নবীজীর (সাঃ) সম্মান ও মর্যাদা
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০১ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৩:৪৭:৩১ দুপুর
"........ আশা করা যায় আপনার রব্ব আপনাকে অধিষ্ঠিত করবেন সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থানে (১৭:৭৯)।”
বর্ষ পরিক্রমায় পবিত্র রবিউল আওয়াল মাস আমাদের দ্বারে সমাগত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম ও ওফাতের মাস হিসেবে এ মাসটি মুসলিম বিশ্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে এক অন্ধকার যুগে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল এ পৃথিবীর বুকে। সর্বশেষ নবী ও রাসুল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে এ ধরায় তাঁর আগমণ। সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যদার অধিকারী হলেন নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি ছিলেন একাধারে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, সাইয়েদুল মুরসালিন, আশরাফুল আম্বিয়া ও মানবজাতির সর্দার। তিনি মানুষ এবং একই সাথে জিন জাতিরও নবী ছিলেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের প্রিয়তম ও মহাসম্মানিত এক নিষ্পাপ বান্দা হিসেবে আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে সারা জীবনভর তিনি সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত ছিলেন। মানবজাতিকে হেদায়েতের পথে আহ্বানকারী হিসেবেই আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা তাঁকে এ দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। কারণ শিরকের মত মহাপাপ, জুলুম ও কুসংস্কারের আবর্তে পড়ে তখন মানবজাতি ছিল দিশাহারা। তাঁর আবির্ভাব সম্পর্কে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন, "হে নবী, আমি আপনাকে একজন স্বাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানকারী ও প্রদীপ্ত এক আলোক-বর্তিকা হিসেবে প্রেরণ করেছি (৩৩:৪৫-৪৬)।" মানবজাতিকে পরিশুদ্ধ ও ভ্রান্তিমুক্ত করে তাদেরকে ইহ ও পরকালীন কল্যাণ, শান্তি ও মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করানোই ছিল তাঁর নবুওতি দায়িত্ব যা তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন। তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ওয়াদা করেছেন, তিনি তাঁর প্রিয় নবীকে তাঁর আরশে আযীমের সন্নিকটে মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত করে বিশেষভাবে সম্মানিত করবেন। তাঁর মর্যাদার স্বীকৃতি হিসেবে মহামহিম আল্লাহর নিকট থেকে ওয়াদা এসেছে: "আপনার প্রভু শীঘ্রই আপনাকে সর্বোচ্চ প্রশংসিত ও গৌরবমন্ডিত স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন (১৭: ৭৯)।” এর চেয়ে আর বেশী কি আছে যা কোন ব্যক্তিত্বকে সর্বোত্তম সম্মানে ভূষিত করতে পারে। আল্লাহর এ ওয়াদাটি শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্যই প্রযোজ্য, অন্য কোন নবী-রাসুলের জন্য নয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হওয়ার এটাইতো পরম স্বীকৃতি।
“আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করেন। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নবীর ওপর আশিসবাণী পাঠ কর এবং তাঁর প্রতি উত্তম অভিবাদন প্রেরণ কর (৩৩: ৫৬)।”
স্বয়ং মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা ও তাঁর ফেরেশতাকুল সর্বশেষ নবী ও নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওপর দরুদ পাঠ ও সালাম পেশ করেন। প্রতিটি মুসলিম নরনারীকেও তিনি এ কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর ঘোষণা হলো, "আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করেন। (অতএব) হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নবীর ওপর আশিসবাণী পাঠ কর এবং তাঁর প্রতি উত্তম অভিবাদন প্রেরণ কর (৩৩: ৫৬)।” আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর হাবীব মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্মরণকে এভাবেই করেছেন সমুন্নত (৯৪: ৪)। মহান আল্লাহর নির্দেশে দুনিয়া জুড়ে প্রতিদিনই নামাযে, আযানে ও আলোচনায় তাঁর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করা হচ্ছে। যেখানেই তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে সেখানেই তাঁকে উত্তম অভিবাদন জানানো হচ্ছে। তাঁর নাম উচ্চারণের সাথে সাথে বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই সমস্বরে বলছেন, "সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম’ অর্থাৎ তাঁর ও তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর আল্লাহর রহমত ও সালাম বর্ষিত হোক। একটি হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী একদা হযরত (সাঃ) নামাযে খুতবা প্রদানের জন্য মিম্বরে ওঠার সময় তিনবার ’আমীন’ বলেন। সাহাবাগণ তাঁর 'আমীন’ বলার তাৎপর্য জানতে চাইলে তিনি বললেন, হযরত জিব্রিল (আঃ) তিনটি দোয়া করলে এর প্রতিটির প্রত্যুত্তরে তিনি আমীন বলেছেন। এর মধ্যে একটি দোয়ায় জিব্রিল (আঃ) বলেছিলেন, যে আপনার (নবীর) নাম শুনার পর 'সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম’ বললো না তার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক (হাকিম, বায়হাক্বী)। এসব ঘটনা থেকেই বুঝা যায় মহান আল্লাহর প্রিয় নবীকে সম্মান প্রদর্শন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্যেই স্বর্গ-মর্ত্য যেখানেই তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে, সেখানেই শ্রদ্ধাভরে তাঁর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করা হচ্ছে।
"(হে নবী) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালোবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু (৩:৩১)।”
প্রত্যেক মু’মিন বান্দার অন্তরে নবীজীর (সাঃ) প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করা খুবই জরুরী। তাঁকে ভালোবেসে তাঁর অনুসরণ করলে আমরা আল্লাহর ভালোবাসা, দয়া ও ক্ষমা লাভ করতে পারব। পার্থিব ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজের প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসা তাঁর প্রতি না থাকলে কেহই প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসুল বলেন, "তোমাদের মধ্যে কেহই প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ সে তার পিতা, পুত্র এবং সকল মানুষের চেয়ে আমাকে বেশী ভালোবাসবে (বোখারী ও মুসলিম)।’ ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) যখন ঘোষণা দিলেন 'হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আমি আপনাকে আমার প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসি’ কেবল তখনই তিনি প্রকৃত মু’মিনের পর্যায়ে উন্নীত হলেন। পবিত্র কুরআনেও এধরনের নির্দেশনা রয়েছে, ”মদীনাবাসী ও পার্শ্ববর্তী পল্লীবাসীদের উচিত নয় রাসুলুল্লাহর সঙ্গ ত্যাগ করে পেছনে থেকে যাওয়া এবং রাসুলের প্রাণ থেকে নিজেদের প্রাণকে অধিক প্রিয় মনে করা। .......(৯:১২০)।" হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, 'তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসবে কারণ তিনি তোমাদেরকে অগণিত নিয়ামত প্রদান করেন, এবং আল্লাহর ভালোবাসায় আমাকে ভালোবাসবে, এবং আমার ভালোবাসায় আমার আহলে বাইত’ বা বাড়ির মানুষদের (বংশধর ও আত্মীয়দের) ভালোবাসবে (তিরমিযি)।’ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য ও ভালোবাসার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সাফল্য। তাই আল্লাহ্ বলেন, "....যে কেউ আল্লাহ্ ও রাসুলের আদেশমত চলে, তিনি তাকে জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে স্রোতস্বনী প্রবাহিত হবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এ হল বিরাট সাফল্য। (৪:১৩)।”
”.......এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি-যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন-পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য পালনকর্তার নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে (১৪:০১)।”
মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসুল ও নবী মুহাম্মদকে (সাঃ) অগণিত মুযিজার অধিকারী করেছিলেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মুযিজা হলো তাঁর ওপর নাযিলকৃত ’আল-কুরআন’ যা মু’মিনের অন্তরের রোগ নিরাময়কারী (পরিশুদ্ধকারী) ও রহমতস্বরূপ। এ কুরআন এক অনন্য সাধারণ ঐশী গ্রন্থ যা বিগত চৌদ্দশত বছর যাবৎ অবিকৃত অবস্থায় আছে এবং রোজ ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে। এ নিশ্চয়তা দিয়ে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন, "আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক (১৫: ০৯)।” মানব জাতির উপর পবিত্র কুরআনের প্রভাব যে কত অপরিসীম তার সমর্থনে হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) বর্ণিত রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর হাদীসে উল্লেখ আছে, 'আল্লাহ্ এ কিতাব (কুরআন) দিয়েই কোন জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেন, আবার (একে অবহেলা করার কারণে) কোন জাতিকে কুরআন দিয়েই উন্নতির আসন থেকে নীচে নামিয়ে আনেন (সহীহ মুসলিম)।’ এর প্রমাণ হলো মাত্র তেইশ বছরের নবুওতি জীবনে মহানবী (সাঃ) বিশ্বব্যাপী যে মহাবিপ্লব সংঘটিত করেছেন তার মূলে ছিল এই কুরআনের প্রভাব। পবিত্র কুরআনের শিক্ষার আলোকে তিনি একটি বর্বর জাতিকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত জাতিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তৎকালীন বিশ্বে ইসলামের আধ্যাত্মিক শক্তির এমনই বিকাশ ঘটেছিল যার বিকীরণ সমগ্র বিশ্বকে উদ্ভাসিত করে দেয়। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের একান্ত প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর ওপর নাযিলকৃত পবিত্র গ্রন্থ কুরআন মু’মিন বান্দাদের জন্য হেদায়েত ও রহমতস্বরূপ। আর এ উভয়বিধ রহমতের কারণে ".......... মানুষের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত (১০:৫৭-৫৮)।”
এ ছাড়াও তাঁর আরও দুইটি বড় মু’যিজা হলো 'ইসরা ওয়াল মিরাজ’ বা রাত্রিকালীন ভ্রমণ এবং চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণ। পরম পবিত্র ও মহিমাময় আল্লাহ্ তাঁর কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য প্রথমে তাঁকে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত প্রচুর বরকতময় স্থানসমূহ ভ্রমণ করিয়েছিলেন। এরপর সেখান থেকে মি’রাজ বা ঊর্দ্ধ জগতের ভ্রমণ যার শেষ সীমানা ছিল সাত আসমান পেরিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত। সেখানে তিনি লাভ করেছিলেন পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায সংক্রান্ত আল্লাহর নির্দেশ। তারপর ফেরেশতা জিব্রিল (আঃ) কে নিয়ে বেহেশত ও দোজখ স্বচক্ষে অবলোকন করেন। অপার বিস্ময়াবহ এসব ঘটনা ঘটেছিল সে রাতের এক অত্যাশ্চর্য স্বল্প সময়ে। অপর মু’যিজায় তিনি মক্কার কাফেরদের অনুরোধে তাদের মনে ঈমান জাগ্রত করার লক্ষ্যে এবং মহান আল্লাহর নির্দেশে আঙুলের ইশারায় চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করেছিলেন। এসবই ছিল তাঁর ওপর আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহ। মহান আল্লাহ্ প্রদত্ত তাঁর মর্যাদাপূর্ণ মু’যিজার বিষয়টিকে বাড়িয়ে, কমিয়ে বা বিকৃত করে বলার অধিকার কারো নেই।
”...........কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া (২:২৫৫)?"
ক্বিয়ামতের দিবসে হাশরের মাঠে সমগ্র মানবজাতিকে বিচারের জন্য যখন একত্র করা হবে তখনকার অবস্থা হবে ভয়াবহ। সেই দুর্ভোগের কঠিনতম সময়ে ধন-সম্পদ, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, স্বামী-স্ত্রী, ঘনিষ্ট স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব কেউ কারো কোন উপকারে আসবে না। আত্ম-চিন্তায় কাতর মানুষ বলতে থাকবে 'ইয়া নফসী, ইয়া নফসী’, এমনকি নবী-রাসুলগণও। শুধুমাত্র উম্মতের কান্ডারী মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকবে 'ইয়া উম্মতি, ইয়া উম্মতি’। হাশরের মাঠে বিচারের দীর্ঘ কষ্টকর প্রতীক্ষায় সকল উম্মত অধৈর্য হয়ে নিজ নিজ নবী ও রাসুলগণের নিকট হাজির হবেন। তারা তাদের নবীগণকে মহান আল্লাহর দরবারে বিচার কাজ শুরু করার সুপারিশের জন্য আবেদন জানাবে। তখন নবীগণ বিভিন্ন অজুহাতে তাঁদের অপারগতার কথা ব্যক্ত করবেন। সেই কঠিন সংকটে আল্লাহ্ হাকিমুল হাকিম শুধুমাত্র তাঁর নবী হযরত মুহাম্মদকে (সাঃ) সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থান 'মাকামে মাহমুদে’ অধিষ্ঠিত করে 'শাফায়াতে কুবরা’ অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন। তাঁরই সুপারিশে বিচার দিবসের মালিক আল্লাহ্ তায়ালা বিচারের কাজ শুরু করবেন। নবী (সাঃ) এর সুন্নতের অধিক পাবন্দি করার মধ্যেই রয়েছে তাঁর সুপারিশ লাভের আশা। তবে কারো মধ্যে তিল পরিমাণ ঈমানও যদি থাকে তাঁর মাগফিরাতের সুপারিশও করবেন দয়াল নবী। ক্বিয়ামতের দিবসে হাশরে, মিযানে, পুলসিরাতে অর্থাৎ প্রতিটি মহাবিপদের ঘাটিতে তিনি তাঁর উম্মতের সুপারিশকারী হিসেবে আবির্ভূত হবেন। এ সময় তাঁর শাফায়েত লাভের সৌভাগ্য তাদেরই ঘটবে যারা তাঁর প্রতি আনুগত্য, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় ছিল আন্তরিক। হাশরের মাঠে তিনি তাঁর পিপাসার্ত উম্মতকে তাঁর হাউজে কাওসারের পানি পান করিয়ে পিপাসা নিবারণ করবেন।
"আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি (২৭:১০৭)।”
নবী করিম (সাঃ) আল্লাহর তরফ থেকে সৃষ্টিকুলের রহমতস্বরূপ আবির্ভূত হয়েছেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর ওপর নাযিল করেছেন নসিহতপূর্ণ সমুজ্জ্বল এক কিতাব - আল-কুরআন। এটিও মানবজাতির জন্য এক বিরাট অনুগ্রহস্বরূপ। এ কিতাবের বাণী দ্বারা তিনি অত্যন্ত মার্জিত, যুক্তিপূর্ণ ও সাবলীল ভাষায় লোকজনকে ধর্মোপদেশ দিতেন। তাঁর প্রতি মহান আল্লাহর নির্দেশ ছিল: "জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে আপনার প্রভুর দিকে আহ্বান করুন এবং তাদের সামনে যুক্তি উত্থাপন করুন সর্বোত্তম পন্থায় (১৬:১২৫)।" মানুষের কোন অকল্যাণ ছিল তাঁর নিকট দুর্বিষহ। নিপীড়িত মানবতার কল্যাণের জন্য হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন মহান আল্লাহর এক পরম অনুগ্রহ, তাঁর আগমণে সৃষ্ট জগত ধন্য হয়েছিল। কারণ আল্লাহর ঘোষণায় তিনি ছিলেন সৃষ্টিকুলের জন্য পরম অনুগ্রহস্বরূপ। আর এ কারণেই আল্লাহ্ বলেন, "আল্লাহ্ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও কাজের কথা শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট (৩:১৬৪)।” তিনি তাঁর উম্মতের প্রতি অতীব দয়ার্দ্র এবং তাদের কল্যাণ কামনায় ব্যাকুল। তাঁর এ কোমলচিত্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আল্লাহ্ বলেন, "তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার জন্য দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি অতীব স্নেহশীল ও দয়ালু (৯:১২৮)।” মানবজাতির পরম হিতৌষী নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ও আহলে বাইতের ওপর বর্ষিত হোক আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত।
"তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে যারা আল্লাহ্ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে (৩৩:২১)।”
সর্বগুণে গুণান্বিত মহানবী (সাঃ) ছিলেন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ চরিত্রের অধিকারী এক মহামানব। আল্লাহর রঙে রঞ্জিত, আল্লাহর গর্বে গর্বিত ও আল্লাহর জন্য আত্ম-নিবেদিত এ মহাপুরুষের ছিল না কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । মহান আল্লাহ্ স্বয়ং ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তিনি তাঁকে ঐশী জ্ঞান দান করেছেলেন এবং মনোনীত করেছিলেন তাঁর নবী ও রাসুল। “আপনি অবশ্যই সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী” (৬৮:৪) - মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের এ ঘোষণার দ্বারা তিনি লাভ করেছিলেন মানবজাতির শিক্ষক ও সুপথ প্রদর্শনকারীর মর্যাদা। তিনি মানব জাতির সামনে পেশ করেছেন সর্বোত্তম এক জীবনাদর্শ। অতি উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী, মহত্ব, সততা ও সহজ সরল জীবনাচরণ দ্বারা তিনি জয় করেছেন মানুষের হৃদয়। বিশ্বাসে, কথায় ও কাজে তিনি ছিলেন এক সমান। মিথ্যাচারের লেশমাত্র ছিল না তাঁর মধ্যে। তাই সবার কাছেই তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত এবং সমাজে তিনি ’আল-আমীন’ হিসেবে ছিলেন পরিচিত। সমগ্র মানব জাতি তাঁর অনুপম চারিত্রিক মহিমায় হয়েছে অভিভূত, বিমুগ্ধ। আর এ জন্যেই মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, "......আর তোমরা তাঁর (নবীর) অনুসরণ কর যাতে হেদায়েতপ্রাপ্ত হতে পার” (৭:১৫৮)।” আর সর্ববস্থায় তাঁকে অনুকরণ ও অনুসরণ করার মধ্যেই রয়েছে মানবজাতির শান্তি ও মুক্তি। সুতরাং তাঁর আনীত শরীয়াহ অর্থাৎ তাঁর সুন্নত বা রীতিই হলো আমদের জন্য সর্বোত্তম জীবনাদর্শ। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনাদর্শ সমুজ্জ্বল আলোকবর্তিকার মতো পথ-প্রদর্শক হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত মানব জাতিকে সুপথ দেখাবে। মানবজাতির কল্যাণে নিবেদিত-প্রাণ এ মহানবীর ওপর বর্ষিত হোক আল্লাহর অশেষ দয়া ও অনুগ্রহ।
"আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে শিষ্টাচারের জন্যে শোধিত করেছেন যারা আল্লাহর রাসুলের সামনে নিজেদের কন্ঠস্বর নীচু করে। তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার (৪৯:০৩)।”
নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রতি সম্মান ও শিষ্টাচার প্রদর্শনের তাকিদ এসেছে স্বয়ং আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালার নিকট থেকে। এর ব্যতিক্রম হলে মু’মিনের সব আমল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন, "হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্ ও রাসুলের সামনে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ সবকিছু শুনেন ও জানেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বরকে উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না (৪৯:০১-০২)।” শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিনম্র চিত্তে তাঁকে সম্ভাষণ ও অভিবাদন জানাতে হবে যাতে বিন্দুমাত্র বেয়াদবী না হয়। রাসুলের নির্দেশ ও ফয়সালা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেকই হয়ে থাকে। এতে দ্বিমত পোষণ করার কিছুই নেই। সন্তুষ্ট চিত্তে তা মেনে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ। এসব আনুগত্যশীল বিশ্বাসী বান্দাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, "মু’মিনদের বক্তব্য কেবল এ কথাই যখন তাদের মধ্যে (কোন ব্যাপারে) ফয়সালা করার জন্য আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা বলে: আমরা শুনলাম ও আদেশ মানলাম। তারাই সফলকাম (২৪:৫১)।” মান্যতা ভিন্ন অবাধ্য হওয়ার উপায় তাদের নেই, কারণ আল্লাহ্ সতর্ক করে বলেন: "আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয় (৩৩:৩৬)।”
”বলুনঃ আমি ও তোমাদের মতই একজন মানুষ, তবে আমার প্রতি ওহী নাযিল হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ (১৮:১১০)।”
এ বিশাল ব্যক্তিত্বের মধ্যে আত্ম-অহমিকা বলতে কিছুই ছিল না। তিনি বলতেন, 'আমি তোমাদের মতই রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষ। আমি কোন কিছুই নিজের থেকে তোমাদের কাছে নিয়ে আসিনি। এসব কিছুই মহান আল্লাহ্ আমার ওপর নাযিল করেছেন। আমার নিকট যা আছে তার সব কিছুর মালিকই আল্লাহ্। এই কুরআন যা কোন মানবের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়, তা শুধুমাত্র আল্লাহরই বাণী। এটা আমার মনগড়া কোন রচনা নয়। এর প্রতিটি শব্দ তাঁরই নিকট থেকে নাযিল হয়েছে, সমস্ত গৌরব তাঁর - যাঁর বাণী এই কুরআন। বিস্ময়কর সব কীর্তি যা তোমাদের চোখে আমার কৃতিত্ব বলে মনে হয়, যতসব বিধিবিধান আমার মাধ্যমে তোমরা পেয়েছ, যতসব নীতি-উপদেশ আমি তোমাদের দিয়েছি - এসবই আমার নিজস্ব বলে কিছু নয়। এসব কিছু রচনার কোন যোগ্যতাও আমার নেই। সব ব্যাপারেই আমি ঐশী নির্দেশনা লাভের ওপর নির্ভর করি। আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন আমি তাই করি, তিনি যা নির্দেশ দেন আমি তাই ঘোষণা করি।’ কি এক অপূর্ব অনুপ্রেরণাদায়ক তাঁর এ ঘোষণা, যাতে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর উদ্দেশ্যের সততা ও আন্তরিকতা, সত্য প্রকাশের নিষ্ঠা ও সাহসিকতা, নির্মল চরিত্র ও পবিত্র আত্মার দ্যুতিময়তা। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, 'আমার কবরকে তোমরা উৎসবের স্থান বানিও না। আমার প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ কর। তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের দরুদ ও সালাম আমার নিকট পৌঁছানো হয় (আবু দাউদ)।’ কোন প্রকার কৃত্রিমতা, বিদাত ও অতিরঞ্জন দ্বারা তাঁর চরিত্রকে বিশেষায়িত করতে এবং তাঁর প্রশংসা কীর্তন করতে তিনি নিষেধ করেছেন।
পরিশেষে নামাযে পঠিতব্য তাশাহুদ দিয়ে শেষ করছি: "যাবতীয় সম্মান, ইবাদত ও প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা’য়ালার জন্য। হে নবী, আপনার ওপর আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। আমাদের ওপর ও সৎকর্মশীল বান্দাদের ওপর আপনার দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল।"
বিষয়: বিবিধ
৩১৫৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো চ
মন্তব্য করতে লগইন করুন