প্রিয় কবি সুফিয়া কামালের ১০২তম জন্মদিন আজ
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধার মেঘমালা ২০ জুন, ২০১৩, ০৬:০৫:২৭ সন্ধ্যা
সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী জাগরণের অগ্রদূত কবি বেগম সুফিয়া কামালের ১০২তম জন্মবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৯১ সালের ২০ জুন বরিশালে শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও নারী জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ।তিনি বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক ।
কবির জন্মের সময় এদেশের মুসলিম নারীদের জীবন কাটতো বন্দীদশায় ।পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধ ছিল ।স্কুল কলেজে পড়ার কোনো সুযোগ তাদের ছিলো না ।নারীদের শিক্ষাকে প্রয়োজন মনে করা হতো না।এইরকম কঠিন পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন সুফিয়া কামাল ।স্রোতের বিপরীতে চলে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন নতুন নির্ভুল স্রোত ।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।তিনি আমাদের 'জননী সাহসিকা' ।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সাঁঝের মায়া' ।তার প্রকাশিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে মায়া কাজল, মন ও জীবন, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, দিওয়ান, মোর জাদুদের সমাধি পরে প্রভৃতি।
গল্পগ্রন্থ : কেয়ারকাঁটা(১৯৩৭) ।ভ্রমণকাহিনী : সোভিয়েত দিনগুলি(১৯৬৮)। স্মৃতিকথা : একাত্তুরের ডায়েরি(১৯৮৯) ।
সুফিয়া কামাল ৫০টির বেশী পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মাঝে কয়েকটিঃ
বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২)
সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০)
একুশে পদক (১৯৭৬)
বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯২)
জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫)
দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল (১৯৯৬)
স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯৭)
কবি ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ও শরৎচন্দ্রের দেখা পান। তিনি ছিলেন বেগম পত্রিকার সম্পাদক ।কবি ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন এ মহিয়সী নারী।আন্দোলন তাঁর জীবনের পরতে পরতে ।
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।
আমরা শিশুকাল থেকেই এই মহান কবির কবিতা পড়েছি এবং আমাদের মনে বহুবার দাগ কেটেছেন । সবুজ পাতা খামের ভেতর হলুদ গাদা চিঠির খবর কবিই আমাদের দেন প্রথম ।
প্রিয় কবি সুফিয়া কামালের লেখা কিছু কবিতা :
আজিকার শিশু
আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন ,পরী, দেও, দানা।
পাতালপুরীর অজানা কাহিনী তোমরা শোনাও সবে
মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে।
তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভূ নাহি হবে আর
আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার।
শস্য-শ্যামলা এই মাটি মা'র অঙ্গ পুষ্ট করে
আনিবে অটুট স্বাস্থ্য, সবল দেহ-মন ঘরে ঘরে।
তোমাদের গানে, কল-কলতানে উছসি উঠিবে নদী-
সরস করিয়া তৃণ ও তরুরে বহিবে সে নিরবধি
তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর
জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর।
রজনীগন্ধা
নিশীথ গভীরতর নৈঃশব্দের প্রশান্তি বিপুল,
সে নিস্তব্দ শান্তক্ষণে ফুটে ওঠে শ্বেত শুভ্র ফুল;
এক গুচ্ছ নিশিগন্ধা, অথবা দোলন-চাঁপা কুঁড়ি
পূর্ণ বিকশিত বক্ষা অকুণ্ঠিতে ক্ষীণ বৃন্ত জুড়ি।
দ্বিধা-লেশহীন চিত্তে উৎসারিত মর্ম-মধু বাসে,
নিশীথে করেছে সি্নগ্ধ অমলিন মৃদু স্মিত হাসে।
সুন্দর দিয়েছে ধরা শ্বেত শুভ্র তনু দেহ ভরি,
সহস্র তারকা চক্ষে ক্ষরিতেছে অমৃত মাধুরী।
কামনা ঘুমায়ে পড়ে মন্ত্র শান্ত ভুজঙ্গের মত
নিশীথ পরম প্রেমে আনমিত স্তব্ধ অবনত।
বৈদগ্ধ্য দাক্ষিণ্য ভারে রূপহীনা শুধু সি্নগ্ধ বাসা
সঞ্চিত মর্মের মাঝে বিন্দু মধু সিন্ধু ভালোবাসা
ঐশ্বর্যের দম্ভ নাহি নিশীথের দানে হয় ঋণী
সৌরভ-সম্পদে তবুও নিশীথে সে বিশ্ব-বিজয়িনী।
'উদাত্ত পৃথিবী' কাব্যগ্রন্থ থেকে
তাহারেই পড়ে মনে
‘হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়;
বসন্তে বরিয়া তুমি ল'বে নাকি তব বন্দনায়?'
কহিল সে সি্নগ্ধ আঁখি তুলি :
‘দখিন দুয়ার গেছে খুলি?'
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?
‘এখনও দেখনি তুমি?' কহিলাম :'কেন কবি আজ
এমন উন্মন তুমি? কোথা তব নব পুষ্প সাজ?'
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া :
‘অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি_বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই রাখিনি সন্ধান।'
কহিলাম :'ওগো কবি! রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি_ এ মোর মিনতি।'
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে :
‘নাই হ'ল-না হোক এবারে
আমারে গাহিতে গান, বসন্তের আনিতে বরিয়া_
রহেনি, সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাগুনে স্মরিয়া।'
কহিলাম : ‘ওগো কবি! অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তমি তারে করিলে বৃথাই।'
কহিল সে পরম হেলায় :
‘বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফুটেনি শাখে? পুষ্পারতি লভেনি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নাই অর্ঘ্য বিরচন?'
‘হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?'
কহিলাম :'উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা'
কহিল সে কাছে সরে আস :
‘কুহেলী উত্তরীতলে মাঘের সন্ন্যাসী
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনমতে।'
'সাঁজের মায়া' কাব্যগ্রন্থ থেকে]
বিষয়: সাহিত্য
৩২৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন