ইসলাম কেন মধ্যমপন্থী ধর্ম (সমাপ্তি পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:০৭:৪৬ সকাল
ইসলামের অনুসৃত মধ্যমপন্থা সংঘাতয় বিশ্ব ও বিপন্ন মানবতার জন্য এক বিরাট আশীর্বাদস্বরূপ। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবী হযরত মুহাম্মদকে (সাঃ) ’রাহমাতুল্লিল আলামীন’ অর্থাৎ সৃষ্টিকুলের রহমতস্বরূপ এ দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। তিনি ছিলেন শান্তির প্রতীক এবং শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রচারে তাঁর ছিল শান্তিপূর্ণ বলিষ্ঠ ভূমিকা। মক্কাবাসী কোরেশদের অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ট হয়ে তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন। সেখানকার মুসলিম জনগণ সসম্মানে তাঁকে ও তাঁর অনুসারীগণকে সৌভ্রাতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেন। মদীনার সকল গোত্র, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিয়ে তিনি একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে একটি সাম্প্রদায়িক সহ-অবস্থানের নীতিমালা সম্বলিত সংবিধান রচনা করলেন যা ইতিহাসে ’মদীনা সনদ’ নামে পরিচিত। তৎকালীন সময়ে তাঁর এ সনদটি ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে এক বিস্ময়কর অবদান। বিশ্বাসে, কথায় ও কাজে একই সরল রৈখিক অবস্থানে থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন ইসলাম মধ্যমপন্থী ও শান্তিপূর্ণ ধর্ম এবং এতে নেই কোন বক্রতার অবকাশ।
মদীনা সনদ ও সাম্প্রদায়িক সহ-অবস্থানের নীতিমালাঃ
o ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক নবী মুহাম্মদ (সাঃ) চৌদ্দ শত বছর পূর্বে মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়, গোত্র ও জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে 'মদীনা সনদ' নামে যে জাতীয় ঐক্য চুক্তি সম্পাদন করেন তা বিশ্ব ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অমূল্য দলিল হিসেবে চির ভাস্বর হয়ে আছে। এ সনদে সকল নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার, জীবন ও সম্পদ রক্ষার অধিকার এবং ন্যায় বিচার লাভের অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছিল।
o মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম যারা জিম্মী নামে পরিচিত, তারা ছিল রাষ্ট্রের পবিত্র আমানত। আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর (সাঃ) নামের শপথ দ্বারা তাদের জীবন ও সম্পদ ছিল সুরক্ষিত। ন্যায় বিচার লাভে ছিল তাদের পূর্ণ অধিকার। এ ধরনের ভূরিভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে সে সময়ের ইতিহাসে। পবিত্র হাদীসে নবী করিম (সাঃ) সতর্ক করে বলেছেন, "কেহ কোন জিম্মিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে বেহেশতের গন্ধও শুঁকতে পাবে না (নাসায়ী)।" অন্য হাদীসে আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, "নিষ্ঠুরতা ও অন্যায়কে পরিহর করে চলো, ..... এবং লোভ ও কার্পণ্য থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করো, কারণ এগুলোই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে (রিয়াদুস সালেহীন)।"
o ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) যখন নামাযে ইমামতি করছিলেন তখন একজন অমুসলিম বিষ-মাখা ছুরি দিয়ে তাঁকে আহত করে। এ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু আসন্ন হয়ে পড়ে। মৃত্যু শয্যায় তিনি অমুসলিমদের ওপর প্রতিশোধের আশংকায় উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, "ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত যে জনগোষ্ঠী (অমুসলিম জিম্মিী) আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর (সাঃ) নামে সুরক্ষাপ্রাপ্ত তাদের পক্ষ থেকে আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি যে, তাদের ব্যাপারে আমাদের শপথ পালন করতেই হবে, তাদের রক্ষার ব্যাপারে আমাদেরকে লড়াই করতে হবে, এবং তাদের ওপর সাধ্যাতীত কোন বোঝা চাপানো যাবে না।" সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম জাহানের খলীফা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যাপারে উদারতার যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন তারই বিপরীত দৃশ্যটি দেখা যায় বিংশ শতাব্দীতে। এক শিখ দেহরক্ষীর হাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকান্ডের পরবর্তী প্রতিশোধমূলক নৃশংস ঘটনায় সংখ্যালঘু শিখ সম্প্রদায়ের তিন হাজার মানুষ সরকারী ছত্রছায়ায় গণহত্যার শিকার হয়েছিল। মুসলিম সংখ্যালঘুরাও ভারতে প্রতি নিয়ত একই ধরনের হত্যার শিকার হচ্ছে। সংখ্যলঘুদের ব্যাপারে ইসলামের উদারতা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন এক সমুজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
o খৃষ্টান, ইহুদী ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী মুসলমান সাম্রাজ্যে শত শত বছর এক সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছে। তারা ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সুযোগ পেয়েছে। ইসলামের নামে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কাউকে হত্যা করার অনুমোদন কখনও ছিল না। ভারত সাম্রাজ্যে আট শত বছর মুসলিম শাসন বিরাজ করলেও মুসলমানরা সব সময় সংখ্যালঘুই ছিল। খৃষ্টান ধর্মীয়-যুদ্ধারা (crusaders) ১০৯৯ সালে যখন জেরুযালেম মুসলিমদের নিকট থেকে দখল করে তখন তারা সেখানে গণহত্যা চালিয়ে সব মুসলিম ও ইহুদী জনগোষ্ঠীকে হত্যা করে। অথচ ১৪৫৩ সালে ওটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ যখন খৃষ্টান শাসিত কন্সটান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয় করেন তখন সকল খৃষ্টান নাগরিককে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন।
o ইসরাইলী সাংবাদিক, মানবতাবাদী ও ইসরাইলী সংসদ 'নেসেটের' প্রাক্তন সদস্য ইউরি এভনারী দুইটি উদ্ধৃতি প্রমাণ করে ইসলাম অমুসলিমদের ব্যাপারে কতটা উদার ও মানবতাবাদী ছিল। স্পেনে মুসলিম শাসনামলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, "মুসলিম স্পেন ছিল ইহুদীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য, এবং মুসলিম বিশ্বে ইহুদী হত্যাযজ্ঞ (Holocaust) কখনও সংঘটিত হয়নি। এমনকি হত্যাকান্ডের ঘটনাও ছিল খুবই নগণ্য। মুহাম্মদের (সাঃ) নির্দেশ ছিল আহলে-কিতাবদের (কিতাবধারী ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়) সাথে সহিষ্ণু আচরণ করতে হবে এমন সব শর্তাধীনে যা ছিল অতুলনীয় ও আধুনিক ইউরোপীয় আচরণের তুলনায় বেশী উদার। মুসলমানেরা কখনোই ইহুদী ও খৃষ্টানদের ওপর তাদের ধর্ম জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়নি, বরং বাস্তবে দেখা গেছে, ক্যাথলিক স্পেন থেকে যেসব ইহুদীদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তারা মুসলিম দেশগুলোতে বসতি স্থাপন করেছে এবং সেখানে সমৃদ্ধি লাভ করেছে।" অপর একটি নিবন্ধে তিনি বলেন, "প্রতিটি সৎ ইহুদী যিনি তার জাতির ইতিহাস জানেন, ইসলামের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা অনুভব না করে পারবেন না এ জন্য যে, ইসলাম ইহুদীদেরকে পঞ্চাশ প্রজন্ম পর্যন্ত সুরক্ষা দিয়েছে, যেখানে খৃষ্টান জগৎ বহুবার 'তরবারীর দ্বারা' ইহুদীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে যাতে তারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পরিত্যাগ করে (মুহাম্মদʼস সোর্ড : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০০৬) ।" এর বিপরীতে অকৃতজ্ঞ ইহুদী জাতি ফিলিস্তিনের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর যে নির্মম ও বর্বর নিপীড়ন ও হত্যাকান্ড চালাচ্ছে তাতে বিশ্ববাসী হতবাক।
ইসলাম কখন যুদ্ধের অনুমতি দেয়ঃ
o ইসলাম ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ অনুমোদন করেছে। তাও সেটা করা হয়েছে সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে। মক্কার বুকে ইসলাম প্রচারের প্রথম তেরোটি বছর ছিল আল্লাহর নবী (সাঃ) ও তাঁর অনুসারীগণের ওপর কাফেরদের চরম অত্যাচার, নিগৃহ ও নির্যাতনের কালো অধ্যায়। অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ট হয়ে মুসলমানদের একটি দল আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন এবং অপর একটি দল মদীনায় হিজরত করেন। নবী করিম (সাঃ) যখন জানতে পারলেন কোরেশদের একটি দল তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে তখন বাধ্য হয়ে তিনিও মদীনায় হিজরত করলেন। সেখানেও ওরা তাঁদেরকে শান্তিতে থাকতে দিল না। মদীনা আক্রমণের জন্য তারা সিরিয়া থেকে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে আসল। এই কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহ্ জিহাদের নির্দেশ জারী করলেন। "আর তোমাদের কি হল যে, ওইসব অসহায় নর-নারী ও শিশুদের পক্ষে তেমারা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর; এখানকার অধিবাসীরা যে অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষালম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও।" তবে নবীকে (সাঃ) সতর্ক করে বললেন, "যদি তোমরা তাদের শাস্তি দাও, তবে ঠিক ততটুকুই শাস্তি দেবে যতটুকু অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর তবে সেটাই হচ্ছে ধৈর্যশীলদের জন্য সর্বোত্তম পন্থা (১৬:১২৬)।" প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় ক্ষমা ও ন্যায়নীতি অবলম্বন করতে এবং সীমা লঙ্ঘন না করতে আল্লাহ্ তাঁর নবীকে এভাবে নির্দেশ দিলেন।
o ".........তোমাদিগকে মসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়ার কারণে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি তোমাদের ক্রোধ তোমাদেরকে যেন কখনই সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও আল্লাহ্ভীতির ব্যাপারে সবার সাথে সহযোগিতা করো এবং গুনাহ ও সীমালংঘনের কাজে কাউকে সহযোগিতা করো না। আল্লাহ্কে ভয় করো। তাঁর শাস্তি বড়ই কঠোর। (৫:২)।" মহান আল্লাহর এ নির্দেশটিই প্রমাণ করে ইসলাম কতটা উদার ও সহনশীল ধর্ম। ইসলাম সব সময়ই সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির ব্যাপারে মুসলমানদেরকে সতর্ক করে দিয়েছে।
o যুদ্ধক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংযম ও মানবিকতা প্রদর্শনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে যাতে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মত কোন ঘটনা না ঘটে। এখানে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক মুসলিম সৈন্যদের জন্য প্রণীত যুদ্ধের নীতিমালা উল্লেখ করা হলো: ১. কোন শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিকে হত্যা কর না (হাদীস গ্রন্থ: আবু দাউদ), ২. বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিও না বা মৃতদেহ বিকৃত কর না (আল মুয়াত্তা), ৩. খেজুর বৃক্ষ উৎপাটন কর না বা ফলবতী বৃক্ষ কর্তন কর না (আল-মুয়াত্তা), খাওয়ার প্রয়োজন ব্যতীত কোন প্রাণী হত্যা কর না (আল-মুয়াত্তা), ধর্মীয় উপাসনালয়ে কোন সাধুকে হত্যা কর না এবং উপাসনালয়ের ভিতরে অবস্থানরত কোন ব্যক্তিকেও হত্যা কর না (মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বল), কোন গ্রাম/শহর ধ্বংস কর না, কোন ফসলী জমি/বাগান নষ্ট কর না এবং এবং পশুরপাল হত্যা কর না (সহীহ বুখারী/সুনান আবু দাউদ)।
o নবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) রণনীতি, সন্ধি চুক্তি, যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচরণের নীতিমালা ছিল মানবিকতায় পরিপূর্ণ । কোন কায়েমী বৈষয়িক স্বার্থে, মিথ্যাচারের মাধ্যমে, ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে, প্রতিহিংসার বশে কিংবা গণহত্যা ও বিধ্বংসী নির্মমতার দ্বারা তিনি কখনও তাঁর নীতিকে কলুষিত হতে দেননি। শান্তিপূর্ণ পন্থায় মক্কা বিজয়ের পর তাঁর অনুসৃত ক্ষমা ও উদার মানবিক আচরণ ইসলামের মহানুভবতাকে বিশ্ববাসীর নিকট এক সমুজ্জ্বল নজীর হিসেবে স্থাপন করেছে। চৌদ্দশত বছর পূর্বের সেই মানবিকতা সমৃদ্ধ ইসলামী যুদ্ধনীতিমালা বর্তমান কালের মানবাধিকারকেও হার মানিয়েছে। তরবারীর দ্বারা নয়, বরং শান্তিপূর্ণ নীতিমালার দ্বারাই ইসলাম শত্রুর মন জয় করেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান বিশ্বে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ ইসলামকে একটি উগ্রবাদী জঙ্গীধর্ম বলে চিহ্নিত করার দুরভিসন্ধি করছে। আইএস, আল-কায়েদা, ইত্যাদি নামের জঙ্গীবাজরা যে তাদেরই সৃষ্ট এটা এখন বিশ্ববাসী জানে। তাদের এ ভাওতাবাজী ও ধোকায় পড়ে যাতে কেহ বিভ্রান্ত না হয় সে জন্য মুসলিম উম্মাহকে আরো বেশী সোচ্চার হতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১২৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন