জীবনানন্দ দাশ:একটি বিষণ্ন প্রজাপতি

লিখেছেন লিখেছেন সন্ধার মেঘমালা ০৪ মে, ২০১৩, ১১:২০:২৪ রাত



বাংলাভাষার অন্যতম একজন জনপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ ।তার কবিতা মানেই উপমার জাদু ।তিনি বলেছিলেন উপমাই কবিত্ব ।তার কবিতার শব্দগুলো আমাদের মস্তিস্কে চিত্ররূপময় আবেশ তৈরি করে ।তৈরি করে আবছা বিষণ্ন আবেগ ।

আমাদের আঙ্গিনায় সারি সারি দেবদারু গাছ মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে থাকে – মহাকাল হয়ে ।ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি ডানার চিল কেঁদে কেঁদে উড়ে যায় দুরে ।তার কল্পনার তুলির রং যেন শেষ হয় না! আকাশে কাতর চোখ তুলে ঝরা পালকের ছবি একেঁছেন তিনি!

তাকে বলি রূপসী বাংলার কবি,নিজর্নতার কবি ।তিনি বাংলার প্রকৃতিকে বনর্না করেছেন চমৎকার সব রূপকের সাহায্যে ।একারনেই ধানসিঁড়ি নদী-শঙ্খচিল-রাজহাঁস-সবুজ ঘাস-নক্ষত্র-ধানক্ষেত সবকিছু আমাদের কাছে নতুন রূপে আসে ।ভোরের বেলায় কচি লেবুপাতার মত নরম সবুজ আলোয় পৃথিবী ভরে যায় ।মাঘের নীল আকাশে ডানা ঝাপটায় শালিক! তাইতো তিনি বারবার এই বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন ।

শিশুকাল থেকেই কবি লাজুক প্রকৃতির ।মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন কবি ।তার বিখ্যাত কবিতা-‘‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’’ এখনো শিশুশ্রেণীর পাঠ্য ।মূলত মায়ের অনুপ্রেরণায়ই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন ।তিনি হয়েছিলেন মায়ের কবিতার মতোই ।তাকে নিভৃতচারী নীরব কবি বললেও ভুল হয়না।

কবি জীবনানন্দ দাশ আবার এই পৃথিবীর পথে আসতে চেয়েছেন শঙ্খচিল-শালিকের বেশে ।কেন?তিনি বাংলাভাষার পঞ্চপান্ডবের একজন ।বাংলাভাষার কবিতার নতুন ধারার জন্ম হয় তার কলমে ।তার লেখা ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি বাংলাভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা ।রবীন্দ্রযুগের পর বাংলা কবিতার তিনিই প্রধান পুরুষ হয়ে ওঠেন ।তিনি আমাদের আধুনিকতম কবি ।কিন্তু সময়ের পারাপারে যান্ত্রিক জীবনের হতাশায় তার মনে দেখা দেয় বিষণ্নতা – তার হৃদয়ে পরে ধূসর রেখা ।যার প্রতিফলন আমরা পাই তার কবিতায় ।

কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা আমার কিছু প্রিয় কবিতা :



হায় চিল

জীবনানন্দ দাশ

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!

তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।

পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;

আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?

কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!



আকাশলীনা

জীবনান্দ দাশ

সুরন্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,

বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে

ফিরে এসো সুরন্জনা :

নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে ;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে ;

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার ;

দূর থেকে দূরে-----আরো দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর ।

কী কথা তাহার সাথে? তার সথে!

আকাশের আড়ালে আকাশ

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে ।

সুরন্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস :

বাতাসের ওপারে বাতাস

আকাশের ওপারে আকাশ ।



সে

জীবনানন্দ দাস

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;

বলেছিলোঃ 'এ নদীর জল

তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;

সব ক্লান্তি রক্তের থেকে

স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;

এই নদী তুমি।'

'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?'

মাছরাঙাদের বললাম;

গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।

আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;

জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে

কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।

সময়ের অবিরল শাদা আর কালো

বনানীর বুক থেকে এসে

মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে

ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো

ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি

না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।



তোমায় আমি

জীবনানন্দ দাশ

তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে

তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;

শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে

শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে

খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।

নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে

পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে

জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর

এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার

পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।

তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই

শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,

তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে

চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে

শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।

জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়

পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।

এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;

তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল

বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।



বনলতা সেন

জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর

হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'

পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।



অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ

জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়

মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

বিষয়: সাহিত্য

৩৩২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File