মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রসঙ্গে

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২৫ নভেম্বর, ২০১৬, ০৯:১৪:২৩ রাত

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর ওপর চলছে পৃথিবীর জঘন্যতম গণহত্যা। একবিংশ শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম এ গণহত্যার নায়ক হলো জল্লাদ বার্মিজ সেনাবাহিনী। এর নেপথ্যে রয়েছে অংসান সূ চি ও তাঁর এনএলডি দল। সেনাবাহিনীর নৃশংস আক্রমণ, দমন-নিপীড়ন ও হেলিকপ্টার গানশীপের গুলিতে নারী-পুরুষ-শিশুরা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের বাড়িঘর, গণধর্ষনের শিকার হচ্ছে নারী, এমনকি শিশুও। বিদেশী সাংবাদিক ও ত্রাণসংস্থাকে সে এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞার বর্ম ভেদ করে সোশাল মিডিয়া ও বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় প্রতিদিনই প্রচারিত হচ্ছে নির্মম হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের যেসব নারকীয় দৃশ্যাবলী তা বর্তমান সভ্যতার মুখে কলঙ্কের কালি লেপন করে দিয়েছে। নিজ দেশে পরবাসী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকজন আত্মরক্ষার্থে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে পলায়ন করছে। এদের কর্তিত মস্তক, উলঙ্গ দেহে পৈচাশিক নির্যাতনের চিহ্ন, অসহায় মুখচ্ছবি আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের বর্ডার গার্ডের কঠোর বাধার মুখে তারা ঢুকতে পারছে না। মোট কথা কোথাও তাদের আশ্রয়স্থল নেই, জানমালের নিরাপত্তা নেই। তাদেরকে দুনিয়ার বুক থেকে সমূলে উৎখাতের জন্যেই চালানো হয়েছে এ নৃশংস গণহত্যা। সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের হত থেকে রক্ষার দায়িত্ব এ সভ্য সমাজের কারও নেই।

এ গণহত্যার ব্যাপারে বিশ্ব জুড়ে তেমন জোড়ালো প্রতিবাদ ওঠছে না, কারণ রোহিঙ্গারা একটি ক্ষুদ্র জাতি সত্তা। এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারেরও তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বরং উল্টো পলায়নপর বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী যারা প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করতে চাইছে তাদেরকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এ যেন মানবতার এক চরম অপমান। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রধানমন্ত্রী যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা অনেকটা দায়সারা গোছের। এরকম প্রতিবাদ দ্বারা এত বড় একটা সমস্যার সুরাহা সম্ভব নয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আরো সোচ্চার হতে হবে এবং কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। একাত্তরে যখন পাকিস্তানী গণহত্যার কবলে পড়ে বাংলাদেশীরা প্রাণ বাাঁচানোর জন্য ভারতে শরণার্থী হয়েছিল তখন ভারত তার সব ধরনের অসুবিধা সত্ত্বেও এদেশের বিপদগ্রস্ত জনগণকে আশ্রয় ও সেবা দিয়েছিল এবং সামরিক সাহায্যও প্রদান করেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এ চরম দুর্দশায় আজ আমাদের সরকারের সেরকম কোন অনুভূতি নেই। সে দিনের কথা ভুলে গিয়ে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদেরকে হায়েনাদের কাছে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। শত সমস্যা ও অসুবিধা সত্ত্বেও মানবিক কারণে আমাদের সাড়া দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের জনগণের এটাই দাবী। প্রতিবেশী চীন তার সীমান্ত রোহিঙ্গাদের জন্য খুলে দিয়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশে সরকারকে তার সীমান্ত খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। আর সরকারের নেতারা সীমান্ত বন্ধ করে রাখার বিবৃতি আওড়াচ্ছেন। মানবতার প্রতি তাদের কি নির্মম পরিহাস!

