ইসলাম কেন মধ্যমপন্থী ধর্ম
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৬:১০ দুপুর
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মনোনীত ধর্ম ইসলাম মানজাতির ইহলৌকিক ও পালৌকিক শান্তি ও কল্যাণের জন্য আবির্ভূত হয়েছে। ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। শব্দটির মধ্যেই এর নামকরণের সার্থকতা নিহিত রয়েছে। প্রতিদিনের সাক্ষাতে মুসলমানদের পারস্পরিক সম্ভাষণ হলো 'আস্সালামু আলাইকুম' অর্থাৎ আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। এর চেয়ে উত্তম অভিবাদন আর কি হতে পারে? ইসলাম-পূর্ব যুগগুলোতেও অনেক ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল। কালের বিবর্তনে সেসব ধর্ম বিকৃতির কবলে পড়ে তাদের মৌলিক চরিত্র ও যুগোপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। এ পরিস্থিতিতে একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বজনীন ও শাশ্বত ধর্মের প্রয়োজনকে সামনে রেখেই ইসলামের আবির্ভাব। সর্বশেষ ধর্ম হিসেবে ইসলাম মানবজাতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান দিয়েছে, যাতে রয়েছে এ পৃথিবীতে জীবন ধারণের সব রকম দিক-নির্দেশনা। ইসলাম মানুষের স্বভাবগত ধর্ম যাতে জাগতিকতার সাথে রয়েছে আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়। জাগতিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় রেখে কিভাবে পরজাগতিক মুক্তি আসবে ইসলাম সেই দিকনির্দেশনাই দেয়। তাইতো ইসলামে যেমন বৈরাগ্যবাদ নেই, তেমনি নেই অতি-ভোগবাদীতা। আবার ইসলাম কার্পণ্যকে যেমন নিষেধ করে, তেমনি অমিতব্যয়িতাকে অনুমোদন করে না। ইসলাম দানশীলতা ও মিতব্যয়িতকে উৎসাহিত করে। এ ধর্মে আল্লাহ্ মানুষের ওপর তার সাধ্যাতীত কোন বিধান বা দায়িত্ব চাপিয়ে দেন নাই। বরং তিনি সবক্ষেত্রে এমন এক মধ্যমপন্থী নীতি অবলম্বনের তাকিদ দিয়েছেন যাতে নেই কোন চরম পন্থা বা বাড়াবাড়ির স্থান। আল্লাহ্ তাঁর উত্তম নিয়ামতসমূহ তাঁর নির্ধারিত হালাল-হারামের সীমারেখার মধ্যে থেকে ভোগ করার অধিকার মানুষকে দিয়েছেন, কিন্তু সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেছেন (৫:৮৭-৮৮)। ইসলামের এ বাস্তবধর্মীতাই একে এক সরল ও স্বাভাবিক মানবধর্মে পরিণত করেছে। তাই ইসলামের পথ সহজ সরল পথ, এতে নেই কোন বক্রতা ও জটিলতা। আর প্রতিটি মুসলিম তার প্রতিদিনের নামাযে বারবার সরল পথ প্রদর্শনের প্রার্থনা জানায় আল্লাহর দরবারে।
ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে চৌদ্দ শত বছর যাবৎ আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন ও আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) মুখ নিঃসৃত বাণী আল-হাদীস এ ধর্মের সমুজ্জ্বল আলোবর্তিকা হিসেবে মানবজাতিকে শান্তির দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। ইসলাম যে একটি শান্তিপূর্ণ মধ্যমপন্থী ধর্ম তা ইসলামের প্রকৃত ইতিহাসের দিকে নজর দিলেই উপলব্ধী করা যাবে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে মুসলমানদেরকে এক মধ্যমপন্থী উত্তম জাতি হিসেবে অভিহিত করে বলেন, "তোমরাই (এই দুনিয়ায়) সর্বোত্তম জাতি, সমগ্র মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। (তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে) তোমরা দুনিয়ার মানুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে, নিজেরাও তোমরা আল্লাহর ওপর (পুরোপুরি) ঈমান আনবে (৩:১১০)।" ইসলামের প্রচারক মহান আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) সময় থেকেই শান্তিপূর্ণ মৌলনীতির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। তাই ইসলামকে বিচার করতে হলে এর প্রচারক নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগকেই আদর্শ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এরপর থেকে ইসলামী নীতি অনুযায়ী দেশের শাসন কাজ পরিচালনায় শিথিলতা ও ব্যত্যয় ঘটতে শুরু করে। পরবর্তীকালের মুসলিম শাসকগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে নয়, বরং বংশতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের রাষ্ট্র সীমানা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্যই তাদের শাসন কাজ পরিচালনা করেছিলেন। তাই এ নিবন্ধের আলোচনা মূলত ইসলামের প্রাথমিক আদর্শিক যুগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে যে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তখন অনুসরণ করা হতো সেগুলোই নীচে আলোচিত হলো।
ইসলামের শান্তিপূর্ণ নীতিমালাঃ
o ইসলামে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো ঈমান ও সৎকর্ম। বংশ-মর্যাদা, ঐশ্বর্য, শক্তিমত্তা, সুন্দর চেহারা বা গায়ের উজ্জ্বল রঙ, এর কোনটিই আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হিসেবে গণ্য নয়। ঈমান ও সৎকর্ম ব্যতীত অন্য কোন প্রকার ভেদাভেদ দ্বারা মানুষের মর্যাদা নির্ধারণের বিধান ইসলামে নেই। আল্লাহর আইনে সব মানুষই সমান, আর এ আইন ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, "আমি আমার রসুলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে (৫৭:২৫)।" আপন-পর, ধনী-গরীব, সবল-দুর্বল, জাতপাত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্র ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জোর নির্দেশ এসেছে কুরআন ও হাদীস থেকে।
o বিদায় হজ্বের ভাষণে নবী করিম (সাঃ) বলেন, "হে মানবমন্ডলী! আল্লাহ্ বলেছেন, ‘হে মানুষ, আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন মানব ও একজন মানবী থেকে এবং গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। নিশ্চয় আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে মর্যাদবান যে সবচেয়ে বেশী খোদা-ভীরু।’ সকল মানুষ আদমের বংশধর এবং আদম মাটি থেকে তৈরী। অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের, কালোর ওপর সাদার অথবা সাদার ওপর কালোর কোনই শ্রেষ্ঠত্ব নেই শুধুমাত্র পরহেজগারী ছাড়া।"
o ইসলাম কখনই হত্যা, সংঘাত ও হানাহানিকে প্রশ্রয় দেয় না। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন: “আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ (২:২১৭)”, “ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই (২:২৫৬)”, “যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে (৫:৩২)”। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ্ ইচ্ছে করলেই সব সম্প্রদায়কে একই জাতি সত্তার অন্তর্ভূক্ত করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা চাননি (১১:১১৮)। তিনি যেমন মানুষকে মতভেদ করার স্বাধীনতা দিয়েছেন, তেমনই সঠিক দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। এরপরও যারা পথভ্রষ্ট হবে তারা তা নিজ দায়িত্বেই হবে। কিয়ামতের পর বিচার দিবসে আল্লাহ্ এ মতভেদের ফয়সালা করবেন। আল্লাহর এসব বাণীই হলো ইসলামের শান্তিপূর্ণ নীতির ভিত্তি। তাই ইসলামের ইতিহাসে ধর্মীয় কারণে গণহত্যার কোন নজীর নেই।
o মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে কুদসীতে রসুল (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ্ বলেছেন, জুলুম করা আমি আমার নিজের জন্য অবৈধ করেছি, তেমনই আমার বান্দাদের জন্যও অবৈধ করেছি।” জুলুম, পারস্পরিক হানাহানি বা অশান্তি নয়, বরং মানবজাতির কল্যাণ ও শান্তি অর্জনই ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। এক হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, প্রতিবেশী যে ধর্মেরই হোক তাকে অভুক্ত রেখে পেটপুরে খেলে ঈমানদার হওয়া যায় না। প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখ, অভাব ও কষ্টকে ভাগ করে নিতে ইসলাম নির্দেশ দেয়। প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও ভালবাসাপূর্ণ সমাজই ইসলামের কাম্য। তাঁরই প্রণীত ‘মদীনা সনদ’ মদীনায় বসবাসরত সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিয়ে এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে।
o মন্দকে মন্দ পন্থায় মোকাবিলা করা ইসলামের নীতি নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর নির্দেশ হলো: “(হে নবী) ভালো আর মন্দ কখনোই সমান হতে পারে না, আপনি ভালো’র দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করুন, তাহলেই আপনার মধ্যে এবং যার সাথে আপনার শত্রুতা - তার মধ্যে এমন (অবস্থার সৃষ্টি) হয়ে যাবে যেন সে আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ (অবস্থা) শুধু তাদেরই (ভাগ্যে লেখা) থাকে যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং এসব লোক তারাই হয় যারা সৌভাগ্যের অধিকারী (৪১:৩৪-৩৫)।” অন্যত্র মহান আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নবীকে (সাঃ) বলেছেন, “মন্দকে প্রতিহত করুন সর্বোত্তম পন্থায় (২৩:৯৬)।” রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় এ সর্বোত্তম পন্থাটিই অনুসরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনের এসব নির্দেশনা ও উদার নীতি শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় বিরাট অবদান রেখেছে। যার ফলে ইসলাম দ্রুত গতিতে সারা বিশ্বে প্রসার লাভ করতে পেরেছে। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৮৫১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন