বাঙালী মুসলমানের আত্মোপলব্ধী - পর্ব - ২ (পুনর্লিখিত)
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২৭ এপ্রিল, ২০১৭, ১০:১৭:০১ রাত
বাংলাভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি সর্বপ্রথম স্বীকৃতি পায় মধ্যযুগের মুসলিম শাসনামলে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের গবেষক ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে সাধারণ জনগণের ভাষা বাংলার সাথে একাত্ম হয়ে কিভাবে বাংলার মুসলিম শাসকগণ বাংলাভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করেছেন তার এক ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেছেন। বাংলার মুসলিম সুলতান নসরত শাহ্, হুসেন শাহ্ ও শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের আমলে বাংলাভাষার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন ঘটে। বাংলাভাষা সংস্কৃতভাষার প্রভাবমুক্ত হয়ে একটি পরিপূর্ণ ভাষা রূপে মুসলিম রাজদরবারে মর্যাদা লাভ করে এবং সরকারের স্থানীয় কর্মকান্ডে গৃহীত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে গৌড়ের সুলতান নসরত শাহের রাজত্বকালে সর্বপ্রথম ‘রাময়ণ’ ও ‘মহাভারত’ মহাকাব্য দু’টি বাংলায় অনুদিত হয়। সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের উৎসাহে কবি মালাধর বসু হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীমদ্ ভগবৎ গীতা’ এর কয়েকটি অধ্যায় বাংলায় অনুবাদ করে ‘গুণরাজখান’ উপাধি লাভ করেন। এছাড়া এ সময়ে দৈনন্দিন সরকারী কর্মকান্ডে ও দলিল-পত্রে বাংলাভাষার প্রচলন শুরু হয়। মধ্যযুগে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে মুসলিম শাসকদের অবদান ইতিহাসের একটি স্বীকৃত বিষয়। এ সময়েই বাংলাভাষা সংস্কৃতভাষার কৌলীন্যকে পাশ কাটিয়ে এবং গ্রামীন কুঁড়েঘর ছেড়ে সাহিত্যের রাজপথে চলার সামর্থ্য অর্জন করে। মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা সন প্রবর্তিত হয় এবং তা রাজকীয় খাজনা আদায়ের সন হিসেবে সরকারী মর্যাদা লাভ করে। অথচ হিন্দু সেন রাজাদের আমলে এ দেশের সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলাকে অচ্ছুৎ করে রাখা হয়েছিল। রাজদরবারে বাংলা ভাষার প্রবেশাধিকার ছিল না। হিন্দু ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণ সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ওপর শুধু ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা জারী করেই ক্ষান্ত হননি, ‘রৌরব’ নামক এক নিকৃষ্ট নরকের ভয়ও প্রদর্শন করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বুকের রক্ত ঢেলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেমন ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্ব সভায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তেমনি আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারীর ʼভাষা শহীদ দিবসটিʼ বিশ্ব পরিমন্ডলে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মর্যাদায় আজ অভিষিক্ত হয়েছে। এ দেশের মানুষের নিরলস সংগ্রামের ফলেই আজ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি এক বিশ্বজনীন মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।
বৃটিশ আমলে মুসলিম সমাজের জাগরণকে যারা শুধুমাত্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার জাগরণ হিসেবে দেখেন তারা তৎকালীন বাস্তবতাকেই স্বীকার করেননা। মুসলমান সম্প্রদায়ের এ জাগরণের পেছনে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণগুলো সম্মিলিতভাবে প্রাধান্য লাভ করেছিল। জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর শোষণ-নিপীড়ন, সামাজিক অবমাননা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, এসব মিলিয়ে মুসলিম সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন ও অবদমিত করে রাখার প্রবণতা তাদের মধ্যে এক স্বাতন্ত্র্যবোধের জন্ম দেয় - যা ধর্মের ভিত্তিতে তাদেরকে হিন্দু বাঙালী সম্প্রদায়ের বিপরীতে পৃথক এক মুসলিম বাঙালী সম্প্রদায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। ১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হলেও এদেশের অধিকার সচেতন মানুষের স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম কখনও স্তিমিত হয়ে যায়নি। বৃটিশ আমলে তাদের লড়াই যেভাবে চলেছিল ঠিক তেমনি পাকিস্তানী স্বৈরশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধেও তারা লড়াই করেছিল নিরন্তর। ভাষার অধিকার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার সব বাসনাই পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। অবশেষে লাখো শহীদের খুনে রাঙা বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে। পূর্ববাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে এক স্বতন্ত্র সত্তায় রূপ দান করতে সক্ষম হয়েছে। তারা তাদের ভাষাকে বুকের রক্ত ঢেলে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করেছে। বাংলাদেশ এখন শুধু একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত নয়, বাংলাদেশের মানুষ একটি আত্ম-মর্যাদাশীল জাতি হিসেবেও বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। বাঙালী মুসলমানেরা ইতিহাসের এক পোড়-খাওয়া জাতি। ইতিহাসের গতি ধারায় ধর্মীয় ও সামাজিক ভেদাভেদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণ-নিপীড়ণের বিরুদ্ধে বাঙালী মুসলমানের অব্যাহত লড়াইয়ের ফসল হিসেবে তাদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জন্ম নেয়। নিরন্তর এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই জাতিসত্ত্বার উদ্ভব ঘটে। বাঙালী মুসলিম পরিচয়ে তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি এবং ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত বাঙালী মুসলমান ইসলামের উদারনৈতিক ভাবধারায় পুষ্ট বলেই দেশে অন্যসব সম্প্রদায়ের লোকেরা বাংলাদেশে তাদের স্ব স্ব অধিকার নিয়ে উন্নত জীবন যাপন করতে পারছে, জাতীয় সকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করছে।
এক ঐতিহাসিক বাস্তবতায় তৎকালীন পূর্ববাংলা অর্থাৎ বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ আপন স্বকীয়তায় বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো লাখো শহীদের রক্তে রাঙা স্বাধীনতা বাঙালীর সর্বোচ্চ অর্জন। সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত আত্মোৎসর্গে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিগত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লক্ষ্যণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এসব সাফল্য এসেছে কৃষি, শিল্প ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বিকাশের কারণে। কৃষিতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচিত হয়েছে। খাদ্য-শস্য উৎপাদনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভের কাছাকাছি। পোষাক শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় শীর্ষতম - অর্থাৎ চীনের পরেই। বাংলার ঐতিহ্য পাট শিল্পের বাজারও ক্রমশ উন্নতির দিকে। বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী উৎপাদন ও রপ্তানীতে অগ্রগতির হার উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রবাসীদের পাঠানো তিন বিলিয়ন ডলারের বেশী বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে এখন স্ফীত বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১ সাল নাগাদ বার্ষিক চার হাজার ডলারের মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ জাতিসংঘের এমডিজি’র লক্ষ্য অর্জনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য। সামজিক খাতের অনেক সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান থেকেও এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট টীম আজ বিশ্বের ক্রীড়া জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে উন্নত, সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রেও তারা অনেক উচ্চপদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। নিজ দেশে তাঁরা স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল।
এর বিপরীতে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকালে দেখি সেখানে স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পরও হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক তিক্ততার অবসান হয়নি। ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মান্ধ ও উগ্র সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি’র উত্থান শুধু ভারতেই নয় উপমহাদেশের সর্বত্র উত্তেজনার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। আসলে বর্তমান হিন্দুত্ববাদী ভারতে ধর্মনিরক্ষপেতার অস্তিত্ব আছে কিনা তা বুঝার উাপায় নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবাংলার জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মুসলমান হলেও শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও চাকুরীর ক্ষেত্রে তারা এখনও অনেক পিছিয়ে। বিবিসি বাংলা সূত্রে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার একটি তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী কোলকাতার পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘মুসলমানের কথা’ নামে এ তথ্যচিত্রটির পরিচালক সৌমিত্র দস্তিদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাজ্যে যে প্রায় ২৫% বাঙালি মুসলমান আছেন, তাঁদের মাত্র দুই শতাংশ সরকারি চাকুরিতে রয়েছেন। বেসরকারি ক্ষেত্রের অবস্থাটাতো আরও খারাপ। যদি শিক্ষক-অধ্যাপকদের মধ্যে মুসলমান খুঁজতে যান, খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হবে। এমনকি মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও মাত্র জনাকুড়ি মুসলমান সাংবাদিক খুঁজে পেয়েছি এই তথ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে।” তাঁর তথ্যচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের করুণ অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “যে গ্রামেই গেছি, সেখানেই খোঁজ পেয়েছি অনেক ১৩-১৪ বছরের কিশোরের যারা বড় বড় শহরে নির্মাণ শিল্পে কাজ করতে গেছে। যদি এখানে অর্থনৈতিক অবস্থাটা ভালই হবে, তাহলে ওইটুকু বাচ্চা ছেলেদের গ্রাম-পরিবার ছেড়ে কেন কাজ করতে যেতে হবে বাইরে?” প্রশ্ন সৌমিত্র দস্তিদারের। কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা অনেকটাই পিছিয়ে, সেই তথ্য প্রথম উঠে এসেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি ‘সাচার কমিশনের’ প্রতিবেদনে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো খুবই নিরাপত্তাহীন ও নির্যাতনের শিকার। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং সেখানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি এবং মুসলমান হত্যাযজ্ঞ চালু রাখা হয়েছে। ভারতে গোমাংস খাওয়ার কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও হত্যাকান্ড ঘটে চলছে অহরহ। বৃটিশ আমলের সে পুরোনো মুসলিম বিরোধী মনোভাব থেকে ভারতীয় সমাজ এখনও বেড়িয়ে আসতে পারেনি। ভারতের এ ধরনের মনোভাব থেকে আমাদের সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে ভারত চেয়েছিল নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই দেশটিকে তারা ভুটানের মত আজ্ঞাবহ করে রাখাতে পারবে। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ হযনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারতীয় কঠোর মনোভাব ও আচরণ বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ককে জটিল ও কন্টকিত করে তোলে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও গঙ্গা নদীর পানির একতরফা প্রত্যাহার নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে প্রথম চিড় ধরে। এরপর তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তির মূলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বহু বছর ধরে। বাংলাদেশ থেকে ʼমানব-পাচারʼ রোধের নামে সীমান্তে হাজার হাজার মাইল জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া তৈরী করেছে ভারত। অথচ সরকারী তথ্যমতে প্রায় দশ লাখ ভারতীয় কর্মী বাংলাদেশে কাজ করছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীব গুলিতে শত শত নিরস্ত্র বাংলাদেশী হত্যা, বাংলাদেশের পণ্য আমদানীতে ভারতের নানান ধরনের শুল্ক-অশুল্ক বাধা আরোপ, দীর্ঘ কাল ক্ষেপনের পর সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন, বাংলাাদেশী টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা, ছোট-বড় আরও অনেক ক্ষেত্রে উভয় দেশের সম্পর্ককে কন্টকিত করে রেখেছে ভারত। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নানাভাবে ট্র্যানজিটসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে ভারতের মনস্তুষ্টির চেষ্টা করছে, আশা হয়তো ভারত একটু উদার মনোভাব দেখাবে। কিন্তু একমাত্র আশ্বাসের বাণী ছাড়া তেমন কোন বাস্তব উদারতা ভারত এখনও দেখায়নি। বরং অপ্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে এক বিপুল অঙ্কের ঋণের জালে আবদ্ধ করেছে। বড় দেশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের যে উদার মনোভাব পোষণ করা উচিত ছিল তাদের মানসিক সংকীর্ণতার কারণে তা কখনও হয়ে উঠেনি।
ভারতের অভ্যন্তরীন অবস্থা যত কুৎসিতই হোক, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার বিরাট অবদানের কথা আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে। ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে আমাদের স্বাধীনতা দীর্ঘায়িত ও কষ্টকর হতো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রতিবেশী ভারতের সাথে যেমন আমাদের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, তেমনই আমাদের জাতীয় স্বার্থ, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভারতীয় আগ্রাসন থেকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর চক্রান্ত ও মদদে বিশ্ব জুড়ে ইসলামের নামধারী কিছুসংখ্যক উগ্রবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে দেশীয় একটি উগ্রবাদী চক্র। এদের মাধ্যমে অসহিষ্ণুতা ও হিংসাত্মক কর্মকান্ডের জাল বাংলাদেশেও বিস্তারের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। ক্ষমতার মোহে ধর্মীয় লেবাসে রাজনীতিকে করা হচ্ছে বিতর্কিত ও বিপথগামী। কিন্ত বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা কখনই শেকড় গাড়তে পারেনি। অতীতে এদেশের মানুষ যেভাবে ইসলামের একত্ববাদ, সাম্য ও মৈত্রীর বাণীকে সহজভাবে ধারণ করে মুসলমান হয়েছিল আজও তারা ইসলামের সেই আদর্শ ও ভাবধারাকে ঠিক একইভাবে লালন করে চলেছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং সব সম্প্রদায়ের সাথে সহাবস্থানে বিশ্বাসী। এই ধর্মে বল প্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার ভেকধারী আমাদের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবি ইসলামের নাম শুনলেই নাক সিটকায়। ইসলামকে বাদ দিয়ে বাঙালী সংস্কৃতির কল্পনা করে তারা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করে তারা সেক্যুলার সাজতে চায়। তারা কি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করতে চায়? তারা কি দেখে না ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো নাটক, গল্প, সিনেমায় এবং গান ও কবিতায় হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে কিভাবে বিকশিত করছে? ইসলামের বিরোধীতা তাদের এক ধরনের উন্নাসিক মানসিকতা। পাকিস্তানের সাথে আমাদের ধর্মীয় বিরোধ ছিল না, বরং অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং স্বৈরাচারী শাসন, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিরোধটাই ছিল প্রবল। তখন বাংলাকে আমরা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলাম। সেসময় ছয় দফা ছিল আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ। এটা উপেক্ষিত হলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা বাংলার জনগণই শুরু করেছিল। ভারত তাদের প্রধান শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছিল। বৃটিশ আমলেও আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি বৃটিশরাজ ও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। এ দেশের নব্বই শতাংশ মুসলমানের সাথে বাকী দশ শতাংশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ধর্মাবলন্বীদের কোন বিরোধ নেই। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান আমরা সবাই বাঙালী, এই দেশেরই সন্তান। আমাদের দেশপ্রেমবোধ আমাদের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ও রক্তদান এটাই প্রমাণ করেছে। আমাদের দেশপ্রেমবোধ ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা এ দেশের ভবিষ্যত বিনির্মাণে সঠিক পথ দেখাবে। বাঙালী মুসলমান হিসেবে এ হলো আমাদের সত্যিকার আত্মপোলব্ধী। (সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন