ইসলামে কুরবানীর গুরুত্ব
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০১:০৮:৩২ দুপুর
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর প্রভু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির জন্য আত্মোৎসর্গের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন তারই স্মরণে ইসলামে কুরবানীর প্রচলন ঘটে। প্রায় চার হাজার পূর্বে আল্লাহর এক বিশিষ্ট নবী হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটে পৃথিবীর বুকে। বহু পরীক্ষায় পরীক্ষিত ছিলেন এই নবী। সকল পরীক্ষায়ই তিনি একনিষ্ঠতার সাথে কামিয়াবী অর্জন করেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি ছিল বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান ইসমাইলকে (আঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কুরবানী দান। আসলে পুত্র ইসমাইলের প্রাণহানি ঘটানো আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল না। ইব্রাহীম (আঃ) যখন স্বীয় পুত্রের গলায় ছুরি চালানোর পর চোখ খুললেন তখন দেখলেন পুত্রের বদলে জবাই হয়েছে একটি স্বর্গীয় ভেড়া, আর পুত্রটি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। এ ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আর এ পরীক্ষায় ইব্রাহীমের (আঃ) কামিয়াবীতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এতই খুশী হলেন যে, তাঁকে ’খলীলুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু খেতাবে ভূষিত করলেন। আল্লাহ্ তাঁকে শুধু খলীলুল্লাহ উপাধিতেই সীমিত রাখেননি, বরং তাঁকে বানিয়েছিলেন মানব জাতির নেতা ও মুসলিম জাতির পিতা। আর পবিত্র কুরআনের ভাষায় মুসলিম জাতি হলো ’মিল্লাতে ইব্রাহীম’। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত পবিত্র কাবাগৃহ আল্লাহর ঘর ও মুসলমানদের ক্বিবলা হিসেবে স্বীকৃত। হজ্জ্বের মওসুমে এটি তাওয়াফ করা একটি ফরজ ইবাদত। আর এ সময়ে অর্থাৎ ১০ই যিলহজ্জ্ব পশু কুরবানী করা একটি ওয়াজিব ইবাদত। প্রতি বছর হজ্জ্বকে কেন্দ্র করে পালনীয় সব অনুষ্ঠানাদি হযরত ইব্রাহীম (আঃ), তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ) ও তাঁর স্ত্রী হাজেরার পবিত্র স্মৃতিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।
ইসলামী বিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তি হলো তৌহিদ অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদ। আর এ তৌহিদ প্রতিষ্ঠায় হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) ভূমিকা ছিল অনন্য। এক এবং অদ্বীতিয় আল্লাহর উপাসনা বাদ দিয়ে বিভিন্ন যুগে যখন মানবজাতি হাজারো দেবদেবীর উপাসনায় নিয়োজিত হয়ে নিজেদেরকে এক জঘন্য শয়তানী দাসত্বের নিগড়ে নিক্ষেপ করলো তখনই তাদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর নবী-রাসুলগণ আবির্ভূত হলেন। এ ধারাবাহিকতায়ই হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) আগমণ। আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান আল্লাহর নিকট স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই শেষ নবী হযরত মুহাম্মদও (সাঃ) আদিষ্ট হয়েছেন দুনিয়ার বুকে তৌহিদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শত সহস্র উপাস্যের নিগড় থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করতে। তাঁর প্রতি ওহী নাযিল হলো: “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করছি যে, ইব্রাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না (১৬:১২৩)।” আর এ দ্বীন কি এ ব্যাখ্যায় আল্লাহ্ বলেন, “তার চাইতে উত্তম জীবন বিধান আর কি হতে পারে যে আল্লাহ্ তায়ালার উদ্দেশ্যে মাথা নত করে দেয়, (মূলত) সে-ই হচ্ছে নিষ্ঠাবান ব্যক্তি, (তদুপরি) সে ইব্রাহীমের আদর্শের অনুসরণ করে; আর আল্লাহ্ তায়ালা ইব্রাহীমকে স্বীয় বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন (৪:১২৫)।” আল্লাহর এ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) আদর্শকে অনুসরণ করতে বললেন, “তোমাদের জন্যে ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের (ঘটনার) মধ্যে রয়েছে (অনুকরণযোগ্য) আদর্শ (৬০:৪)।” আল্লাহর এ দ্বীন হলো ইসলাম, যা পরিপূর্ণতা পেয়েছে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) নবুওতকালে। বিদায় হজ্জ্বের দিনে আরাফার মাঠে ওহী নাযিল হলো: “আজকের এ দিনে আমি তোমাদের ধর্মকে চূড়ান্ত করলাম, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে ধর্ম হিসেবে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম..... (৫:৩)।”
