বদরুলের হিংস্র প্রেম
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১০:২৯:০৮ রাত
এক তরফা প্রেমের প্রত্যাখ্যানে জীবন প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু এক খাদিজা নার্গিসের। ফুলের নামে যার নাম সেই নার্গিস মেয়েটি তার প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের মরণাঘাতে মৃত্যুর সাথে লড়ছে হাসপাতালের শয্যায়। প্রকৃত প্রেমিকেরা কখনও খুনি হতে পারে না, তবে কেউ হয় সংসার বিরাগী আবার কেউ হয় আত্মঘাতি। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে ভালোবাসার মাধুর্য বেড়ে যায়, বিরহের অনলে পুড়ে মানুষ হয় খাঁটি প্রেমিক। প্রকৃত প্রেমে জোরজবরদস্তি নেই, নেই প্রতিহিংসা। জোর করে প্রেম সেতো ধর্ষকের কামনা বাসনার মতো। বদরুলের একতরফা প্রেম ছিল সে পর্যায়ের। তাই প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে প্রতিাহংসার আগুনে জ্বলে ওঠে, পরিণত হয় এক হিংস্র পশুতে। সে তার বিকৃত মানসিকতার কারণেই চাপাতির আঘাতে তার উদগ্র বাসনাকে দমিত করতে চেয়েছে। এ সমাজে যেমন বদরুলের মত হিংস্র খুনি রয়েছে, এ খুনের দৃশ্য মজা করে দেখা ও ক্যামেরাবন্দী করার মত জঘন্য মানসিকতার মানবরূপী পশুও রয়েছে। বিপদে-আপদে মানুষ যখন অন্য মানুষের সাহায্য না পায় তখন এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কি হতে পারে? সেটাই ঘটেছে নার্গিসের ক্ষেত্রে। কলেজ ক্যাম্পাসে চাপাতির আঘাত থেকে বাঁচার জন্য সে যখন সাহায্যের জন্য আর্ত চিৎকার করছে তখন অন্য সহপাঠীরা সব দর্শকের ভূমিকায়। তার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তার ওপর চাপাতির আঘাতের দৃশ্য তারা ধারণে ব্যস্ত। আমরা ভিডিও’তে দেখেছি, বাঘ যখন কোন একটি মহিষকে আক্রমণ করে, অন্য মহিষেরা কিভাবে বাঘকে তেড়ে আসে। আমাদের সমাজ থেকে এখন এ পশুসুলভ গুণটিও বিদায় নিয়েছে। আমরা মনে করছি বিপদতো নার্গিসের, আমাদের নয়। আমরা এতই নিষ্ঠুর যে, তার বাঁচার করুণ আর্তি আমাদের মনকে টলাতে তো পারেইনি, বরং তার ওপর আক্রমণের দৃশ্য ভিডিও করে কার আগে কে ফেসবুকে পাঠিয়ে বাহবা কুড়াতে পারি সে প্রতিযোগিতায় আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আরো অবাক হই যখন দেখি, হাসপাতালে নার্গিসের শয্যাপাশে প্রকট সাজগোজে ছাত্রীনেত্রীরা সেলফি’র মাধ্যমে তাদের সহানুভূতি প্রদর্শন করছে। এই যখন আমাদের সমাজের অবস্থা তখন এ সমাজকে আর কে বাঁচাবে?
আমাদের সমাজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ছাত্রনামধারীদের হাতে বইয়ের বদলে থাকছে অস্ত্র, অর্থ ও মাদক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বদলে হয়ে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকরা এখন ক্লাসের বদলে কোচিং ব্যবসায় নিযুক্ত। রাজনীতি থেকে সুনীতি উধাও, জনসেবার পরিবর্তে পারিবারিক ও দলীয় সেবায় রাজনীতিকরা ব্যস্ত। প্রশাসনে নেই কোন সুশাসন, দুর্নীতির রাহুগ্রাসে সমাজ বিপর্যস্ত, প্রতিকারহীন সমাজে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের অবক্ষয় জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। তাই একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দায়মুক্তির চেষ্টা চলছে। দায় এড়ানোর জন্য এ দোষারোপের খেলার যেন অন্ত নেই। এ দোষ চালাচালির সুযোগে আড়ালে চলে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা। প্রতিটি খুন, ধর্ষন, নিপীড়ন, ডাকাতি, লুটপাটের মত ঘটনা নিয়ে মিডিয়ায় কয়েকদিন মাতামাতি চলে। এরপর সব ধামাচাপা পড়ে যায়। ভুলে যাওয়াই যেন আমাদের রীতি। অপেক্ষায় থাকি কবে আবার এ ধরনের ঘটনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠব। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা বিচারের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায়, প্রতিকারহীন থেকে যায় সমাজ। আর এ কারণেই একের পর এক ঘটতে থাকে অপরাধ। এসব অপরাধীদের অনেকেরই থাকে দলীয় পরিচয় যা তাদের রক্ষাকবচ। এ দেশে ছাত্রনামধারী সোনার ছেলেরা যে দলীয় পরিচিতির কারণেই কত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে তা মিডিয়ার কল্যাণে সবাই দেখতে পাচ্ছে। শুধু এরাই নয়, দলীয় পরিচেয়ে অপরাধ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ প্রতিটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে।
আমরা এখন এক অসহিষ্ণু সমাজের বাসিন্দা। প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক বদরুলেরা এ সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। কেউ ভিন্নমত হলেই নেমে আসে নির্যাতন, হতে হয় ক্রসফায়ার বা জেল-জুলুমের শিকার, অথবা খুন-গুম, ইত্যাদি। এক সময় ছিল যখন গণতন্ত্র ছিল জাতির স্বপ্ন, এখন তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। স্বাধীন মত প্রকাশের অর্গল বন্ধ, তাই সাধারণ মানুষ বাকরুদ্ধ। একদলীয় শাসনের যাঁতাকলে জাতি আজ বিপর্যস্ত। দলীয়করণের শিকার হচ্ছে সবগুলো প্রতিষ্ঠান। মিডিয়া থেকে শুরু করে সর্বত্রই বশীভূতকরণ সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং ভিন্নমত পোষণের কোন উপায় নেই। জাতীয় স্বার্থেও কেউ কোন কথা বলতে পারছে না। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা কঠোর হস্তে দমন করতেই পুলিশবাহিনী ব্যস্ত। রামপাল কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্পের হাত থেকে সুন্দরবন রক্ষার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী মিটিং, মিছিল, সমাবেশ পুলিশী লাঠিপেটায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়াগুলোও ভয়ে কাতর। দৈনিক ইত্তেফাকের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মত নির্ভীক সাংবাদিক এখন আর নেই। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাকে গ্রাস করছে হলুদ সাংবাদিকতা। সরকারের একতরফা প্রশংসাগীতিই যেন তাদের জন্য জাতীয় নীতি। এমনকি ফেসবুকেও কেউ কোন মন্তব্য করলে মন্তব্যকারীকে পাকড়াও করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে। সাদাপোষাকে গ্রেপ্তার, বিনা ওয়ারেন্টে আটক, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা সবই এক নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। ভিন্নমত পোষণের কোন দ্বার খোলা নেই। তাই অর্গলবদ্ধ এ পরিবেশে পরমত সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা গেছে নির্বাসনে। আর এ কারণেই সরকারের লেজুড়বৃত্তিতে রত ছাত্রসমাজের একটি অংশ হয়ে ওঠেছে বেপারোয়া ও স্বেচ্ছাচারী। সর্বোচ্চ একটি বিদ্যাপীঠের ছাত্র বদরুলও এর ব্যতিক্রম নয়, সে ওই দলটিরই একজন নেতা। তাই তার একতরফা প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় সে হয়ে ওঠে হিংস্র। তারই রামদায়ের কোপে এখন হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর সাথে লড়ছে নার্গিস।
এক সময় ছিল যখন ছাত্র রাজনীতি জনমনে সমীহের সৃষ্টি করেছিল। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম সর্বত্র ছিল আমাদের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসমাজের উদ্দীপ্ত পদচারণায় মুখর। তাদের দেশপ্রেম, নীতি ও আদর্শ জাতিকে সে সময় আশ্বস্ত করতে পেরেছিল। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আদর্শহীন ও নীতিহীন রাজনীতির কবলে পড়ে ছাত্রসমাজের সেই ঐতিহাসিক অর্জনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মাস্তানি, চাঁদাবজি, টেন্ডারবাজি, হল-দখল, ভর্তি ও সিট বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্য, আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া, প্রতিপক্ষের সাথে গোলাগুলি, খুনখারাবি, কাঁড়িকাঁড়ি অবৈধ অর্থ-সম্পদের মালিকানা এসব কুকর্মই এখন তাদেরকে বিপথগামী করে তুলেছে। এ অপরাজনীতির বদৌলতে তারা এতই অবৈধ অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেছে যে তাদের লাইফস্টাইল দেখে তাদেরকে আর ছাত্র বলেই মনে হয় না। কারণ তারা এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জমিদার। ছাত্র রাজনীতির এ বেহাল অবস্থা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই নীতিহীন করে তুলেছে। ফলে নৈতিক মূল্যবেধের অভাবে ছাত্র সমাজ এখন আদর্শচ্যুত ও লক্ষ্যহীন। দেশ ও জাতির জন্য এ অবস্থা খুবই বেদনাদায়ক ও ভয়ঙ্কর। বদরুলেরা এ ভয়ঙ্কর অবস্থারই প্রতিনিধিত্ব করছে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন