সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধার মেঘমালা ২৪ মে, ২০১৩, ০৮:০২:১৭ রাত
‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নামটি শোনার সাথে সাথে কয়েকটি শব্দ আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায় – সাম্য, বিদ্রোহ, মুক্তি, প্রতিবাদ ও প্রেম ।তিনি এই শব্দগলোকে জীবন্ত করে তুলেছেন তাঁর অস্তিত্বে আর আমাদের অনুভূতিতে ।যা আমাদের জাতীয় জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে । তিনি আমাদের জাতীয় কবি, সাধারণ মানুষের কবি ।তাঁর দৃষ্টি ছিল ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, উঁচু-নিচু সকলের প্রতি ।তিনি গেয়েছেন সাম্যের গান ।সকল মানুষ তাঁর কাছে সমান।মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি মানতে পারেননি ।আর একারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহী। তাঁর শাণিত অনুভূতি সকল বাঙ্গালীকে আজও বিদ্ধ করে ।
তিনি লিখেছিলেন,
মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
আর তাইতো যেখানে অত্যাচার সেখানে প্রতিবাদ, যেখানে প্রতিবাদ সেখানে এই লাইনগুলো উচ্চারিত হয় ।আমাদের প্রতিবাদ মিছিলে তাঁর শাণিত অনুভূতিই যেন ধ্বনিত হয় বার বার। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন তিনি। গ্রামের মকতবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্বও পালন করেন। কিশোর বয়সে থিয়েটারে কাজ করতে গিয়ে তিনি সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে সাহিত্যচর্চা শুরু করলেন। এরপর যা ঘটলো তা আমরা সবাই জানি। বিদ্রোহী, ভাঙ্গার গান কবিতা, রাজবন্দির জবানবন্দি, ধূমকেতু সাময়িকী ছিল সে সময়ের বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ ।তাঁর প্রতিবাদী ভাষা আমাদের সত্য ও সাম্যের দিকে ধাবিত করে। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে তার বিশেষ অবদান ছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতা ‘নারী’:
নারী কবিতায় কবি সাম্যের গান গেয়েছেন। তাঁর কাছে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই। পৃথিবীতে যা কিছু কল্যাণকর তাতে নারী-পুরুষ উভয়েরই অবদান রয়েছে। একইভাবে যা কিছু পাপ-তাপ তা দুজনেরই। কেননা পাপ সকলকেই সমানভাবে স্পর্শ করে। আদিকাল থেকেই এমনি ভাবেই নারী-পুরুষ সমান ভাবে জগৎ সাজিয়েছে। কিন্তু কিছু লোক নারীকে নরক-কুণ্ড বলে হেয় প্রতিপন্ন করে। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কবি বলেছেন, নারী নয় পুরুষ নিজেই নরক-কুণ্ড। পৃথিবীর এই রং-রূপ-সৌন্দর্য নারীর ভূমিকা অগ্রণী। কিন্তু হায়! যে নারী শেখালো স্নেহ-প্রেম-মায়া-মমতা তাকেই পুরুষ করেছে অবরোধ-দাসী!
পুরুষ হৃদয়হীন! কিন্তু সেই অবরোধ, দাসত্বের দিন ফুরিয়েছে। এখন সময় বেদনার, মানুষের ও সাম্যের। শিকল ভাঙ্গার দিন আজ। যে গর্ত খুড়ে নারীকে রাখা হয়েছিল তাতে পড়ার আগেই কবি পুরুষকে সাবধান করেছেন। জগতের নিয়ম এই। নিজের গর্তে নিজেকেই পরতে হয়। তাই নারী-পুরুষ সমগ্রহণযোগ্যতায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ।
নারী
কাজী নজরুল ইসলাম
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।
নরক কুন্ড বলিয়া তোমা’ করে নারী হেয় জ্ঞান?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর শয়তান।
অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল
নারী দিল তাহে রূপ-রস-সূধা-গন্ধ সুনির্মল। তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষী, গানের লক্ষী, শষ্য-লক্ষী নারী,
সুষম-লক্ষী নারীওই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারী’।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ
কামিনী এনেছে যামিনী শান্তি সমীরণ বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশিথে হয়েছে বঁধু
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে নারী যোগায়েছে মধু।
শষ্য ক্ষেত্র উর্বর হল,পুরুষ চালাল হাল,
নারী সেই মাঠে শষ্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল,সেই জল মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে
স্বর্ণ-রৌপ্যভার,
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে নর পেল কবি-প্রাণ
যত কথা হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুঢা,সুঢায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।
জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নি বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি, কত বোন দিল সেবা
বীর স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,
রানীর দরদে ধুইয়া গেছে রাজ্যের যত গ্লানি। পুরুষ-হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে অর্ধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাদের যশ ধরে নাক, অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাদের স্মরণে, করি মোরা উৎসব
খেয়ালের বশে তাদের জম্ম দিয়েছে পিতা
লব কুশ বনে ত্যাজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা!
নারী, সে শিখাল শিশু পুরুষেরে, স্নেহ-প্রেম, দয়া-মায়া
দীপ্ত নয়নে পরল কাজল, বেদনার ঘন ছায়া!
অদ্ভুত রূপে পুরুষ পুরুষে করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে নিয়ে তারে চুমিল যে তারে করিল সে অবরোধ!
তিনি নর-অবতার-
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার!
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর-
নারী চাপা ছিল এতদিন,আজ চাপা পড়িয়াছে নর!
সে-যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ,মানুষের যুগ, সাম্যর যুগ আজি,
কেহ রহিবেনা বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি!
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!
শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরিতে নারী!
করিল তোমা বন্দিনী, বল, কোন সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নৈপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পারনা; হাতে রুলি,পায়ে মল,
মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙ্গে ফেল ও শিকল!
যে ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু ঊড়াও সে আবরণ!
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ণ, ঐ যত আভরণ!
ধরার দুলালী মেয়ে
ফের না ত আর গিরিদরীবনে শাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসল “প্লুটো” যমরাজ নিশিথ পাখায় উড়ে’,
ধরিয়া তোমায় পুড়িল তাহার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি’
মরণের পুরে;নামিল ধরায় সেই দিন বিভাবরী।
ভেঙ্গে যম্পুরী নাগিনীর মত আয় মা পাতাল ফূঁড়ি।‘
আধাঁরে তোমায় পতজ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুঁড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদিন শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
সেদিন সুদূর নয়-
যে দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর ও জয়।
বিষয়: সাহিত্য
৪৩৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন