পবিত্র রামাযান মাসের মুনাফা
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২৮ জুন, ২০১৬, ১১:৩৮:৫৯ সকাল
পবিত্র রামাযান মাস এমন একটি মহিমান্বিত মাস যে সময়ে প্রতিটি নেক কাজের বিনিময় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন দশ থেকে সত্তর গুণ বাড়িয়ে দেন। এ মাসের প্রথম দশ দিন মহান আল্লাহ্ তাঁর রহমত ও দয়ার ভান্ডার বান্দাদের জন্য অবারিত করে দেন। এ সময় মু’মিন বান্দারা তাঁর অফুরন্ত রহমতের ফল্গু ধারায় আপ্লুত হতে থাকে। এর দ্বিতীয় দশ দিনে মহান আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত বান্দারা তাঁর অসীম ক্ষমা ও মার্জনার দ্বারা পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা লাভ করে। এরপর তৃতীয় ও শেষ দশ দিনে দয়াল আল্লাহ্ পাকের অপার দয়া ও ক্ষমার কারণে এসব বান্দা দোজখের আগুন থেকে পুরোপুরি নাযাত পেয়ে জান্নাতের সওগাত লাভ করে। মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতীব দয়া পরবশ হয়ে এ মাসের শেষ দশ দিনের কোন একটি বেজোড় রাতের ইবাদতকে সহ¯্র মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক মূল্যবান ও মর্যাদবান করে দিয়েছেন। এ যে কত বড় সৌভাগ্য আমাদের জন্য তা কি আমরা বুঝতে সক্ষম? মহান আল্লাহ্ সুরা ক্বদরে এ রাতটিকে ’লাইলাতুল ক্বদর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এর অপরিমেয় মাহাত্মের কথা বর্ণনা করেছেন। এ রামাযান মাস পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস, এ মাস সওম বা রোজা পালনের মাস। এ মাসে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের চর্চা ও সর্বক্ষেত্রে সংযম পালনের চর্চা মু’মিন বান্দাকে রামযান মাসের উপরোক্ত ফজিলত লাভের যোগ্য করে তোলে। রামযান মাস সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও সহমর্মীতার মাস। রোজায় উপবাস থাকার যে কষ্ট, তা দিয়ে গরীবের কষ্টকে অনুধাবন করা যায়। ধনীর অন্তর গরীবের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে, তারা এ মাসে আরো বেশী দানশীল হয়ে ওঠেন। তাই এ মাস হলো মু’মিন বান্দাগণের জন্য এক বিরাট মুনাফা অর্জনের মাস।
পবিত্র রামাযান মাসের শুরুতেই মু’মিন বান্দার জীবন যাপনের ধরন বদলে যায়। তাদের অন্তরে জাগ্রত হয় এক পূত-পবিত্র ভাব যা তাদেরকে খোদাভিমুখী করে তোলে। তারা একাগ্র চিত্তে ইবাদত-বন্দেগীতে ঝুঁকে পড়ে। তাদের মধ্যে বেশী বেশী নেক আমল করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অন্য মাসগুলো থেকে এ মাসের স্বাতন্ত্র্য এখানেই। বিভিন্ন হাদীসে এ মাসের সম্মান, মর্যাদা ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীসে উল্লেখ আছে, শাবান মাস শেষে যখন রামাযান সমাগত হয় তখন নবী করিম (সাঃ) এক ভাষণে বলেন, ’হে লোকসকল, এক মহাপবিত্র ও বরকতময় মাস তোমাদের মাথার ওপর ছায়া বিস্তার করেছে। এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা বরকত, ফযীলত ও মাহাত্ম্যের দিক দিয়ে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসে সওম পালনকে আল্লাহ্ তায়ালা ফরজ করেছেন এবং এর রাতগুলোকে আল্লাহর সামনে (নামাজে) দাঁড়নোকে নফল ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি এ রাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় কোন সুন্নত বা নফল ইবাদত করবে, তাকে এর বিনিময়স্বরূপ অন্য সময়ের ফরজ ইবাদতের সওয়াব দান করা হবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে কোন ফরজ ইবাদত সম্পাদন করবে সে অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব লাভ করবে।’
এত বড় মহিমান্বিত একটি মাস পেয়েও যারা অবহেলা ভরে এর অবমাননা করলো, অসংযমী ও অন্যায় আচরণ দ্বারা নিজেদেরকে কলুষিত করলো, তাদের চেয়ে হতভাগা এ জগতে আর কেউ নেই। আল্লাহর প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, এ রামাযান মাসটিকে পেয়েও যারা তওবা করে নিজেদের সংশোধন করাতে পারলো না, গুনাহসমূহ মাফ করিয়ে নিতে পারলো না তারাই সবচেয়ে হতভাগা ও লা’নতপ্রাপ্ত। আমাদের সমাজে এ ধরনের হতভাগাদের অভাব নেই। এরা এ মাসটিকে অন্যায়ভাবে পার্থিব মুনাফার এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ সময় অসৎ ব্যবসায়ীরা মুনাফাখোরীতে লিপ্ত হয়, অসৎ কর্মচারীরা ঘুষ বাণিজ্যের পসার বসায়। এভাবে বিছু হতভাগারা প্রতারণা, ছিনতাই, রাহাজানি ও অন্যান্য অসৎ কাজের দ্বারা লাভবান হওয়ার প্রচেষ্টায় রত থাকে। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে অসৎ ব্যবসায়ীরা অতি-মুনাফার আশ্রয় নেয়। তারা একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত গড়ে তোলে, অপরদিকে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী করে তোলে। এভাবে সারা বছরের লাভ এক মাসেই করার অপচেষ্টায় মত্ত হয়। ফলে সাধারণ মানুষ অশেষ ভোগান্তির শিকার হয়, দারুণ কষ্টের মধ্যে তারা রামাযানের ইবাদত পালন করে। এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় বিদেশের ক্ষেত্রে। অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীগণ যে কোন ধর্মীয় উৎসবে অথবা গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোতে মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। তারা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মত যেনতেন প্রকারে দাম বাড়িয়ে জনজীবনে দুর্বিষহ যন্ত্রণার সৃষ্টি করেন না। বরং তারা সাধারণ মানুষ যাতে ন্যায্য মূল্যে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রেখে বিরাট মূল্যহ্রাস বা ’সেইল’ দিয়ে থাকেন। তারা সৎ ব্যবসায়ীর মন-মানসিকতা নিয়েই ব্যবসা করেন, মানুষের দুঃখ-কষ্টকে পুঁজি করে নয়।
ইসলাম ব্যবসাকে হালাল করেছে, আর শোষণের প্রতীক সুদ, ঘুষ, মুনাফাখোরী, মজুতদারী, ভেজাল, প্রারণা, ইত্যাদিকে করেছে হারাম। সৎ ব্যবসায়ীদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে নবী করিম (সাঃ) বলেছেন. কেয়ামতের দিন তারা সততার কারণে নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাহচর্যে অবস্থান করবে। মিথ্যাচার ও বেঈমানী থেকে মুক্ত ব্যবসাকে তিনি সর্বাধিক পবিত্র উপার্জন বলে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে মুনাফাখোর, মজুতদার, অসৎ ও ভেজাল প্রদানকারী ব্যবসায়ীরা অভিশপ্ত ও পাপিষ্ট হযে কেয়ামতের দিন উত্থিত হবে এবং কঠোর আযাবের সম্মুখীন হবে বলে তিনি সতর্ক করেছেন। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যারা মজুত করে তাদেরকে তিনি অভিশপ্ত ও নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। যারা পণ্য বেচাকেনার ক্ষেত্রে মিথ্যা কসম করে পণ্যের মান ও দাম বাড়িয়ে বলে এবং ওজন ও মাপে কম দেয় তাদের ধ্বংস সম্পর্কে তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। অর্থাৎ যে কোন অসৎ পন্থায় উপার্জনকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। যারা হারাম উপার্জনের দ্বারা জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে তাদের কোন ইবাদত বন্দেগীই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
পবিত্র রামযান মাস হলো পারস্পরিক সহানুভূতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দয়া-দাক্ষিণ্যে ভরপুর একটি সম্মানিত মাস। এ মাসে বেশী বেশী সওয়াবের আশায় যাকাত, সাদাকা, ফিৎরা ও দান-খয়রাতের কারণে ধনীর অন্তর গরীবের প্রতি সহমর্মীতা ও সহৃদয়তায়ভরে ওঠে। এছাড়াও রোযাদারকে ইফতার করানোর মধ্যে রয়েছে বান্দার গুনাহ্ মাফের এক সুবর্ণ সুযোগ। রাসুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, ’যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে ইফতার করাবে আল্লাহ্ তাকে আমার হাউজে কাওসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে চিরসুখময় জান্নাতে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত সে কখনো পিপাসার্ত হবে না।’ সারাদিন রোযা রেখে ইফতার করার মধ্যে রয়েছে এক স্বর্গীয় আনন্দানুভূতি। এ মাসের ইবাদত-বন্দেগীর পুরস্কার আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন নিজ হাতে প্রদানের ওয়াদা করেছেন। এটাও পবিত্র রামাযানের এক বিরাট মর্যাদার বিষয়। রামাযানুল মোবারকের পুরোপুরি হক আদায় করে এ মহিমান্বিত মাসের সম্মান ও মর্যাদাকে যারা সমুন্নত রাখবে তারাই দুনিয়া ও আখিরাতে প্রকৃত সাফল্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করবে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তৌফিক দান করুন যাতে আমরা সবাই পবিত্র এ মাসের রহমত, মাগফেরাত ও নাযাত লাভের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে সমর্থ হতে পারি। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
৯১৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন