রামাযান পরবর্তী জীবন

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৯ জুলাই, ২০১৬, ১১:৫৪:৩৭ সকাল

শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে অবসান হয় রামাযান মাসের সিয়াম সাধনা। তখন রহমত, মাগফিরাত ও নাযাতের মাস পবিত্র মাহে রামাযান একটি বছরের জন্য আমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে যায়। ঈদের আনন্দোৎসবের মধ্য দিয়ে শুরু হয় রামাযান পরবর্তী জীবন। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে অফুরন্ত নিয়ামতের রামাযান মাসটি। একদিকে সিয়াম সাধনা আর অন্যদিকে পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস হিসেবে মানব জীবনে এ মাসটির প্রভাব অনেক বেশী। এ মর্যাদাবান মাসটিতে অন্য মাসের তুলনায় দশ থেকে সত্তর গুণ বেশী সওয়াব লাভের আশায় মু’মিন বান্দারা নিজেদেরকে বেশী বেশী নেক আমলের মধ্যে নিয়োজিত রেখেছেন। মাহে রামাযান মূলত মনো-দৈহিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির মাস। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগী তাদেরকে আত্ম-সংশোধন ও আত্মোন্নতির পাথেয় যুগিয়েছে এবং মুত্তাকীতে (খোদাভীরু) পরিণত করেছে। মহিমান্বিত এই মাসে দিনের বেলায় সিয়াম সাধনা, রাতের দীর্ঘ তেলাওয়াতের মাধ্যমে সালাত আদায়, যিকির-আযকার ও প্রচুর দান-খয়রাত মু’মিন বান্দার বাহ্যিক ও আত্মিক জীবনকে করেছে পরিশুদ্ধ ও উৎকর্ষ। সিয়াম সাধনা একদিকে অন্তরে স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টিতে যেমন সহায়ক হয়েছে, ঠিক তেমনি দৈহিক ও মানসিক প্রবৃত্তিগুলোকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত করার শক্তি সঞ্চার করেছে। অন্তরকে বিরত রেখেছে যাবতীয় কুচিন্তা-ভাবনা থেকে, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সংযত রেখেছে যাবতীয় অপকর্ম, হারাম ও গুনাহের কাজ থেকে। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহর নির্দেশে এ মাসে দিনের বেলায় হালাল খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ এবং আপন স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলন থেকে বিরত রেখেছে নিজেকে। এভাবেই এক মাসের সাধনায় মু’মিন বান্দা লাভ করেছে দেহ ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করার এক স্বর্গীয় শক্তি। এদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, "নিশ্চয় সে সাফল্য লাভ করবে, যে পরিশুদ্ধ হয় এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করে, অতঃপর নামায আদায় করে (৮৭:১৪-১৫)।”

রামাযানের সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মন্দ রিপুগুলোকে অবদমিত করে তার চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন, মানুষকে আল্লাহমুখী করে তোলা, তার অন্তরে ’তাকওয়া’ (খোদাভীতি) সৃষ্টি করা এবং জীবনকে সংযত, ন্যায়নিষ্ঠ ও সুশৃঙ্খল করে গড়ে তোলা। মানুষের অন্তর যখন আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবে, তখন সে যেকোন মন্দ ও পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। নিজের ফায়দা লুটার জন্য যে অন্যের ক্ষতি করলো পরিণামে সে নিজেই মহাক্ষতিগ্রস্ত হবে - অন্তরে খোদাভীতি থাকার কারণে সে তা উপলব্ধী করতে সক্ষম হবে। রামাযান মাসের সাধনা তার এ চেষ্টা ও উপলব্ধীকে আরো শাণিত ও কার্যকর করবে। জীবন চলার পথে লোভ-লালসা, রিপু ও কামনা-বাসনার তাড়না, হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়-অপরাধ এবং যাবতীয় শয়তানী কুমন্ত্রণা ও কুপ্ররোচনা যা মানুষকে বিপথগামী করে ফেলে। এসব থেকে বেঁচে থাকার জন্য রামাযান মাসের সিয়াম সাধনা বর্ম বা ঢাল হয়ে তাকে রক্ষা করবে। তাই মহানবী (সাঃ) তাঁর এক হাদীসে রামযানের রোজাকে ঢাল স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। যদি আমরা রামাযান পরবর্তী জীবনে সিয়াম সাধনার প্রভাবকে ধরে রাখি তাহলে সিয়াম সত্যিকার অর্থে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তার ঢাল স্বরূপ পরিগণিত হবে।

রামাযান পরবর্তী জীবনকে একটি পরিমার্জিত জীবন ব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটানোর জন্য এর ধারাবাহিকতাকে অব্যাহত রাখতে হবে। এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নফসের কামনা বাসনা ও আমলসমূহের সংস্কার সাধিত হয়, অর্জিত হয় আত্মিক উন্নতি। এ উন্নতিকে বাকী এগারো মাস ধারণ করে রাখার মধ্যেই রয়েছে মহা সফলতা। রামাযান মাসে যে সংযমী আচরণ ও সহমর্মীতার চর্চা হয়েছে ও যে নেক আামলসমূহ গড়ে ওঠেছে তা রামাযান পরবর্তী জীবনের জন্য এক সুন্দর পাথেয় হিসেবে কাজ করবে। অন্তরের কামনা বাসনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার যে মানসিক ও আত্মিক শক্তি তৈরী হয়েছে তার দ্বারা মু’মিন বান্দা তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখতে সমর্থ হবে। সে তখন তার হাতকে অন্যায় বা হারাম কাজের দিকে বাড়াবে না, পা’কে অবৈধ কাজে অগ্রসর হতে দেবে না, চোখকে অশ্লীলতা ও হারাম থেকে বাঁচিয়ে রাখবে, কানকে বাজে কথাবার্তা শ্রবণ থেকে বিরত রাখবে, হারাম খাবার দিয়ে উদর পূর্তি করবে না, লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে এবং যবানকে পরচর্চা, পরনিন্দা, অপবাদ, গীবত, গালিগালাজ ও মিথ্যা কথাবার্তা থেকে সংযত রাখবে। এ ছাড়া হালাল উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবে, গরীব আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর হক আদায় করবে, দুঃস্থের প্রতি সহমর্মীতা ও সহৃদয়তার হাত প্রসারিত করে দেবে এবং কার্পণ্যকে দূরে ঠেলে দানশীলতকে প্রাধান্য দেবে। রামাযান মাসে গড়া ওঠা এ অভ্যেসগুলো যখন দৈনন্দিন জীবনে অনুশীলন করা হবে তখন দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে আসবে পরম সাফল্য। এ সাফল্য অর্জনকারী মু’মিন বান্দাগণকে মহান আল্লাহ্ নিজ হাতে পুরস্কার দেওয়ার বা নিজেই বান্দার পুরস্কার হয়ে যাওয়ার মহা ঘোষণা দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে?

রামাযান শেষে ঈদুল ফিতর আসে এক নির্মল স্বর্গীয় আনন্দ নিয়ে। এ আনন্দ ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই ভাগ করে নেয়। ঈদের নামাযের আগেই বন্টন করে দেওয়া হয় গরীবের হক ফিৎরা যাতে তারাও ঈদের আনন্দে শরীক হতে পারে। ঈদগাহে ধনী-গরীব সবাই একই সারিতে নামায শেষে কোলাকুলিতে মিলিত হয়। ঘরে ঘরে চলে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের আনাগোনা। সবাই ভাগ করে খায় ঈদের মজাদার খাবার। হৃদ্যতায় ভরে ওঠে সামাজিক পরিবেশ। রামাযানের শিক্ষা অনুযায়ী ঈদের আনন্দ হতে হবে ভাব-গাম্ভীর্যতায় পরিপূর্ণ। কোন রকম অশ্লীলতা ও উদ্দাম উল্লাসে মাতোয়ারা হওয়া যাবে না যাতে রামাযানে চর্চিত সংযমের মর্যাদা বিনষ্ট হয়। আজকাল আমাদের সমাজে তথা বিশ্বের সর্বত্র যেনতেন প্রকারে জীবনকে উপভোগ করার এক নেতিবাচক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। ভোগ-বিলাসী জীবনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ অতি মাত্রায় বেড়ে গেছে। এ প্রতিযোগিতায় একদল মানুষ আকাশচুম্বী অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে বিলাস-ব্যসনে পরিপূর্ণ অসংযমী জীবন কাটাচ্ছে, অপরদিকে আরেকটি দল শোষিত, বঞ্চিত ও পতিত হয়ে অনাহারে, অপুষ্টিতে, অসুখে-বিসুখে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। মানব সমাজের এ অসঙ্গতি সত্যিই বড় পীড়াদায়ক ও অমানবিক। অসংযত জীবন যাপনের জন্য মানব সমাজ আজ ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ ও মুক্তির একটাই উপায় - তা হলো রামাযানের শিক্ষা ও সিয়াম সাধনাকে নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে বাস্তবায়ন করা। এ মাসের কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠে সংযমী, অর্জিত হয় সৎ গুণাবলী, সাধিত হয় মানবতার উৎকর্ষ ও বিকাশ। রামাযানের প্রভাব মানুষের সমষ্টিগত জীবনে আনবে সহমর্মীতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য। সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে গড়ে ওঠবে এক শান্তিপূর্ণ সমাজ। রামাযান পরবর্তী জীবনের এটাই হোক সবার কাম্য।

বিষয়: বিবিধ

৯৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File