তসলিমা নাসরিনের অসাধারণ কবিতাRose

লিখেছেন লিখেছেন সন্ধার মেঘমালা ২৭ জুন, ২০১৩, ০৫:৫৩:৩৫ বিকাল



দুঃখবতী মা

মা'র দুঃখগুলোর ওপর গোলাপ-জল ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল,

যেন দুঃখগুলো সুগন্ধ পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও

ঘুমটি ঘরের বারান্দায়, কুয়োর পাড়ে কিম্বা কড়ইতলায়।

সন্ধেবেলায় আলতো করে তুলে বাড়ির ছাদে রেখে এলে

দুঃখগুলো দুঃখ ভুলে চাঁদের সঙ্গে খেলত হয়তো বুড়িছোঁয়া খেলা।

দুঃখরা মা'কে ছেড়ে কলতলা অব্দি যায়নি কোনওদিন।

যেন এরা পরম আত্মীয়, খানিকটা আড়াল হলে বিষম একা পড়ে যাবেন মা;

কাদায় পিছলে পড়বেন, বাঘে-ভালুকে খাবে, দুষ্ট জিনেরা গাছের মগডালে

বসিয়ে রাখবে মা'কে-

দুঃখগুলো মা'র সঙ্গে নিভৃতে কী সব কথা বলত...

কে জানে কী সব কথা

মা'কে দুঃখের হাতে সঁপে বাড়ির মানুষগুলো অসম্ভব স্বস্তি পেত।

দুঃখগুলোকে পিঁড়ি দিত বসতে,

লেবুর শরবত দিত, বাটায় পান দিত,

দুঃখগুলোর আঙুলের ডগায় চুন লেগে থাকত...

ওভাবেই পাতা বিছানায় দুঃখগুলো দুপুরের দিকে গড়িয়ে নিয়ে

বিকেলেই আবার আড়মোড়া ভেঙে অজুর পানি চাইত,

জায়নামাজও বিছিয়ে দেওয়া হত ঘরের মধ্যিখানে।

দুঃখগুলো মা'র কাছ থেকে একসুতো সরেনি কোনওদিন।

ইচ্ছে ছিল লোহার সিন্দুকে উই আর

তেলাপোকার সঙ্গে তেলোপোকা আর

নেপথলিনের সঙ্গে ওদের পুরে রাখি।

ইচ্ছে ছিল বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে, কেউ জানবে না,

ভাসিয়ে দেব একদিন

কচুরিপানার মতো, খড়কুটোর মতো, মরা সাপের মতো ভাসতে ভাসতে দুঃখরা

চলে যাবে কুচবিহারের দিকে...

ইচ্ছে ছিল

দুঃখগুলো মা'র সঙ্গে শেষ অব্দি কবর অব্দি গেছে,

তুলে নিয়ে কোথাও পুঁতে রাখব অথবা ছেঁড়া পুঁতির মালার মতো ছুড়ব

রেললাইনে, বাঁশঝাড়ে, পচা পুকুরে। হল কই?

মা ঘুমিয়ে আছেন, মা'র শিথানের কাছে মা'র দুঃখগুলো আছে,

নিশুত রাতেও জেগে আছে একা একা।

তসলিমা নাসরিনের রুদ্রকে লেখা সেই চিঠিটি

প্রিয় রুদ্র,

প্রযত্নে, আকাশ

তুমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলে। তুমি কি এখন আকাশ জুরে থাকো? তুমি আকাশে উড়ে বেড়াও? তুলোর মতো, পাখির মতো? তুমি এই জগত্সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছো। তুমি আসলে বেঁচেই গেছো রুদ্র। আচ্ছা, তোমার কি পাখি হয়ে উড়ে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না? তোমার সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে? ইচ্ছে তোমার হয় না এ আমি বিশ্বাস করি না, ইচ্ছে ঠিকই হয়, পারো না। অথচ এক সময় যা ইচ্ছে হতো তোমার তাই করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে - করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারাদিন পথে পথে হাটতে - হাটতে। কে তোমাকে বাধা দিতো? জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিলো। এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছো। আমার ভেবে অবাক লাগে, জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই। ওরা তোমাকে ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি রেখে এলো, তুমি প্রতিবাদ করতে পারোনি।

আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘ বছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলী খালার সাথে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন ! তুমি আর কারো সঙ্গে প্রেম করছো, এ আমার সইতো না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম ! তাই কি? যেন আমাকেই তোমার ভালোবাসতে হবে। যেন আমরা দু'জন জন্মেছি দু'জনের জন্য। যেদিন ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেলো বাড়ি থেকে, আমার খুব দম বন্ধ লাগছিলো। ঢাকা শহরটিকে এতো ফাঁকা আর কখনো লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার এতো হাহাকারও আর কখনো জমেনি। আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। আমার ঘরে তোমার বাক্সভর্তি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ ছিলো চার বছরের। এতো বছর পরও তুমি কী গভীর করে বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে ! সেদিন আমি টের পেয়েছি।

আমার বড়ো হাসি পায় দেখে, এখন তোমার শ'য়ে শ'য়ে বন্ধু বেরোচ্ছে। তারা তখন কোথায় ছিলো? যখন পয়সার অভাবে তুমি একটি সিঙ্গারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছো। আমি না হয় তোমার বন্ধু নই, তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম বলে। এই যে এখন তোমার নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক আমিই বোধ হয় অনুপস্থিত থাকি মেলায়। যারা এখন রুদ্র রুদ্র বলে মাতম করে বুঝিনা তারা তখন কোথায় ছিলো?

শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিলো। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে ... তুমি বোঝোনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এই ভেবে যে, তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছো ! তার গল্প শোনাচ্ছো ! ঠিক এইরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিলো তোমার ! আজ আরেকজনের জন্য তোমার অস্থিরতা। নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বলো? তুমি শিমুলকে নিয়ে কি কি কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে ! আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে, কেমন হয়েছে। আমি বললাম, খুব ভালো। শিমুল মেয়েটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি, তুমি তাকে ভালোবাসো, যখন নিজেই বললে, তখন আমার কষ্টটাকে বুঝতে দেইনি। তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি ঠিকই কিন্তু আর কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয়।

আকাশের সঙ্গে কতো কথা হয় রোজ ! কষ্টের কথা, সুখের কথা। একদিন আকাশভরা জোত্স্নায় গা ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের। তুমি দু চারটি কষ্টের কথা বলে নিজের লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে। "ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও"। মংলায় বসে গানটি লিখেছিলে। মনে মনে তুমি কার চিঠি চেয়েছিলে? আমার? নেলী খালার? শিমুলের? অনেক দিন ইচ্ছে তোমাকে একটা চিঠি লিখি। একটা সময় ছিলো তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। তুমিও লিখতে প্রতিদিন। সেবার আরমানিটোলার বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা। তুমি পাবে তো এই চিঠি? জীবন এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের কখনো মেটে না, তবু মানুষ আর বাঁচে ক'দিন বলো? দিন তো ফুরোয়। আমার কি দিন ফুরোচ্ছে না? তুমি ভালো থেকো। আমি ভালো নেই।

ইতি,

সকাল

পুনশ্চঃ আমাকে সকাল বলে ডাকতে তুমি। কতোকাল ঐ ডাক শুনি না। তুমি কি আকাশ থেকে সকাল, আমার সকাল বলে মাঝে মধ্যে ডাকো? নাকি আমি ভুল শুনি?

তালাকনামা

যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি আর আমার থাকো না

তুমি হও যার-তার খেলুড়ে পুরুষ।

যে কোনও শরীরে গিয়ে

শকুনের মতো খুঁটে খুঁটে রূপ ও মাংস তুমি আহার করো

গণিকা ও প্রেমিকার শরীরে কোনও পার্থক্য বোঝো না।

কবিতার চে' চাতুর্য বোঝো ভাল,

রাত্রি এলে রক্তের ভেতর টকাশ-টকাশ দৌড়ে যায়

একশো একটা লাগামহীন ঘোড়া,

রোমকূপে পূর্বপুরুষ নেচে উঠে তাধিন-তাধিন।

আমি জোস্নার কথা তোমাকে অনেক বলেছি

তুমি অমাবস্যা ও পূর্ণিমার কোনও পার্থক্য বোঝো না।

ভালবাসার চে' প্রাচুর্য বোঝো বেশি

যে কারও গোড়ালির নীচ থেকে চেটে খাও

এক ফোঁটা মদ, লক্ষ গ্যালন মদে আমুণ্ডু ডুবে

তবু তোমার তৃষ্ণা ঘোচে না।

তোমাকে স্বপ্নের অথা অনেক বলেছি

সমুদ্র ও নর্দমার ভেতরে তুমি কোনও পার্থক্য বোঝো না।

যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি হও যার-তার খেলুড়ে পুরুষ।

যার-তার পুরুষকে আমি আমার বলি না।

কাব্যগ্রন্থঃনির্বাসিত নারীর কবিতা[/b

[b]তবু ফিরব


আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর, নেত্রকোণা,

অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা

আমি ফিরব। ফিরব ভিড়ে হট্টগোলে, খরায়, বন্যায়,

অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ

আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের

পুকুরে-

অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুন্নেসা, অপেক্ষা করো ইদুল আরা,

আমি ফিরব। ফিরব ভালবাসতে, হাসতে, জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে-

অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারির বইমেলা,

আমি ফিরব।

মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে ক'ফোটা জল দিচ্ছি চোখের,

যেন গোল পুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালে একবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে।

শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে

শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষায়, বঙ্গোপসাগরে।

ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।

শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড পাহাড়- আমি ফিরব।

যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।

বিষয়: সাহিত্য

৬২৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File