বহু বছর যাবৎ প্রতিবেশী সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের স্টীমরোলার চালিয়ে আসছে। সর্বশেষ এবারের গণহত্যা চালানো হচ্ছে জঙ্গী দমনের নামে। মিয়ানমার সরকার এদেরকে অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করে এবং তাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবেও তাদেরকে গণ্য করা হচ্ছে না। বরং তাদেরকে বলা হচ্ছে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেতে হলে তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা সেখানকার ১৮২৩ সালের পূর্বের অধিবাসী। এভাবেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অন্যায়, অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে আসছে সরকার ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়। জাতিসংঘের ভাষ্যমতে, রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায় বিশ্বের সবচেয়ে সুবিধা বঞ্চিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। তারা মাত্র দশ লাখ জনসংখ্যার রাষ্ট্রহীন জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম। বার্মার রাখাইন প্রদেশের দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলে তাদের বসবাস। দেশের অন্য এলাকায় তাদের যাতায়াত ও কাজকর্মে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের জীবন বড়ই দুর্বিষহ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের হিসেব অনুযায়ী ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরুর পর ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। পালাতে গিয়ে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সমুদ্রে উপকূলে নৌকা ডুবিতে মারা গেছে বহু রোহিঙ্গা।

দীর্ঘ সেনাশাসনের কবলে পতিত মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অংসান সূ চি বহু বছর নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে দেশটিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটাতে পেরেছেন। তাঁর এ মহৎ অবদানের জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছেন। দেশটির গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এখন ক্ষমতাসীন। কিন্তু তাঁর দল ও তিনি রোহিঙ্গাদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছেন। তবে সামরিক সরকার তাদেরকে সাময়িক ভোটাধিকার দিতে চাইলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সে প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। ফলে তারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সু চি এখন দেশেটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশের নিরাপত্তা বিষয়গুলোও তাঁরই হাতে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রায়ের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের এ দমন-নিপীড়ন সত্যিই খুব বেদনাদায়ক। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি যেমন নীরব, তেমনই তাদেরকে নির্মূল করার জন্য যে গণহত্যা চালানো হচ্ছে সে ব্যাপারেও তিনি নীরব। তাঁর এ নীরবতা গণহত্যায় তাঁর সমর্থন ও সহযোগিতার শামিল। শান্তির নোবেল পুরস্কার যেন তাঁকে ব্যঙ্গ করছে। নিজ সরকারের চালানো গণহত্যার দায়ভার তাঁর ও তাঁর দলের ওপরই বর্তায়। এসবই তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কারকে বিতর্কিত করে ফেলেছে এবং তা প্রত্যাহারের দাবীকে জোড়ালো করেছে।

মহানবী (সাঃ) এর যুগ থেকেই তৌহিদে বিশ্বাসী মুসলিম জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের দ্বারা নির্মমভাবে জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসব নির্যাতিত মুসলিম সমাজকে রক্ষার আহ্বান জানিয়ে স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন, "তোমাদের এ কি হলো যে, অসহায় নারী-পুরুষ ও দুঃস্থ শিশুদের (বাঁচাবার) জন্য আল্লাহর রাস্তায় তোমরা কেন লড়াই করছ না, যারা (নির্যাতনে কাতর হয়ে) ফরিয়াদ করছে - হে আমাদের প্রতিপালক, এ জালিমদের জনপদ থেকে বের করে আমাদেরকে (অন্য কোথাও) নিয়ে যাও, অতঃপর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন অভিবাবক পাঠিয়ে দাও, তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য একজন সাহায্যকারী পাঠাও (৪:৭৫)।" মহান আল্লাহর এ বাণীর সাথে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর গণহত্যার ব্যাপারে আমাদের শীতল ভূমিকার অনেক মিল রয়েছে। মানবিক এ বিপর্যয়ের হাত থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে রক্ষায় নীরবতা পালনের সময় আর নেই। আমাদের অপারগতা আমাদেরকে নিশ্চয়ই একদিন আল্লাহর গযবের সম্মুখীন করে দেবে।

বিষয়: বিবিধ

১৩৮৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

380131
২৬ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১২:০৮
স্বপন২ লিখেছেন :
ভালো লাগলো / অনেক ধন্যবাদ
380132
২৬ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১২:১৭
স্বপন২ লিখেছেন :


অত্যান্ত দুঃখজনক।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File