আল্লাহর উপর নির্ভরতা
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৭ আগস্ট, ২০১৭, ১০:২৬:৩৮ সকাল
"(হে নবী) যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে- আল্লাহ্। বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ্ আমার অনিষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যাদেরকে ডাক, তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত রোধ করতে পারবে? বলুন, আমার পক্ষে আল্লাহ্ই যথেষ্ট। নির্ভকারীগণের উচিত তাঁরই উপর নির্ভর করা (৩৯:৩৮)।”
ইসলাম আল্লাহ্ মনোনীত ধর্ম। আর এ ধর্মের অনুসারী মুসলমানগণ একমাত্র আল্লাহর কাছে সমর্পিত ও আল্লাহ্-নির্ভর এক জাতি। ঈমান আনার সাথে সাথে একজন মুসলিম অংশীবাদ থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত হয়ে যায়, একনিষ্ঠভাবে এক ও অদ্বিতীয় মহান সত্তা আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালার অভিমুখী হয় এবং একমাত্র তাঁরই আনুগত্যে নিজেকে সঁপে দেয়। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্রষ্টা সর্বশক্তিমান আল্লাহর সমীপেই ঘটে তার আত্মসমর্পণ। একমাত্র আল্লাহর দাসত্বেই সে নিজের জীবনকে বিলীন করে দেয়। তাই প্রতিদিন প্রতিটি মুসলমান পাঁচ বার আল্লাহর সামনে নামাযে দাঁড়িয়ে বলে, "আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। আমাদেরকে সরল পথ দেখাও, সে সমস্ত লোকের পথ, যাদের ওপর তুমি নেয়ামত বর্ষণ করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের ওপর তোমার গযব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত রয়েছে (১:৫-৭)।" এভাবে নামাযের প্রতি রাকাতে দাঁড়িয়ে, বসে, রুকুতে, সিজদায় বারবার আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর ওপর নির্ভরতা ও তাঁর নিকট সাহায্য কামনার আকুতি ব্যক্ত হচ্ছে। একজন মুসলমানের অবস্থা এরূপ যে, আল্লাহর নিকট সে পুরোপুরি উৎসর্গকৃত এক মানবসত্তা যা আল্লাহর নৈকট্য লাভে উদগ্রীব। পরকালের অনন্ত জীবনের পরম সুখ-শান্তির আবাস জান্নাতের বিনিময়ে দয়াময় আল্লাহ্ তাঁর মু’মিন বান্দার পার্থিব জীবনকে ক্রয় করে নিয়েছেন। তাই একজন মুসলমানের নামায, কোরবানি এবং তার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহরই জন্যে নিবেদিত হয়ে যায়। তিনিই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও মালিক এবং সব কিছুর ভাগ্যনিয়ন্তাও তিনি। তাই একজন মু’মিন মুসলমান পরম নির্ভরতায় বলতে পারে, "আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে (৬:১৬২)।" মুসলমানদের একমাত্র অভিবাবক হলেন আল্লাহ্। আর অভিবাবক ও সাহায্যকারী হিসেবে তিনিই সর্বোত্তম। আর এ কথাটিই আল্লাহ্ আরও সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, čনিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সাম্রাজ্য আল্লাহরই জন্য। তিনিই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, আর আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের জন্য কোন সহায়ও নেই, কোন সাহায্যকারীও নেই (৯:১১৬)।"
একজন মানুষের কি যুক্তি থাকতে পারে যে, সে তার স্রষ্টার আনুগত্য করবে না যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার কাছে তাকে ফিরে যেতে হবে? তিনিইতো সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তিনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়েও নেন। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন। তাঁর হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। তিনি রাতকে দিনের আলোয় আলোকিত করেন এবং দিনকে রাতের আঁধারে ঢেকে দেন। আর তিনিই জীবিতকে মৃত করেন এবং মৃতকেও জীবন দান করেন। আর তিনিই যাকে ইচ্ছা বেহিসেব জীবিকা দান করেন (৩:২৬-২৭)। মহান আল্লাহর ওপর ভরসা না করার কিইবা কারণ থাকতে পারে, যিনি আমাদেরকে সৎ পথের দিশা দেখিয়েছেন। আল্লাহর পথে সমর্পিত হওয়ার জন্যে যে নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে সেজন্যে মুʼমিনগণ ধৈর্য ধারণ করবে। ভরসাকারীগণের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত (১৪:১২)। ভাগ্যের উত্থান-পতনে ও সুখ-দুঃখে সর্ববস্থায় ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট থাকাই ঈমানের লক্ষণ। সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা রাখার মাত্রা নির্ভর করে একজন মু’মিনের ঈমানের গভীরতার ওপর। বিপদে পড়লে মানুষ অনেক সময় দিশেহারা হয়ে পড়ে। ঈমানী দুর্বলতার কারণে এ সময় তার আল্লাহর ওপর নির্ভরতা কমে যায়। মানুষের জীবিকার ব্যাপারেও তাই ঘটে। কেউ যদি একজনের রিযেকের দ্বার বন্ধ করে দেয়, তবে তার জন্য শত দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। কারণ আল্লাহর দুনিয়া অনেক প্রশস্ত। তিনি তাঁর বান্দাদের সূক্ষাতিসূক্ষ প্রয়োজন সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। পৃথিবীতে এমন অনেক জীব রয়েছে, যারা তাদের খাদ্য সঞ্চয় করে রাখে না। আল্লাহই čতাদেরকে তাদের ধারণাতীত উৎসা থেকে রিযিক দান করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ্ তার কাজ পূর্ণ করে দেন। আল্লাহ্ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন (৬৫:৩)। "আল্লাহর বান্দাদের উচিত তাঁরই ইবাদত করা এবং তাঁরই ওপর ভরসা রাখা। তিনি তাদের যাবতীয় কার্যকলাপ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞাত। čআল্লাহর ওপরই নিশ্চিত ভরসা রাখা উচিত যিনি সবারই প্রতিপালক। পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যা তাঁর পূর্ণ আয়ত্তাধীন নয়। তাঁর প্রদর্শিত সরল পথে কোন সন্দেহ নেই (১১:৫৬)।"
আল্লাহর ওপর নির্ভরতার ক্ষেত্রে আল্লাহর নবী ও রাসুলগণ ছিলেন সবার অগ্রগামী। তাঁরা অপরিসীম ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে সব সময় সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর নির্ভর করেছেন এবং একমাত্র তাঁরই সাহায্য কামনা করেছেন। তাঁরা আল্লাহর তরফ থেকে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছিলেন মানুষের কাছে হেদায়েত পৌঁছানোর কাজে। তাঁদের অধিকাংশেরই ছিল না কোন পার্থিব সহায়-সম্বল, ছিল না কোন অর্থসম্পদ ও লোকবল, ছিল শুধু ঈমানী শক্তি ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতা। তাঁরা সবাই ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী, ন্যায়ের প্রতীক এবং সৎ কাজের আদেশদাতা ও অসৎ কাজের নিষেধকারী। তাঁরা ছিলেন একদিকে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের সফলতা ও কল্যাণের সুসংবাদদাতা, অপরদিকে আল্লাহর কঠোর আযাবের সতর্ককারী। মানব কল্যাণে আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য তাঁরা লাভ করেছিলেন আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মোযেজা। নিজ সম্প্রদায় তথা গোটা মানব জাতিকে তাঁরা আল্লাহ্ মনোনীত সরল-সঠিক পথের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা তাদের এ মহৎ কর্মের জন্য নিজ সম্প্রদায়ের নিকট কোন পারিশ্রমিক দাবী করেননি। বরং তাঁরা বলেছেন, আমাদের প্রতিদানতো আমাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে। সর্বাবস্থায় তাঁরা মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করেছেন। আল্লাহ্ নির্ভরতার দিক থেকে তাঁরা ছিলেন মানব জাতির নিকট দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। নমরুদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কঠিন সময়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ধৈর্য ধারন করলেন এবং আল্লাহর ওপর নির্ভর করলেন। আগুনের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এলো: "হে অগ্নি, তুমি ইব্রাহীমের উপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও (২১:৬৯)।” ফেরাওনের সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের মুখে নীল নদের তীরে হযরত মূসার (আঃ) সঙ্গীরা যখন বলল, আমরা যে ধরা পড়ে গেলাম, তখন মূসা পরম নির্ভরতার সাথে বললেন, "কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে পথ বলে দেবেন (২৬:৬২)।" আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) আল্লাহ্ তায়ালার ওপর পরম নির্ভরতার অনেক ঘটনাই আমরা জানি। চরম বিপদেও তিনি ধৈর্যহারা হতেন না, বরং পরম নির্ভরতায় আল্লাহর ওপর ভরসা করতেন। শত্রুপক্ষের সামাজিক বয়কট কালে আত্মীয়-স্বজন ও সঙ্গী-সাথীসহ হযরতকে মক্কার অদূরবর্তী শেবা উপত্যকায় দীর্ঘ দুই বছরকাল দুঃসহ নির্বাসিত জীবন কাটানোর সময়ে, হিজরতের সময় শত্রুর পশ্চাদধাবন কালে ছওর গুহায় আশ্রয়রত অবস্থায়, বদর-ওহুদ-খন্দক-হুনায়েনের যুদ্ধের কঠিন সঙ্কটকালে, হুদায়বিয়ার দুরূহ সন্ধির সময় এবং বিভিন্ন নাজুক পরিস্থিতিতে তাঁর ধৈর্য ও মহান আল্লাহর ওপর তাঁর পরম নির্ভরতা মানব জাতির জন্য বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয়। তায়েফে ধর্ম প্রচার কালে তাঁকে ও তাঁর সহচর যায়েদ (রাঃ) কে উন্মাদ বলে প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) শুধু ধৈর্যই ধারণ করেননি, বরং ভরসা করেছেন মহান আল্লাহর রহমতের ওপর। অভিশাপের বদলে এসব পাপিষ্ঠদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন যাতে তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়। মানবতার মহান নবীর এমনই ছিল আল্লাহ্ নির্ভরতা।
মানুষের বিপদে-আপদে, দুঃখ-বেদনায়, ভ্রান্তি-অনুশোচনায়, ব্যর্থতায়-নিরাশায় আল্লাহ্ মানুষের অতি নিকটে অবস্থান করেন। বান্দা যখন একনিষ্ঠ চিত্তে আল্লাহকে ডাকে তখন তিনি তাদের ডাকে সাড়া দেন। একমাত্র তিনিই তাদের পরম নির্ভরযোগ্য সাথী ও সহায়তা দানকারী। মানুষ সব সময়ই অভাবগ্রস্ত ও আল্লাহর নিয়ামত ও রহমতের ওপর মুখাপেক্ষি। তাই মানুষ তার যাবতীয় প্রয়োজনের কথা আল্লাহর নিকট পেশ করে। ভাগ্যের ভাল ও মন্দের মালিক আল্লাহ্। আল্লাহই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন এবং তাকে জীবিকা প্রদান করেন। তাই একজন কৃতজ্ঞ বান্দার উক্তি হলো, "আল্লাহ্ আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে পথপ্রদর্শন করেন, তিনি আমাকে খাদ্য ও পানীয় দান করেন, আমি যখন রোগাক্রান্ত হই, তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন। তিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর পুনর্জীবন দান করবেন (২৬:৭৮-৮১)।" যারা ঈমান ও নেক আমল নিয়ে সততার সাথে কাজ করে যাবে তারা নিঃসন্দেহে আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে, এটার আল্লাহর ওয়াদা। কোন বান্দা যদি সচেষ্ট হয়ে ধৈর্যের সাথে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তবে তার সাফল্য অনিবার্য। তিনি তার বান্দার সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়ের খবর রাখেন। তাঁর বান্দার জন্য তাঁর সাহায্যই চূড়ান্ত। তিনি কারো উপকার করতে চাইলে তা যেমন রোধ করার শক্তি কারো নেই, তেমনি তিনি যদি কাউকে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত করেন তবে তার সহায়তাকারী কেউ নেই। তাই আলালাহ্ বলেন, "যদি আল্লাহ তোমাদের সহায়তা করেন, তাহলে কেউ তোমাদের উপর পরাক্রান্ত হতে পারবে না। আর যদি তিনি তোমাদের সাহায্য না করেন, তবে এমন কে আছে, যে তোমাদের সাহায্য করতে পারে? আর আল্লাহর ওপরই মুসলমানগনের ভরসা করা উচিত (৩:১৬০)।" আমাদের নবীর (সাঃ) এ দোয়াটি আল্লাহ্ নির্ভরতার ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে: ʼইয়া আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট আত্মসমর্পন করছি, আপনার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করছি, আপনার দিকে মুখ ফেরাচ্ছি এবং আপনার তুষ্টি বিধান করছি। ইয়া আল্লাহ্! আপনার আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি; একমাত্র আপনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য অন্য কেউ নেই, যে আমাকে বিপথগামীতা থেকে নিরাপত্তা দিবে। আপনি চিরঞ্জীব, আপনিই সৃষ্টির বিরাজমান সবকিছুর সংরক্ষক ও নিরাপত্তা দানকারী, আপনি অমর আর মানুষ ও জ্বিন মরণশীল।'
বিষয়: বিবিধ
১২৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন