বাঙালী মুসলমানের আত্মোপলব্ধী- পর্ব - ১ (পুনর্লিখিত)

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১১:০৯:৫২ রাত

প্রতিটি জাতিরই একটা আত্মপরিচয় আছে। আত্মপোলব্ধীর জন্য আত্মপরিচয় জানার গুরুত্ব অপরিসীম। এ পৃথিবী জুড়ে কত জাতি, গোত্র, সম্প্রদায়, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ বসবাস করছে তার ইয়ত্তা নেই। সবাই আমরা আদি পিতা আদমের সন্তান। তবে এই বৈচিত্রময় পৃথিবীতে মানুষ যাতে তার নিজস্ব পরিচয়ে তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ নিয়ে একত্রে বসবাস করতে পারে সে জন্য মহান আল্লাহ্ বিভিন্ন জাতি, গোত্র ও সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন, "হে মানব জাতি! তোমাদেরকে আমি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো (৪৯:১৩)।" আল্লাহর এ অমোঘ নিয়মে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় আমরা বাঙালী জাতি। এই বাংলার বুকে আমাদের জন্ম। এখানকার মাটি, পানি, আলো ও বাতাসে আমরা লালিত-পালিত। বাঙালী হিসেবে পরিচয় আমরা বাংলাদেশের অধিবাসী এবং বাংলাভাষী। আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় আমরা কথা বলি। এদেশের মাটির রূপ-রস-গন্ধ ও খাদ্য-পানীয়ে আমরা পরিপুষ্ট। আমাদের রক্তধারায় বাঙালীর রক্তস্রোত প্রবাহিত। তাই নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে জাতি হিসেবে আমরা বাঙালী। এটা আমাদের জন্মগত একটা স্বাভাবিক পরিচয়। এ পরিচয়ের বাইরেও আমাদের আরেকটি পরিচয় আছে। তা হলো আমাদের ধর্মীয় পরিচয়। আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস - যার ভিত্তিতে আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিদিনের জীবনাচরণ, কর্ম ও চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ধর্মীয় দিক থেকে এদেশের নব্বই শতাংশ অধিবাসী ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাই আমাদের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর অপর পরিচয় হলো আমরা মুসলমান। নবী করিম (সাঃ) বলেছেন ʼপ্রতিটি শিশুই ইসলাম ধর্মে জন্মগ্রহণ করে, অতপর সে যে পারিবারিক পরিবেশে লালিত-পালিত হয়ে বড় হয় তখন সে তার পিতামাতার ধর্মকেই গ্রহণ করে।ʼ এর দ্বারা তিনি এটাই বুঝিয়েছেন প্রতিটি শিশুই প্রকৃতিগতভাবে মুসলমান। এ সবকিছুর সমন্বয়ে আমাদের যে পরিচয় দাঁড়ায় তা হলো আমরা বাঙালী মুসলমান। এ দুʼয়ের সংমিশ্রণেই গড়ে ওঠেছে বাঙালী মুসলমানের সংস্কৃতি। অপরদিকে বাংলার অপর এক প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু বাঙালী। তাদের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এ কারণে উভয় সম্প্রদায় বাঙালী হলেও ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে উভয়ের জীবনাচরণ ও সংস্কৃতিতে রয়েছে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য। এসব পার্থক্য ও বৈচিত্র সত্ত্বেও এ দুই সম্প্রদায় একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক ধারার উত্তরাধিকারী। বাঙালীত্বের সাথে যেমন হিন্দুত্বের বিরোধ নেই, তেমনি বাঙালী পরিচয়ের সাথ ইসলামের কোন বিরোধ নেই। বাংলার উভয় সম্প্রদায়ই স্ব স্ব অবস্থানে বাঙালীত্বকে ধারণ করে আছে। এ উভয় সম্প্রদায়ই প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব নিয়ে তাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে যুগ যুগ ধরে সহবাস্থান করছে।

ইতিহাসের গতিধারায় এক সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাঙালী সমাজে বিভাজনের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসকে এ বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় হিন্দু বাঙালী ও মুসলমান বাঙালী এ দুইটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার উদ্ভব ঘটে। আমাদের আত্মোপলব্ধীর জন্য এ বিভাজনের ইতিহাস জানা প্রয়োজন। গ্রাম বাংলার বাঙালী সমাজ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। এর পূর্বে তাদের অধিকাংশই ছিল নিচু বর্ণের হিন্দু। হিন্দু রাজন্যবর্গের শাসনামলে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দ্বারা তারা ছিল নিগৃহীত ও শোষিত এবং জাতিভেদপ্রথা ও বর্ণ-বিদ্বেষের শিকার। ধর্ম-কর্ম ও সামাজিকতায় তারা ছিল অচ্ছুৎ ও অপাঙক্তেয়, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল অবহেলিত। ইতিহাসের এ পর্যায়ে বাংলার বুকে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। মুসলিম রাজন্যবর্গের সাথে এ দেশে আসেন শত শত ধর্মপ্রাণ সূফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়া। তাঁরা স্থাপন করেন খানকাহ ও মসজিদ এবং প্রচার করতে থাকেন ইসলামের একত্ববাদ, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী। ইসলামের ভেদাভেদহীন সামাজিক সাম্য, সহজ সরল জীবন বিধান ও ন্যায়নীতি গ্রাম বাংলার নিপীড়িত বাঙালী সমাজকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁরা এসব ধর্মপ্রচারকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বাঙালী মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং এক সময়ে তারা বিপুল জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার বুকে হিন্দু ও মুসলিম দুʼটি সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে একত্রে বসবাস করছে। মুসলিম শাসনামলে বাংলার বুকে এ দুʼটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। বাংলার শেষ স্বাধীন শাসক নবাব সিরাজৌদ্দলা ক্ষমতালোভী মীরজাফরদের চক্রান্তে পলাশীর যুদ্ধে বিদেশী শক্তি ইংরেজদের নিকট পরাজিত হলে ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নেমে আসে বাংলার কৃষক, কৃষি ও শিল্পের ওপর মহাদুর্যোগ। ইংরেজ শাসনের মাত্র তেরো বছরের মধ্যেই তাদের চরম লুটপাট, শোষণ ও নিপীড়নের কারণে ১৭৭০ সালে এক মহাদুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়ে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ফলে বাংলা এক মহাশ্মশাণে পরিণত হয়। এত বড় একটি দুর্ভিক্ষও ইংরেজ বেনিয়াদের লুটসর্বস্ব শোষণ ও দুঃশাসনকে থামাতে পারেনি। তাদের আড়াইশত বছরের দুঃশাসনের পেছনে ছিল ষড়যন্ত্র ও বিভেদের নীতি।

বৃটিশ শাসনের পূর্বে দীর্ঘ ছয়শত বছর এদেশের প্রধান দুই সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠী শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছিল। এ দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে তাদের মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কোন নজীর ছিল না। বরং এ উভয় সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে বাংলার কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিরাট অবদান রাখে। বাংলার মুসলিম সুলতানদের অসাম্প্রদায়িক শাসন ও পীর-দরবেশ-আওলিয়াদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইসলাম প্রচারের ফলে দেশে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিরাজমান ছিল। কিন্তু বৃটিশ রাজ ʼবিভেদের মাধ্যমে শাসনের নীতিʼ প্রয়োগ করে এ দুইটি সম্প্রদায়ের শান্তি, সম্প্রীতির ও ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরায়। বৃটিশরা ইচ্ছেকৃতভাবেই বর্ণবাদী হিন্দু শ্রেণীকে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যাপক পৃষ্টপোষকতা দেয়। জমিদারী, সরকারী চাকুরী, ও ইংবেজী ভাষা শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা বৃটিশের আনুকুল্য লাভ করে। এর ফলে সমাজের হিন্দুদের মধ্যে এক অগ্রসরমান ও বিত্তশালী ʼভদ্দরলোকʼ শ্রেণীর অভ্যুদ্বয় ঘটে। এরা ছিল বৃটিশদের ভক্ত ও অনুগত এবং তাদের শাসন কাজ পরিচালনার জন্য এক নিরাপদ হাতিয়ার। বৃটিশ ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে যে শোষণ-নিপীড়নমূলক জমিদারি ব্যবস্থা চালু করেছিল, বৃটিশদের সহায়তায় হিন্দু বাবু ভদ্দরলোকগোষ্ঠী ছিল এই নব্য জমিদারি ব্যবস্থার পুরোপুরি উপকারভোগী। তাদের জমিদারির তালুকগুলো সবই মুসলিম অধ্যুসিত পূর্ববাংলায় অবস্থিত হলেও তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো রাজধানী কোলকাতা শহরে। এসব বাঙালী হিন্দু বাবু-ভদ্দরলোক-জমিদারগণ বৃটিশরাজকে খুশী রাখার জন্য বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কখনও আপন করে নিতে পারেনি। পূর্ব বাংলার মুসলমান কৃষিজীবি জনগোষ্ঠী ছিল তাদের প্রজা ও শোষণ-শাসনের শিকার। তাদের কাছে মুসলমানগণ বাঙালী বলে স্বীকৃতি পায়নি।

বৃটিশরাজের প্ররোচনায় নব্য হিন্দু আমলা, বুদ্ধিজীবি ও কবি-সাহিত্যকদের অধিকাংশের মধ্যেই প্রবল সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টি হয়। তাঁরা মুসলমানদেরকে অচ্ছুৎ কৃষক প্রজা হিসেবেই গণ্য করতে লাগলেন। তাই তাঁদের লিখিত কবিতা, উপন্যাস, গল্পে, নাটকে ও রচনায় বাঙালী মুসলিম জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখের কাহিনী ও জীবনচিত্র খুব অল্পই আমরা পেয়ে থাকি। যদি বা কিছু এসে থাকে তবে তার বেশীরভাগই চাকর-বাবুর্চি-দারোয়ান এসব চরিত্রের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকেও কোন ইসলামী শব্দ ব্যবহারে তারা ছিল ঘোর বিরোধী। তারা হিন্দু সংস্কৃতিকেই বাঙালী সংস্কৃতির ধারক-বাহক বলে মনে করতেন। তাদের অগ্রনায়ক বঙ্কিম বাবু ছিলেন নব্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের একজন নিষ্ঠাবান প্রতিভূ। বাংলা সাহিত্যের এই কীর্তিমান পুরুষ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র একজন অনুগত বৃটিশ আমলাও ছিলেন বটে। তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উদ্গীরণ করতে থাকেন। তিনি ছিলেন ঘোর সাম্প্রদায়িক এবং সাম্প্রদায়িক-বিদ্বেষের জনকও বটে। তাঁর সাহিত্যকর্মই বলে দেয় তিনি কি পরিমাণ মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন। মুসলিম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ তাঁর লিখিত গ্রন্থ ʼআনন্দ মঠʼ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার এক রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে হিন্দু বাঙালী সমাজে ব্যাপক সমাদর লাভ করে। এ গ্রন্থে তাঁর রচিত ʼবন্দে-মাতরমʼ গানটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। বিদ্বেষপুর্ণ সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে দীক্ষিত তৎকালীন হিন্দু সমাজ মুসলমানদেরকে ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে, ইত্যাদি গালাগালে আখ্যায়িত করে। বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়াও আরও অনেক হিন্দু কবি সাহিত্যিক মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকেন। তারা মনে করতেন হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিই একমাত্র বাঙালী সংস্কৃতি, তাতে মুসলিম ধর্মীয় সংস্কৃতির কোন স্থান নেই। পশ্চিম বাংলায় এখনও এ মানসিকতা বিরাজ করছে। সেখানকার কেউ কেউ মুসলমানদেরকে বাঙালী জাতি হিসেবেই গণ্য করতে চায় না। সেখানকার অবহেলিত ও পশ্চাপদ মুসলিম জনগোষ্ঠী এখনও নির্মম বঞ্চনার শিকার।

বৃটিশদের সাথে অসহযোগিতা এবং ইংরেজী শিক্ষায় অনীহার কারণে বাঙালী মুসলমানরা প্রতিবেশী হিন্দুদের চেয়ে সব ক্ষেত্রেই বেশ পিছিয়ে পড়েছিল। একদিকে হিন্দু জমিদারশ্রেণী অন্যদিকে ইংরেজ নীল-কুঠিয়ালদের সম্মিলিত শোষণ ও অত্যাচার নিপীড়নে বাংলার কৃষকদের মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি করে। এর পরিণতিতে সমগ্র বাংলা জুড়ে কৃষক বিদ্রোহ, নীল-বিদ্রোহ, ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহ দেখা দেয়। এসব বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন বাংলার বাঁশের কেল্লার নায়ক শহীদ তীতুমীর, ফকির মজনু শাহ, কৃষকনেতা নুরুল দীন, প্রমুখ। অপরদিকে হায়দরাবাদের টিপু সুলতান, সীমান্ত প্রদেশের শহীদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী, প্রমুখ বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত হন। এ উত্তাল সময়কালে ১৮৫৭ সালে ভারত জুড়ে বৃটিশদের নিয়োগকৃত দেশীয় সিপাহীরা বিদ্রোহ করে। তারা শেষ মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে পরাভূত হলে সমগ্র ভারতবর্ষ ইংরেজদের পদানত হয়। বৃটিশরাজ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ^াস, হিংসা, বিদ্বেষ, বিভেদ ও কলহ সৃষ্টি করে ফায়দা লুটায় সফল হতে পেরেছিল। অযোধ্যার বাবরী মসজিদ-রামমন্দির বিতর্কটি তাদেরই সৃষ্ট। পরবর্তী কালে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের এই পারস্পরিক বিভেদ সহিংস দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে বৃটিশরা এমনভাবে উসকে রেখেছিল যে তা আর কখনও প্রশমিত হয়নি। এই মনোভাবটি আরও পাকাপোক্ত হয় যখন হিন্দু বর্ণবাদী নেতৃবৃন্দ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে একটি বিজাতীয় সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করলো।

এ পরিস্থিতিতে মুসলিম নেতৃবৃন্দ তৎকালীন বাস্তবতার আলোকে নিজেদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধী করলেন। মুসলিম সমাজকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁরা নতুন কৌশল নিয়ে এগিয়ে এলেন। বৃটিশদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে তাঁরা নিজ সম্প্রদায়কে আধুনিক শিক্ষায় উন্নত করার প্রচেষ্টা চালালেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বাংলার নবাব আবদুল লতিফ ও স্যার সৈয়দ আমীর আলী এবং আলীগড় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এসময় মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সহানভূতিশীল ইংরেজ আমলা ও ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার তাঁর ʼদ্যা ইন্ডিয়ান মুসলমানস্ʼ গ্রন্থে মুসলমানদের দুর্দশার প্রতিকার ও তাদের উন্নয়নের ব্যাপারে বৃটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁদের এসব কর্মকান্ড মুসলিম সমাজের মধ্যে সচেতনতা গড়ে ওঠতে সহায়ক হলো। ভারতীয় জনগণের বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে বৃটিশরাজের সাথে দেনদরবার করার মুখপাত্র হিসেবে ১৮৮৫ সালে গঠিত হয় সর্বভারতীয় কংগ্রেস। কিন্তু কংগ্রেস ক্রমশ হিন্দু প্রভাবিত একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে পরিণত হলে অনগ্রসর মুসলিম সমাজ এর সাথে একাত্ম হতে পারেনি। মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবী-দাওয়াগুলোকে পাত্তা দিতে অনীহ ছিলেন কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হিন্দু নেতৃবৃন্দ। বৃটিশ রাজত্বের রাজধানী কোলকাতা শহরকে ঘিরে যে বাঙালী সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগৎ এবং বিত্ত বৈভব গড়ে ওঠে তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অপ্রতিদ্বন্দী। পূর্ববাংলার অনগ্রসর বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায় তাদের নিকট ছিল অচ্ছ্যুৎ, চাষাভূষা ও বাঙাল নামে পরিচিত এবং তাদের শোষণ-নিপীড়নের শিকার। হিন্দু মহাজন ও ইংরেজ নীল-কুঠিয়ালের অত্যাচারে বাংলার কুষক সমাজ ছিল জর্জরিত। বৃটিশ-শাসন এবং জমিদারি-শোষণের বিরুদ্ধে গ্রাম বাংলায় যে নিরন্তর লড়াই চলছিল তা ছিল এ চাষাভূষাদেরই লড়াই। বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজ যখন হিন্দু জমিদার ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের আগ্রাসনে দিশেহারা তখন কিছু সংখ্যক মুসলিম মনীষি তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ঠ ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারক হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি তাঁর পরিচালিত ʼফরায়েজী আন্দোলনেরʼ মাধ্যমে বাংলার মুসলিম সমাজে ধর্মীয় শুদ্ধির সূচনা করেন এবং তাদেরকে বৃটিশ-শাসন এবং নীল-কুঠিয়ালদের দৌরাত্ম ও নিপীড়নকারী হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে ঐকবদ্ধ করার সংগ্রাম চালিয়ে যান। তাঁর পুত্র দুদু মিয়া এ আন্দোলনকে বাংলার বিভিন্ন জেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করেন। তীতুমীর ও ফকির মজনু শাহ জীবন দিয়ে এ লড়াইকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁদের এ লড়াই শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে জন্ম দিয়েছিল আত্ম-সচেতনতা, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও স্বাধিকারের। নিজেদের অধিকার রক্ষা এবং বাঙালী মুসলিম পরিচয়ে নিজেদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার বিপুল আগ্রহ দেখা দিয়েছিল তাদের অন্তরে।

বিংশ শতাব্দীর সূচনায় বৃটিশ ভারতে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে নব জাগরণ সৃষ্টি হয় এবং তারা স্বাধীনতার চেতনায় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার প্রয়াস পায়। একটি স্বতন্ত্র জাতি সত্তা হিসেবে সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ হিসেবে ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। বাঙালী মুসলমানের জাগরণের এ সময়টিতে তাদের নেতৃত্ব দেন নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব আলী চৌধুরী, শেরে-বাংলা এ, কে, ফজলুল হক, ইসমাইল হোসেন সিরাজী। পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বে যুক্ত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মাওলানা ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বাংলার মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে যেসব বরেণ্য সাহিত্যিক ও সাংবাদিক অসামান্য ভূমিকা রাখেন তাঁরা হলেন: মহাকবি কায়কোবাদ, মীর মোশাররফ হোসেন, ইসমাইল হেসেন সিরাজী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, কবি গোলাম মোস্তফা, আব্দুল ওয়াদুদ, ভাষাবিদ ডঃ শহীদুল্লাহ, সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ʼদৈনিক আজাদʼ ও মাসিক ʼমোহাম্মদীʼ সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁ, প্রমুখ মনীষীবৃন্দ। এছাড়া ধূমকেতু, সওগাত, বুলবুল, নবযুগ, যুগবাণী, প্রভৃতি সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রখ্যাত মুসলিম সাহিত্যিক ও লেখকদের রচনাসামগ্রী মুসলমানদের আধুনিক চিন্তা-চেতনায় এক নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটায়। তাঁরা সবাই চেয়েছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যাপক জাগরণ।

১৯০৫ সালে বৃটিশ ভারতের গভর্ণর লর্ড কার্জন প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বাংলা প্রেসিডেন্সীকে ভাগ করে অনগ্রসর পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করেন এবং ঢাকাকে এর রাজধানী করা হয়। এ পদক্ষেপ পূর্ব বাংলার অনগ্রসর মুসলমাদের জন্য উন্নয়নের এক বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করে। পূর্ববাংলার দরিদ্র কৃষিজীবি মুসলিম জনগোষ্ঠী বৃটিশরাজের এ নতুন প্রশাসনিক সংস্কারকে স্বাগত জানালেও কোলকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু সমাজ তা মেনে নিতে পারেনি। এ বিভক্তি পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর তাদের আধিপত্য ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। সমগ্র বাংলার জনগণের ওপর কোলকাতার এ ভদ্দরলোক শ্রেণীটির আধিপত্য ছিল নিরঙ্কুশ। আসলে তাদের প্রভাব বলয় থেকে পূর্ববাংলা পৃথক হয়ে যাওয়ায় বঙ্গভঙ্গকে তারা তাদের কায়েমী স্বার্থের অন্তরায় মনে করেছিল। হিন্দু জমিদার, পেশাজীবি ও ব্যবসায়ী শ্রেণী তাদের শোষণ ও কায়েমী স্বার্থহানি ঘটার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা ʼবঙ্গমাতাকেʼ বিভক্ত করার অজুহাতে বঙ্গ-ভঙ্গ রদ ও স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলন সহিংসতার রূপ ধারণ করলে বৃটিশরাজ ১৯১১ সালে বাংলার এ প্রশাসিনক বিভক্তিকে রদ করে দেয়। এটি বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ছিল খুবই হতাশব্যঞ্জক ও বেদনাদায়ক। কোলকাতা-ভিত্তিক হিন্দু বাবুদের পরিচালিত স্বদেশী আন্দোলনের সাথে পূর্ববাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের কোন স্বার্থ জড়িত ছিল না। বরং গ্রাম বাংলার কৃষক সমাজের লড়াইটা ছিল বৃটিশ শাসক ও তাদের দোসর নীলকুঠিয়াল ও হিন্দু জমিদার শ্রেণীর নিপীড়ণ ও শোষণের বিরুদ্ধে।

বঙ্গভঙ্গ রদের পর বৃটিশরাজ যখন পূর্ববাংলার মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় তখন তাতেও বাদ সাধে কোলকাতার হিন্দু সমাজ। দুঃখের বিষয়, কবি রবীন্দ্রনাথ নিজেও এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে কোলকাতার গড়ের মাঠে হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্যোগে যে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কোলকাতার হিন্দুবাবুদের বাধার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০ বছর পিছিয়ে অবশেষে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের হীনমন্যতাবোধ এমন নীচে নামে যে, তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় নামে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। অবশ্য হিন্দু সমাজের এ হীন মনোবৃত্তি অতি পুরোনো। একাদশ শতব্দীতে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু সেন-বংশীয় রাজাদের শাসনামলে বর্ণহিন্দু সমাজ জাতিভেদ প্রথার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়। তখন থেকেই তাদের মন-মানসিকতায় উদারনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেনি। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেঙ্গল-রেঁনেসার প্রভাবে হিন্দু সমাজে যে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-চেতনার সূচনা হয় তাও তাদের এ হীনতাব্যঞ্জক মনোবৃত্তিকে মুছে ফেলতে পারেনি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ছিল কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে আর তাঁর জমিদারি ছিল পূর্ববাংলায়। তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে নিজেদের কুঠিবাড়িতে থেকে জমিদারি দেখাশুনা করতেন। প্রায় এক দশক কাল তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন এবং তাঁর অনেক মহৎ সাহিত্যকর্ম সেখানে রচিত হয়। তাঁর প্রজারা অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান কৃষক। তিনি তাঁর বিরাট সাহিত্যকর্মে তাঁর মুসলিম প্রজাদের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ ও বঞ্চনার কথা কতটুকু স্থান দিতে পেরেছিলেন কিংবা তাদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে কতটা একাত্ম হতে পেরেছিলেন তা তাঁর সাহিত্য-কর্মের গবেষকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে একথা ঠিক যে, বাঙালী শিক্ষিত মুসলমানরা তাঁকে শ্রদ্ধা করেছে, তাঁর সাহিত্য প্রতিভাকে সম্মান করেছে, তাঁকে আপন করে নিয়েছে। তাঁর রচিত গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে, যদিও এ গানটি রচিত হয়েছিল হিন্দু স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থনে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের জনগণের স্বার্থকে উপেক্ষা করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে যখন ʼবঙ্গভঙ্গ-রদʼ আন্দোলনকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ʼআমার সোনার বাংলাʼ গীতটি রচনা করেন তখন তিনি জানতেন না এটিই একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে রূপান্তরিত হবে।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল জীবনভর তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সাংবাদিকতার দ্বারা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম হিন্দু-মুসলিম মিলনের জয়গানে মুখরিত ছিল। উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতি তাঁর গান ও কবিতায় সমান গুরুত্ব পেয়েছিল। তিনি সাম্প্রদায়িকতার বহু ঊর্দ্ধে ওঠে হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও ফলপ্রসূ হতে পারেনি। তবুও তিনি তাঁর সাহিত্যকর্ম দ্বারা উভয় সম্প্রদায়ের দেশপ্রেমবোধকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। তাঁর দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহাকে তীব্রভাবে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। হিন্দু-মুসলিম এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা তৈরীর জন্য তৎকালীন কংগ্রেস নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও চিত্তরঞ্জন দাস নিরলস প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যান। এ জন্য জিন্নাহকে ʼহিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূতʼ ও চিত্তরঞ্জন দাশকে ʼদেশবন্ধুʼ খেতাব দেওয়া হয়। কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রচেষ্টায় জিন্নাহর ʼলক্ষ্নৌ প্যাক্টʼ ও চিত্তরঞ্জন দাশের ʼবেঙ্গল প্যাক্টʼ কোনটিই কংগ্রেসের অসহযোগিতার কারণে সফলতার মুখ দেখেনি। হিন্দু নেতৃবৃন্দের উৎকট সাম্প্রদায়িকতা উভয় সম্প্রদায়কে দুই বিপরীত মেরুতে নিয়ে যায়। ফলে ১৯৪৭ সালে শুধু ভারতই বিভক্ত হয়নি, তার সাথে বাংলাও বিভক্ত হয়েছে। এই বিভক্তির পরিণতিতে ঘটেছে হাজারো মানুষের মৃত্যু, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি হারিয়ে দেশান্তরী হয় ও তারা নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। এসব বাস্তবতার আলোকে আমাদের পরিচয় বাঙালী মুসলমান হওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না।

পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন মুসলিম লীগ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের যে দাবী করেছিল তার মূলে শুধু ধর্মীয় কারণ ছিল না, প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য। পশ্চাদপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার্থেই মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক আবাসভূমির দাবী করেছিলেন। তাঁরা উপলব্ধী করতে পেরেছিলেন, কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে মূলত উচ্চ বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি করছে। সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতির কারণে কংগ্রেস মুসলিম জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে পারেনি। যে হিন্দু বাঙালী সম্প্রদায় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে বৃটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে বিভক্ত বাংলাকে যুক্ত করেছিল, ১৯৪৭ সালে তারাই স্বাধীন যুক্তবাংলার বিরোধিতা করে বাংলাকে ভাগ করতে বাধ্য করেছিল। কারণ, এ সময়ে পূর্ববাংলার শোষিত ও নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধিকার ও আত্মোন্নয়নের চেতনা পরিপুষ্ট হয়ে ওঠেছিল। সমগ্র বাংলায় তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, যা শাসন ক্ষমতায় তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ছিল। সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত হিন্দু ভদ্দরলোকগোষ্ঠী তখন বাংলাকে বিভক্ত করার পক্ষেই সোচ্চার হয়ে ওঠে। যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তারা বাঙালী সমাজে ছড়িয়েছিল তারই কারণে শেষ পর্যন্ত তারা বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদে বাধ্য হলো। অচ্ছুৎ চাষাভূষা বাঙালদের সাথে এক কাতারে থাকাটা তারা মেনে নিতে পারেনি। এ ঐতিহাসিক পটভূমিতে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাঙালী মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলে পূর্ববাংলা স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হয়। (দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত)

বিষয়: বিবিধ

১৬৬১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

382794
২৫ এপ্রিল ২০১৭ সকাল ০৭:৫৩
আনিসুর রহমান লিখেছেন : এ দেশে আসেন শত শত ধর্মপ্রাণ সূফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়া। তাঁরা স্থাপন করেন খানকাহ ও মসজিদ এবং প্রচার করতে থাকেন ইসলামের একত্ববাদ, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী
This statement, Not true at all. To know the real fact please read my article,
আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব (১--৪৬) +
ঠবৃসতু

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File