১২। চতুর্দশপদী কবিতাবলী - শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো

যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।

ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো

যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।

ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী

আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে...

ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়

আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-

ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে

চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা--

আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে।



১৩। একবার তুমি - শক্তি চট্টোপাধ্যায়

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো--

দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে

পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল

নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো ।

বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে

যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার , যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি- জরি-মাখা প্রতিমা

বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ।

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল

চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই - পাথরের ফাঁক - ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল-

অনেক সময়তো ঘর গড়তেও মন চায় ।

মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে

আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো - সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো

রূপোলী মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে

একবার তুমি ভলবাসতে চেষ্টা করো ।



১৪. অবনী বাড়ি আছো? -শক্তি চট্টোপাধ্যায়

অবনী বাড়ি আছো?

দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া

কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া

‘অবনী বাড়ি আছো?

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস

এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে

পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস

দুয়ার চেপে ধরে–

‘অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী

ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি

সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া

‘অবনী বাড়ি আছো?’



১৫। তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা-শহীদ কাদরী

ভয় নেই

আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী

গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে

মার্চপাস্ট করে চলে যাবে

এবং স্যালুট করবে

কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো

বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে

কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে

আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে

ভায়োলিন বোঝাই করে

কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-

বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো

মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো

চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো

প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে

কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।

ভয় নেই...আমি এমন ব্যবস্থা করবো

একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী

এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়

সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!

সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-

আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক

অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন

সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর

লাল নীল সোনালি মাছি-

ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।

ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে

শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন

আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে

গণচুম্বনের ভয়ে

হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।

ভয় নেই,

আমি এমন ব্যবস্থা করবো

শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো

অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো

স্টেটব্যাংকে গিয়ে

গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে

একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।

ভয় নেই, ভয় নেই

ভয় নেই,

আমি এমন ব্যবস্থা করবো

নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী

কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে

নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।



১৬। শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?

তারি রথ নিত্য উধাও।

জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন

চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।

ওগো বন্ধু,

সেই ধাবমান কাল

জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল

তুলে নিল দ্রুতরথে

দু'সাহসী ভ্রমনের পথে

তোমা হতে বহু দূরে।

মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে

পার হয়ে আসিলাম

আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;

রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়

আমার পুরানো নাম।

ফিরিবার পথ নাহি;

দূর হতে যদি দেখ চাহি

পারিবে না চিনিতে আমায়।

হে বন্ধু বিদায়।

কোনদিন কর্মহীন পূর্ণো অবকাশে

বসন্তবাতাসে

অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,

ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,

সেইক্ষণে খুজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে

তোমার প্রাণের প্রানে, বিস্মৃতি প্রাদোষে

হয়তো দিবে সে জ্যোতি,

হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।

তবু সে তো স্বপ্ন নয়,

সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় -

সে আমার প্রেম।

তারে আমি রাখিয়া এলাম

অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।

পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে

কালের যাত্রায়।

হে বন্ধু বিদায়।

তোমায় হয় নি কোন ক্ষতি।

মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি

যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি

হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-

পূজার সে খেলা

ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;

তৃষার্ত আবেগবেগে

ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।

তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে

যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত'ষায়

তার সাথে দিব না মিশায়ে

যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।

আজও তুমি নিজে

হয়তো বা করিবে বচন

মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন

ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।

হে বন্ধু বিদায়।

মোর লাগি করিয় না শোক-

আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।

মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,

শুন্যেরে করিব পূর্ণো, এই ব্রত বহিব সদাই।

উ'কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে

সে ধন্য করিবে আমাকে।

শুক্লপখক হতে আনি

রজনী গন্ধার বৃন্তখানি

যে পারে সাজাতে

অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে

সে আমারে দেখিবারে পায়

অসীম ক্ষমায়

ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,

এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।

তোমারে যা দিয়েছিনু তার

পেয়েছ নিশেষ অধিকার।

হেথা মোর তিলে তিলে দান,

করূন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান

হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,

ওগো নিরূপম,

হে ঐশ্বর্যবান

তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,

গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।

হে বন্ধু বিদায়।

বিষয়: সাহিত্য

২২১৪৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File