মহান আল্লাহ্ তাঁর বন্ধু হযরত ইব্রাহীমকে (আঃ) তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে কুরবানী করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা পালন করতে তিনি সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের নজীর স্থাপন করেছিলেন। প্রতি বছর কুরবানীর প্রথা হযরত ইব্রাহীমের আল্লাহ্-প্রেমের আদর্শের প্রতীক। হজ্জ্বের সময় মীনার ময়দানে পশু কুরবানীর যে প্রথা বিদ্যমান ছিল শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সেটাকেই সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য ইবাদত হিসেবে জারী রাখলেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা পাক-পবিত্র। তাঁর নৈকট্য ও বন্ধুত্ব অর্জন করতে হতে হলে মনের যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা মুছে ফেলতে হবে। মানব মনে শয়তানী ও পাশবিক স্বভাব বাসা বেঁধে আছে। মনের সকল কুস্বভাবকে কুরবানী করেই পাক-পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। কুরবানীর আসল উদ্দেশ্য হলো মনের পশুত্বকে হত্যা করে মানবিক গুণাবলীর দ্বারা নিজেকে উন্নীত করা যাতে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। এ প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখাটি অনুধাবনযোগ্য: “দুদিন বাদে কোরবানি ঈদ আসছে। ঈদের নামাজ আমাদের শিখিয়েছে, সত্যিকারের কোরবানি করলেই মিলবে নিত্যানন্দ। আমরা গরু-ছাগল কোরবানি করে খোদাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করছি। তাতে করে আমরা নিজেদেরকেই ফাঁকি দিচ্ছি। আমাদের মনের ভিতরে যে সব পাপ, অন্যায়, স্বার্থপরতা ও কুসংস্কারের গরু-ছাগল - যা আমাদের সৎবৃত্তির ঘাস খেয়ে আমাদের মনকে মরুভূমি করে ফেলছে, আসলে কোরবানি করতে হবে সেইসব গরু-ছাগলের। হজরত ইব্রাহীম নিজের প্রাণতুল্য পুত্রকে কোরবানি করেছিলেন বলেই তিনি নিত্যানন্দের অধিকারী হয়েছিলেন। আর আমরা তা করিনা বলেই আমরা কোরবানি শেষ করেই চিড়িয়াখানা যাই তামাসা দেখতে। আমি বলি, ঈদ করে যারা চিড়িয়াখানায় যায়, তারা চিড়িয়াখানার ভিতরেই থেকে যায় না কেন? ”
আজকাল কোনকোন পশু-প্রেমিক কুরবানীর বিরুদ্ধে তাদের মতামত ব্যক্ত করছেন। পশু প্রেম থাকাটা ভাল। কবির ভাষায় “জীবে দয়া করে যেজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর” কথাটি চিরন্তন সত্য। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই পশু-পাখী শিকার মানুষের প্রধান পেশা ছিল। আবাহমান কাল থেকেই মাছ-মাংস মানুষের প্রধান খাদ্য। আবার পশুদের মধ্যেও কিছু পশু যেমন বাঘ-সিংহ-শৃগাল, মাছের মধ্যে হাঙ্গর-তিমি, এমনকি পাখীদের মধ্যে শকুন-কাক মাংসাশী প্রাণী। জীবিকা নির্বাহের জন্য এটা বিশ্ব-প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। মাংসের মধ্যে যে পরিমাণ প্রোটিন পাওয়া যায় তা অন্য কোন খাদ্যে তেমনটা থাকেনা। পশু-পাখী-মাছ তথা কোন খাদ্যই মানব-সৃষ্ট নয়, এসব কিছুই মহান আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের ভক্ষণীয় করেছেন। আর ঈদুল আযহায় পশু কুরবানীর নির্দেশ আল্লাহ্ তায়ালাই দিয়েছেন। যারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভালবাসেন অর্থাৎ যাদের মধ্যে আল্লাহ্-প্রেম আছে তাদের জন্য এ কুরবানীর তাৎপর্য অনেক বেশী। তাঁর নির্দেশে মানুষ নিজের সকল প্রিয়তম বস্তুকেই নির্দ্বিধায় কুরবানী করতে পারে। নবী ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে কুরবানী দিতে গিয়ে আল্লাহ্ প্রেমের যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তারই স্মৃতি হিসেবে প্রতি বছর ঈদুল আযহায় পশু কুরবানী উদযাপিত হয়ে থাকে। সুতরাং পশু কুরবানী কোন অপচয় বা নিষ্ঠুরতা নয়, এটা মহান আল্লাহর বিধান। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সকল মুসলমানই এ বিধান মেনে কুরবানী করে থাকেন। কুরবানীর পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না। বান্দার নিয়তটাই আল্লাহ্ দেখে থাকেন। এটা একটি প্রতীকি আমল, আসল উদ্দেশ্য হলো - মনের পশুত্বকে কুরবানী করা এবং অন্তরে আল্লাহর প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করা।
বিষয়: বিবিধ
১১১৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন