আল মিরাজ শরীফ
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০১ মে, ২০১৬, ০৫:৫৮:০০ বিকাল
ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র মিরাজ একটি ঐশিক ও অলৌকিক ঘটনা। এর পূর্ণ নাম হলো 'আল ইসরা ওয়াল মিরাজ’, অর্থাৎ নৈশ ভ্রমণ ও ঊর্দ্ধগমণ। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর প্রিয় নবী ও হাবিব মুহাম্মদুর রাসুল্লাহকে (সাঃ) এক পবিত্র রজনীতে কাবা শরীফের প্রাঙ্গণ থেকে জেরুযালেমস্থ পবিত্র মসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি তাঁর বান্দাকে ঊর্দ্ধ জগতে তাঁর নৈকট্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। এত অল্প সময়ে এ সুদীর্ঘ ভ্রমণ ছিল নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের একটি অলৌকিক ঘটনা যা সংঘটিত হয়েছিল মতভেদে তাঁর নবুওতের দশম বর্ষে, রজব মাসের সাতাশতম রাতে। এ ঘটনা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, "পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত - যার চতুষ্পার্শকে আমি পর্যাপ্ত বরকতময় করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা (১৭:১)।" মসজিদে হারাম অর্থাৎ পবিত্র মক্কার কা’বা শরীফ থেকে মসজিদে আকসা অর্থাৎ জেরুযালেমের বায়তুল মোকাদ্দস পর্যন্ত ভ্রমণটি ছিল আল ইসরা বা নৈশ ভ্রমণের প্রথম পর্ব। আর দ্বিতীয় পর্বের ভ্রমণটি ছিল মিরাজ অর্থাৎ ঊর্দ্ধগমণ যা সংঘটিত হয়েছিল মসজিদে আকসা থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর আরশ পর্যন্ত। এক বিশেষ পটভূমিকায় এ অলৌকিক ভ্রমণ সংঘটিত হয়েছিল। এ সময়ে নবীজী (সাঃ) তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজা (রাঃ) এবং তাঁর অতি শ্রদ্ধাস্পদ চাচা ও অভিবাবক আবু তালিবকে হারিয়ে বিষাদগ্রস্ত ছিলেন। এ নাজুক সময়ে মক্কার কোরেশদের নির্যাতন ও অপমানে অতিষ্ট হয়ে নবী (সাঃ) গিয়েছিলেন তায়েফে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে তিনি প্রত্যাখ্যাত ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসেন মক্কায়। সুতরাং সময়টা ছিল বড়ই দুর্যোগপূর্ণ ও সংকটময়। মহান আল্লাহ্ তাঁর সম্মানিত নবী, একনিষ্ঠ বান্দা ও প্রিয় বন্ধুর মনে প্রশান্তি ও উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য সৃষ্টির অদৃশ্য ও অপার রহস্যময় জগতকে উন্মোচিত করে দিতে চাইলেন তাঁর বন্ধুর নয়ন সম্মুখে। আর এ উদ্দেশ্যেই এ নৈশ ভ্রমণের আয়োজন করলেন তিনি। হযরত জিব্রিলকে (আঃ) করলেন নবীর (সাঃ) এ ভ্রমণ সঙ্গী ও গাইড। বিস্ময়কর বাহন বোরাকের মাধ্যমে এ ভ্রমণ সংঘটিত হয়েছিল। বোরাক অর্থ বিদ্যুৎ আর এ বিদ্যুৎগতি সম্পন্ন বাহনই ছিল শেষ যামানার শেষ নবীর (সাঃ) নৈশ ভ্রমণের বাহন । বর্তমান মহাশূণ্য ভ্রমণের যুগের সূচনাতো হয়েছিল সেই চৌদ্দশত বছর পূর্বে মহানবীর (সাঃ) ইসরা ও মিরাজের মাধ্যমে। সেই অলৌকিক ভ্রমণের সাথে বর্তমানের মহাশূণ্য অভিযানের বিরাট পার্থক্য থাকলেও উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে কিছুটা মিল রয়েছে, যেমন, সৃষ্টির অপার রহস্যকে জানা।
মিরাজের রজনীটি ছিল দিগন্ত-বিস্তৃত আঁধারে ঢাকা, প্রকৃতি জুড়ে ছিল শুনশান নীরবতা। কর্মচঞ্চল দিবসের ব্যস্ততা শেষে জনপ্রাণী তখন গভীর নিদ্রায় বিভোর। অন্যান্য সবার মত এ সময়ে রাতের ইবাদত শেষে মহানবী (সাঃ) তাঁর চাচাতো বোন উম্মে হানীর ঘরে নিদ্রামগ্ন ছিলেন। সে রাতের শেষ প্রহরে আগমণ ঘটল জিব্রিলের (আঃ)। তিনি নবী করিমকে (সাঃ) সযত্নে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললেন, 'মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের আমন্ত্রণে এ রাতে আপনি এক অনন্য সাধারণ ভ্রমণে যাবেন এবং আমি অপনার সাথী হব। আল-বোরাক নামক এক বাহনে আপনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করবেন।’ প্রথমে তাঁরা গেলেন পবিত্র কাবা গৃহে এবং কাবা শরীফের হাতীমে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। সেখানে ফেরেশতাগণ অলৌকিক উপায়ে তাঁর বক্ষ-উম্মোচন করে তাঁর ক্বলবকে (হৃদপিন্ড) বের করে আনলেন এবং তা পবিত্র জমজম কূপের পানি দিয়ে ধুইয়ে পুনরায় তা তাঁর বক্ষে স্থাপন করলেন। এর তাৎপর্য এমন হতে পারে যে, তাঁর দেহ ও অন্তরকে মহাকাশ ভ্রমণের উপযোগী করে তোলা। সেখান থেকে তাাঁর গেলেন পবিত্র মদীনায় এবং সেখানেও দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। জিব্রিল (আঃ) তাঁকে এ জায়গার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এটাই হবে আপনার ও আপনার প্রিয় সঙ্গীদের হিজরতের স্থান। এরপর তাঁরা গেলেন সিনাই পাহড়ের তোয়া উপত্যকায়। সেখানেও দু’রাকাত নামায আদায়ের পর জিব্রিল (আঃ) তাঁকে এ জায়গাটির পরিচয় জানিয়ে বললেন, এটি পবিত্র তোয়া উপত্যকা যেখানে আল্লাহ্ তাঁর নবী মূসার (আঃ) সাথে কথা বলেছিলেন। তাঁদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল যেরুজালেমের বেথেলহেম। সেখানেও দু’রাকাত নামায আদায়ের পর নবী ঈসার (আঃ) জন্মস্থানের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেখান থেকে তাঁরা গেলেন নবী হযরত সুলাইমান (আঃ) নির্মিত মসজিদে আকাসায়, যা ছিল মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা। সেখানে তিনি দু’রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায আদায় করেন। বোরাকযোগে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত আল-ইসরা বা নৈশ ভ্রমণের প্রথম পর্বের এখানেই ছিল সমাপ্তি। এ পর্বে মসজিদে আকসায় নবীজীর (সাঃ) ইমামুল মুরসালীন ওয়া নাবীয়্যিন হিসেবে দু’রাকাত নামায পড়ার বিষয়টি মিরাজে যাওয়ার পথে না মিরাজ থেকে ফেরার পথে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা নিয়ে কিছুটা মতদ্বৈততা রয়েছে। অনেকে বলেন, এ নামায মিরাজ থেকে ফেরার পথে হয়েছিল। তাই এখানেও এর বিবরণ পরের পর্বেই আলোচিত হবে।
মসজিদে আকসা থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের ভ্রমণ যা আল মিরাজ নামে পরিচিত। এ পর্যায়ে ঊর্দ্ধগমণের জন্য আনা হয় তীব্র গতিসম্পন্ন অলৌকিক সিঁড়ি। সে সিঁড়িটি নবীজীকে (সাঃ) নিয়ে ধাপে ধাপে প্রথম আকাশ হয়ে সপ্তম আকাশ পেরিয়ে অনন্তের দিকে ধাবিত হলো। এ যাত্রায় তিনি বিভিন্ন আকাশে অবস্থানরত বিভিন্ন নবী ও রাসুলের রুহের সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করেন। ক্রমান্বয়ে প্রতিটি আসমানে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয় হযরত আদম (আঃ), ইয়াহিয়া (আঃ), ঈসা (আঃ), ইউনুছ (আঃ), ইদ্রিস (আঃ), হারুন (আঃ), মূসা (আঃ) ও হযরত ইব্রাহীম (আঃ), প্রমুখ নবী ও রাসুলগণের। তাঁরা সবাই নবীজিকে (সাঃ) সালাম দিয়ে স্বাগত জানান। এরপর তিনি ফেরেশতাদের ইবাদত গৃহ ʼবায়তুল মামুর’ পরিদর্শন করেন। প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা সেই মসজিদে তাওয়াফ এবং আল্লাহর ইবাদত ও প্রশংসা কীর্তনে নিয়োজিত থাকেন। নবী করিম (সাঃ) সেখানে দু’রাকাত নামায আদায় করেন। তাঁর পরবর্তী গন্তব্য ছিল মহাকাশের প্রান্তসীমায় অবস্থিত ʼসিদরাতুল মুনতাহা’ নামের একটি বিশাল বৃক্ষ যা মহাকাশের সীমান্ত নামে পরিচিত। এর মূল ছিল ষষ্ঠ আকাশে, এর শাখা বিস্তৃত ছিল সপ্তম আকাশে এবং এর ছায়া প্রসারিত ছিল সমগ্র আকাশ ও জান্নাত জুড়ে। এ পূত-পবিত্র বৃক্ষটি এক অবর্ণনীয় জ্যোতির দ্বারা সমাচ্ছন্ন ছিল এবং এর চারপাশে আল্লাহর প্রশংসায় নিয়োজিত ফেরেশতাগণ নবীজী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর (সাঃ) আগমণের প্রতীক্ষারত ছিলেন। এ বৃক্ষের সীমা অতিক্রম করা কোন ফেরেশতা বা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই প্রান্ত সীমায় গিয়ে অলৌকিক সিঁড়িটি থেমে গেলো।
হযরত জিব্রিলও (আঃ) সিদরাতুল মুনতাহায় এসে তাঁর যাত্রার বিরতি ঘটালেন। এখানে নবীজী (সাঃ) হযরত জিব্রিলকে (আঃ) দ্বিতীবারের মত তাঁর স্বরূপে দেখলেন। তাঁর ছিল মহাশক্তিময় ছয়শত ডানা। সহযাত্রী জিব্রিলের (আঃ) যাত্রা শেষ হলেও মহানবীর (সাঃ) যাত্রা ছিল আরও বহু দূরে অবস্থিত আল্লাহর আরশে। এ পথে তাঁর বাহন ছিল ʼরফরফ’ নামের সবুজ বর্ণবিশিষ্ট একটি স্বয়ংক্রিয় পাল্কী, যার সাহায্যে তিনি আল্লাহর দরবারে তশরীফ নিয়েছিলেন। সেখানে মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় নবীর (সাঃ) সাথে কথা বিনিময় করেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, "তোমরা কোন বিষয়ে বিতর্ক করছো, যা তিনি দেখেছেন? নিশ্চয় তিনি তাঁকে (জিব্রিলকে) আরেকবার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে, যার কাছে অবস্থিত (নেককার বান্দাদের) আবাসস্থল জান্নাত। যখন বৃক্ষটি (অবর্ণনীয় জ্যোতির) দ্বারা এমনভাবে আচ্ছন্ন ছিল যেমনটি তার শোভা পায়। তাঁর (নবীর) দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং তিনি সীমালংঘনও করেনি। নিশ্চয় তিনি তাঁর পালনকর্তার মহানিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন (৫৩:১২-১৮)।” এই মহানিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে মহান আল্লাহর সাথে কথপোকথন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশনামা, বায়তুল মামুর, বেহেশত ও দোযখ দর্শন, ইত্যাদি। মিরাজের তৃতীয় পর্বে মহানবী (সাঃ) 'রফরফযোগে’ মহান আল্লাহর দরবারে যাওয়ার পথে সত্তর হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম করেন। এ পর্যায়ে তিনি 'লওহে মাহফুয’ (সুরিক্ষত ফলক) যেখানে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টি সংক্রান্ত যাবতীয় আদেশনামা, জ্ঞান, তথ্য, উপাত্ত, এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় কর্মকান্ড ও পরিকল্পনা সুসংরক্ষিত আছে, তা অতিক্রম করার সময় লেখার খসখস শব্দ শুনতে পান। এ নিঃসঙ্গ অবস্থায় তাঁর অন্তরে ভীতির সঞ্চার হলে তিনি হযরত আবু বকরের (রাঃ) কন্ঠ শুনতে পান। এতে তাঁর ভয় কেটে যায়। এ অবস্থা হযরত মূসা (আঃ) বেলায়ও ঘটেছিল যখন স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর সাথে কথা বলছিলেন। আল্লাহ্ তাঁর ভয়-বিহ্বলতা কাটানোর জন্য তাঁর হাতের লাঠির দিকে তাঁর মনযোগ আকর্ষণ করেছিলেন।
প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যখন মহান আল্লাহর দরবারে উপনীত হলেন তখন তিনি সিজদারত হয়ে তাঁর প্রভুর প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করলেন। এ সময়ের আল্লাহর সাথে তাঁর কথোপকথনের কতিপয় বাক্য ʼতাশাহুদে’ উল্লেখ আছে, যা আমরা নামাযের দ্বিতীয় রাকাতের বৈঠকে সব সময় পড়ে থাকি। তিনি বললেন, ʼযাবতীয় প্রশংসা, নামায, ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমল সবই আল্লাহর জন্য পেশ করছি।’ এর উত্তরে আল্লাহ্ বললেন, ʼহে নবী, আপনার ওপর সালাম, রহমত ও বরকত’ বর্ষিত হোক।’ আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর উম্মতকেও মহান আল্লাহর এ আশীষবাাণীর সাথে সংযুক্ত করে বললেন, ʼআমাদের ওপর ও নেককার বান্দাদের ওপরও সালাম।’ হযরত জিব্রিল (আঃ) সে কথোপকথন শুনতে পেয়েছিলেন বলে ওঠলেন, ʼআমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর দাস ও রাসুল।’ এরপর আল্লাহ্ তাঁর নবীকে (সাঃ) বললেন, ʼআপনি আপনার মনোবাসনা পেশ করুন।‘ এর উত্তরে নবীজী (সাঃ) বললেন, ʼআপনি হযরত ইব্রাহীমকে (আঃ) আপনার বন্ধু বানিয়েছেন এবং তাঁকে বিপুল রাজত্ব দান করেছেন। আপনি হযরত মূসার (আঃ) সাথে সরাসরি কথা বলেছেন, এবং হযরত দাউদকে (আঃ) বিরাট রাজত্ব দান করেছেন, লোহাকে গলানোর কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন এবং পর্বতকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছেন। আপনি সুলাইমানকে (আঃ) প্রভূত রাজত্বের মালিক বানিয়েছেন এবং জ্বীন, মানুষ, শয়তান ও বাতাসকে তাঁর বাধ্যগত করে দিয়েছেন। আপনি হযরত ঈসাকে (আঃ) তাওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছেন এবং আপনার অনুমতি সহকারে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করার ও মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা তাঁকে দান করেছেন, আপনি অভিশপ্ত শয়তানের হাত থেকে তাঁকে ও তাঁর মাতাকে সুরক্ষিত করেছেন যাতে শয়তান তাঁদের ক্ষতি করার কোন পথ না পায়।’ নবীজীর (সাঃ) এ বক্তব্য শুনার পর আল্লাহ্ বললেন, ʼআমি আপনাকে আমার মাহবুব (প্রিয়তম) হিসেবে আমার নিকট নিয়ে এসেছি।‘ এখানে উল্লেখ্য যে, তাওরাত গ্রন্থেও আল্লাহ্ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করতে গিয়ে তাঁকে ʼহাবিবুল্লাহ্’ বলে সম্বোধন করেছেন।
এরপর মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় নবীকে (সাঃ) উদ্দেশ্য করে বললেন, ʼআমি আপনাকে সুসংবাদ প্রদানকারী ও সতর্ককারী হিসেবে নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য প্রেরণ করেছি; আমি আপনার বক্ষকে প্রশস্ত করেছি ও আপনার অন্তরের গুরুভার লাঘব করে দিয়েছি এবং আপনার নামকে সমুন্নত করেছি; আপনার নাম ব্যতীত আমার নাম উল্লেখ হয় না; আমি আপনার উম্মতকে মানব কল্যাণের জন্য সর্বোত্তম উম্মত বানিয়েছি; এবং তাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থী বানিয়েছি; আমি আপনার উম্মতকে প্রকৃতপক্ষে সকল উম্মতের সর্বপ্রথম (বেহেশতে প্রবেশকারী) ও সর্বশেষ (পৃথিবীতে আগমণকারী) হিসেবে বানিয়েছি; আমি আপনার উম্মতের জন্য খুৎবাকে অননুমোদিত করে দিয়েছি যদি না তারা প্রথমে সাক্ষ্য দেয় যে, আপনি আমার দাস ও রাসুল; আমি আপনার উম্মতের কতেক মানুষের হৃদয়কে আমার গ্রন্থের ধারক (হাফিজ) বানিয়ে দিয়েছি; এবং আমি আপনাকে সর্বপ্রথম নবুয়ত দান করেছি ও সর্বশেষ নবী হিসেবে প্রেরণ করেছি এবং আমার দরবারে আপনাকে সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে সাক্ষাৎকার দিয়েছি; আমি আপনাকে বারংবার পঠিত সাতটি আয়াত (সুরা ফাতিহা) দান করেছি যা এর পূর্বে অন্য কোন নবীকে দেইনি; আমি আপনাকে প্রদত্ত ʼসুরা আল-বাকারার’ শেষ আয়াত দু’টিকে আমার আরশের নীচে এক মূল্যবান (ক্ষমা ও রহমতের) ভান্ডার হিসেবে স্থাপন করেছি, যা আপনার পূর্বে আর কোন নবীকে দেইনি; এবং আমি আপনাকে কাওছার দান করেছি; এবং আমি আপনাকে আটটি তীর (সৌভাগ্য নির্দ্ধারণী শর: ইসলাম, হিজরত, জিহাদ, সাদাকা, রমযানের রোজা, সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ) দান করেছি; এবং যেদিন আমি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছি তখন থেকে আমি পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আপনার ও আপনার উম্মতের ওপর ফরয করেছি। সুতরাং আপনি ও আপনার উম্মত তা কায়েম করুন।’
মহান আল্লাহর দরবার থেকে ফেরার পথে নবী করিম (সাঃ) জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করেন। এসংক্রান্ত বিবরণী বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত আছে। হযরত জিব্রিলকে (আঃ) সঙ্গে নিয়ে তিনি বেহেশতের অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত দৃশ্যাবলী ও অফুরন্ত নিয়ামত অবলোকন করেন এবং এর কল্পনাতীত আরাম-আয়েশ ও ভোগসম্ভার দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হন। ঠিক তেমনি জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ও কষ্ট-যন্ত্রণা দেখে উম্মতের কঠোর পরিণামের কথা চিন্তা করে তিনি বিচলিতবোধ করেন। এরপর তিনি সপ্তম আসমান পেরিয়ে ষষ্ঠ আসমানে অবতরণ করলে সেখানে হযরত মূসা (আঃ) তাঁকে দেখে তিনি আল্লাহর কি বিধান নিয়ে এসেছেন সে সম্পর্কে জানতে চান। নবীজী (সাঃ) বললেন, ʼআল্লাহ আমাকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের বিধান দিয়েছেন।’ এতে মূসা (আঃ) তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন, আমার উম্মতও সেটা পালন করতে কষ্টবোধ করতো, আপনার উম্মততো আরও দুর্বল, সুতরাং আল্লাহর দরবার থেকে তা কমিয়ে নিয়ে আসুন। তিনি আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলে আল্লাহ্ তা থেকে পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। এতেও হযরত মূসা (আঃ) নবীজীকে আবারও কমিয়ে আনতে বললেন। এভাবে হযরত মূসার বারংবার তাগিদে নবীজী (সাঃ) যখন প্রতিদিনের নামাযকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত থেকে পাঁচ ওয়াক্তে নামিয়ে আনলেন, তখন তিনি লজ্জাবোধের কারণে আরও কম করার অনুরোধ নিয়ে আল্লাহর দরবারে যেতে রাজী হলেন না। আল্লাহ্ তাঁকে বলে দিলেন, এ পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করলেই তিনি পঞ্চাশ ওয়াক্তের সাওয়াব প্রদান করবেন। এ জন্যেই আল্লাহ্ তাঁর মোমেন বান্দার প্রতিটি নেক কাজের দশগুণ বেশী সাওয়াব দান করেন। মিরাজের সাথে নামাযের এ গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণেই একনিষ্ঠ নামাযকে ʼমিরাজুল মোমেনিন’ বলা হয়।
অদৃশ্যলোকে অপার্থিব জগতের ভ্রমণ শেষে মহানবী (সাঃ) হযরত জিব্রিলের (আঃ) সাথে ফিরে এলেন মর্ত্যের ধূলিতে জেরুযালেমের মসজিদে আকসায়। এসে দেখলেন তাঁর বাহন আল-বোরাক স্বস্থানেই বাঁধা আছে। হযরত জিব্রিল (আঃ) তাঁকে মসজিদে আকসায় নামায আদায়ের জন্য আহ্বান জানালেন। আল্লাহর নির্দেশে রুহ জগত থেকে সকল নবী-রাসুলের রুহের আগমণ ঘটল মসজিদে আকসায়। মহানবীকে (সাঃ) বিদায় সম্ভার্ধনা জানাতে এসে তাঁরাও শরীক হলেন নামাযে। সেখানে সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ইমামুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদুর (সাঃ) ইমামতিতে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন সবাই। এরপর বিদায় ভাষণে শরীক হন হযরত ইব্রাহীম (আঃ), মূসা (আঃ), ঈসা (আঃ) প্রমুখ নবীগণ। সবার শেষে ভাষণ দিলেন শেষ নবী খাতেমুন্নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)। তিনি বললেন, ʼআপনারা সবাই আল্লাহর প্রশংসা করেছেন, এখন আমি আমার রবের প্রশংসা করব। সকল প্রশংসা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের যিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন সৃষ্টিকুল ও মানুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ এবং একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে; যিনি আমার ওপর কুরআন নাযিল করেছেন যাতে রয়েছে সবকিছুর সর্বোত্তম ব্যাখ্যা; যিনি আমার উম্মতকে মানব কল্যাণের জন্য সর্বোত্তম উম্মতের মর্যাদা দিয়েছেন; এবং তাদেরকে পরিমিত ও মধ্যমপন্থী করেছেন; আমার উম্মতকে বস্তুত (জান্নাতে প্রবেশের বেলায়) সকল উম্মতের সর্বপ্রথম ও (দুনিয়ায় পাঠানোর বেলায়) সর্বশেষ উম্মত হিসেবে বানিয়েছেন; যিনি আমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিয়েছেন ও অন্তরের বোঝাকে লাঘব করেছেন এবং আমার নামের স্মরণকে সমুন্নত ও আশীষপূর্ণ করেছেন; যিনি আমাকে নবুওতের সূচনাকারী ও সীলমোহর (সমাপনকারী) বানিয়েছেন।’ এ ভাষণ শুনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, 'আর এ জন্যেই মুহাম্মদ (সাঃ) শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন।’ জেরুযালেমের মসজিদে আকসায় নামায ও খুৎবা শেষে নবী করিম (সাঃ) পুনরায় বোরাকযোগে মক্কায় মসজিদুল হারামে ফিরে এলেন। এর সাথেই সমাপ্ত হলো তাঁর আল-ইসরা ওয়াল মিরাজ ভ্রমণ।
মহানবীর (সাঃ) এ ভ্রমণ কি আধ্যত্মিক অর্থাৎ স্বপ্নযোগে হয়েছিল না শারীরিকভাবে হয়েছিল তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তবে যুক্তির দিক দিয়ে তা আধ্যাত্মিক ও শারীরিক এ উভয় অবস্থার সমন্বয়েই ঘটেছিল। এ ভ্রমণটি যদি স্বপ্নযোগেই হতো তবে তা নিয়ে মক্কাবাসীদের মধ্যে এত অবিশ্বাস ও বিতর্ক হত না। কারণ স্বপ্নে বা কল্পনায় অবিশ্বাস্য অনেক কিছুই দেখা ও শুনা সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে মানবিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা সম্ভব নয়। যেহেতু এ ভ্রমণটি আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হয়েছিল, তাই তাতে আধ্যাত্মিকতার সাথে ও শারীরিক সত্তার সমন্বয় ঘটেছিল। আর আল্লাহ্ যা করতে ইচ্ছে করেন, তা বলা মাত্রই হয়ে যায়। এ অবিশ্বাস প্রসঙ্গে সুরা বনী ইসরায়েলের ষাট নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, "এবং স্মরণ করুন, আমি আপনাকে বলে দিয়েছিলাম যে, আপনার পালনকর্তা মানুষকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং যে দৃশ্য আমি আপনাকে দেখিয়েছি (ইসরা ও মিরাজের ঘটনাবলী) তা এবং কোরআনে উল্লেখিত অভিশপ্ত বৃক্ষ (যক্কুম) কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্যে। আমি তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করি। কিন্তু এতে তাদের অবাধ্যতাই আরও বৃদ্ধি পায়।" এ বিষয়টি অবিশ্বাসের কারণে শুধু কাফেরদের অবাধ্যতাই বৃদ্ধি পায়নি, কিছু নব্য মুসলিমও মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল এবং নবী মুহাম্মদকে (সাঃ) তারা কাফেরদের মত পাগল ঠাওরেছিল।
আজকের বৈজ্ঞানিক সভ্যতার যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবিত উন্নয়নের কারণে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। এত বড় দূরত্বের একটি ভ্রমণ এত স্বল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে সম্ভব হয়েছিল তা বোঝার মত জ্ঞান তখনকার মানুষ অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু যারা মোমেন ছিলেন তাদের জন্য ব্যাপারটি ছিল অন্যরকম। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের কথা শুনামাত্রই তা প্রশ্ন ব্যতিরেকে মেনে নেওয়াই ছিল তাদের বৈশিষ্ঠ্য। যেমন, বিনা দ্বিধায় মিরাজের ঘটনাটি বিশ্বাস করায় হযরত আবু বকর (রাঃ) 'সিদ্দিক’ (সত্যবাদী) উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। এ মহাকাশ অভিযানের যুগে মর্ত্যের মানুষের গ্রহ-গ্রহান্তর ভ্রমণ এখন এক স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। মধ্যাকর্ষণ শক্তি পেরিয়ে মহাকর্ষীয় শক্তির টানে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের তৈরী দ্রুত-গতির মহাকাশযানগুলো গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে চলেছে। পৃথিবীতে অবস্থিত নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসেই মহাকাশ পরিভ্রমণরত মানব-নির্মিত উপগ্রহসমূহের কার্যাবলী নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, এমনকি এগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটিগুলোও রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে সারাতে পারছে। শুধু তাই নয় এসব উপগ্রহ থেকে পাঠানো তথ্য, উপাত্ত ও ছবি, ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে মহাকাশের নানা অজানা বিষয় আমরা জানতে পারছি। বিদ্যুতের গতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিমি, এই গতিতে চললে সময় স্তব্ধ হয়ে যায়। গতির কারণে সময়ও আপেক্ষিক হয়ে যায়, অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্রভেদে সময়ের পরিমাপ ভিন্ন হয়ে থাকে। জাগতিক ও মহাজাগতিক সময় আপেক্ষিক হওয়ায় পৃথিবীতে যা সুদীর্ঘ মনে হয়, গ্রহান্তরে তা ক্ষণিকের বিষয়। তাই শেষ নবী (সাঃ) মিরাজের মাধ্যমে যে মহাকাশ ভ্রমণের সূচনা করেছিলেন, তাঁরই উম্মত আজ সে মহাকাশ ভ্রমণকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেছে। মহান আল্লাহর সৃষ্ট জীব মানুষের দ্বারাই যদি এত কিছু সম্ভব হয়, তাহলে সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা আল্লাহ্ তায়ালার দ্বারা তো সবছিুই সম্ভব। এ বিশ্বাসই মিরাজ বিষয়ক সকল বিতর্কের অবসান ঘটাবে।
বিষয়: বিবিধ
১২১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন