মোনাফেকদের চরিত্র
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৫ এপ্রিল, ২০১৬, ০৩:১৭:২৭ রাত
বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠী সকল যুগেই কাফের ও মোনাফেকদের দুশমনী ও নির্মমতার শিকার হয়েছে। কাফেররা সরাসরি মুসলমানদেরকে আক্রমণ করেছে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, আর মোনাফেকরারা তলে তলে কাফেরদেরকে মদদ যুগিয়েছে। তবে ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষে কাফেরদের চেয়েও মোনাফেকরা অগ্রণী ছিল এবং এখনও তাই আছে। কাফেরদেরকে সহজে চেনা যায়, কিন্তু মোনাফেকদেরকে চেনা বড়ই মুশকিল। তারা মুসলিম সমাজে বাস করে, নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু আসলে তারা মুসলমান নয়। কারণ অন্তরে তাদের ঈমান নেই, বরং কপটতায় ভরা তাদের মন-মানসিকতা। তারা ভোল-পাল্টানো ছদ্মবেশী এক বিপদজনক শত্রু। ইসলামের আবির্ভাবকালে এদেরকে নিয়ে নবী করিম (সাঃ) খুবই সংকটে ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তারা নবী (সাঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে বিপদগ্রস্ত করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেছে। আল্লাহ্ সে সংকটকালীন সময়ে তাঁর নবীকে (সাঃ) ওহীর মাধ্যমে মোনাফেকদের কপট ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জানিয়ে সতর্ক করেছেন। মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নির্মিত মসজিদে জেরার ষড়যন্ত্রটি ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। মোনাফেকরা দুরভিসন্ধিমূলকভাবে এ মসজিদটি নির্মাাণ করেছিল যাতে একে তাদের ষড়যন্ত্রের আখড়া বানানো যায়। আল্লাহর নির্দেশে নবী করিম (সাঃ) এটিকে পুড়িয়ে ফেলেন। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে মোনাফেকদেরকে চেনার লক্ষণসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। এরই আলোকে এখানেও তাদের কপট চরিত্র বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। তাই মোনাফেকি চরিত্র সম্পর্কে জেনে রাখা প্রত্যেক মুসলমানেরই অবশ্য কর্তব্য।
মোনাফেকদের প্রকৃত পরিচয় হলো তারা মুখোশধারী মুসলমান। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য হলো তারা মিথ্যবাদী, সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে চেনার মত কিছু লক্ষণ বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে (সাঃ) উদ্দেশ্য করে বলেন, "আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো - যা তিনি রাসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুণ তাদের ওপর বিপদ এসে পড়ে তখন তাদের অবস্থা কি হয়? তখন তারা আপনার কাছে ফিরে এসে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলে যে, "(তোমাদের ব্যাপারে) কল্যাণ ও সম্প্রীতি ছাড়া আমরা অন্য কিছু কামনা করিনি।’ এরা হলো সেসব লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কেও আল্লাহ তা’আলা অবগত। অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন যা তাদের জন্য কল্যাণকর (৪:৬১-৬৩)।” মোনাফেকদের আরেকটি বৈশিষ্ঠ্য হলো তারা বড় অকৃতজ্ঞ ও অত্যন্ত লোভী প্রকৃতির। লোভের কারণে তাদের অন্তর কোন অবস্থাতেই পরিতৃপ্ত নয়। সম্পদের ধান্দা ও সুখ-সম্ভোগের পেছনেই তাদের জীবন কাটে। সুখের সময় তারা যেমন আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে না, তেমনি বিপদে পড়লে তারা সবর বা ধৈর্য ধারণ করতে পারে না। তখন পেরেশানীতে পড়ে তাদের বেহাল অবস্থা দাঁড়ায়।
মোনাফেকদের মন সব সময়ই সন্দেহপ্রবণ। আল্লাহ্ ও পরকালের ওপর তাদের বিশ্বাসের ভিত বড়ই দুর্বল। এদের প্রকৃত অবস্থার বর্ণনা হলো, "এরা (কুফরী ও ঈমানের) এ দোটানায় দোদুল্যমান, না এদিকে না ওদিকে (৪:১৪৩)।” তারা বাহ্যিকভাবে ঈমানের দাবী করলেও বিভিন্ন অজুহাতে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিরত থাকে, বিপদে-মুসিবতে মুসলমানদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকে অথবা নিষ্ক্রিয় থাকে। এরা আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কুণ্ঠিত থাকে এবং যাকাত বা সদকা প্রদানকে জরিমানাতুল্য মনে করে। তারা তাদের সুবিধামত আল্লাহর প্রদত্ত জীবন বিধানের কিছু অংশ মানে, আর কিছু অংশ মানে না। তাদের কর্ম ও আচরণ প্রমাণ করে তারা ইসলামের আদর্শে পুরোপুরি বিশ্বাসী নয়। তাই চিন্তা ও আদর্শের দিক দিয়ে মোনাফেকরা অপবিত্র। আর এ কারণেই আল্লাহর নিকট তাদের কোন আমলই গৃহীত হয় না। আল্লাহ্ এদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "তোমরা কি (তাহলে) আল্লাহর কিতাবের একাংশ বিশ্বাস করো এবং আরেক অংশ অবিশ্বাস করো? (সাবধান!) কখনও যদি কোন (জাতি কিংবা) ব্যক্তি (দ্বীনের অংশবিশেষের ওপর ঈমান আনয়নের ব্যাপারে) এ ধরনের আচরণ করে, তাদের শাস্তি এছাড়া আর কি হবে যে, পার্থিব জীবনে তাদের লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে, পরকালেও তাদেরকে কঠিন আজাবের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে; তোমরা যা করছো, আল্লাহ্ সেসব বিষয় থেকে মোটেও উদাসীন নন (২:৮৫)।” আর এভাবেই মোনাফেকরা তাদের দ্বিমুখী নীতির কারণে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে।
মোনাফেকদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা দ্বিচারী অর্থাৎ পরস্পর বিরোধী দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী। মোনাফেকদের ঈমান হলো কপটতাপূর্ণ, লোক-দেখানো ও ঠুনকো। এদের ঈমানের ধরন সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, "আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তারা শয়তানরূপী সহচরদের সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা তো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্র। বরং আল্লাহই তাদের সাথে উপহাস করেন। আর তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের অহংকার ও কুমতলবে হয়রান ও পেরেশান থাকে (২:১৪-১৫)।" মোনাফেক সম্প্রদায় মৌখিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করলেও তা ভন্ডামীতে পরিপূর্ণ থাকে। মু’মিনদের মত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাদের ঈমান আন্তরিক নয়, বরং তা জনসমক্ষে নিজেকে ঈমানদার বলে জাহির করার জন্য, অথবা কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায়, কিংবা আভ্যন্তরীন শত্রু হিসেবে মুসলিম সমাজের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। এদের এ কপট চরিত্র সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে একটি বিশেষ সুরা 'মোনাফেকুন’ নাযিল করে তার প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেন, "মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলে: আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথসমূহকে ঢালরূপে ব্যবহার করে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথে বাধার সৃষ্টি করে। তারা যা করছে, তা খুবই মন্দ।”
পবিত্র হাদীসেও এদের সম্পর্কে নবী করিম (সাঃ) বলেন, "একজন মোনাফেক যখন কথা বলে, সে মিথ্যা বলে; সে যখন শপথ করে, সে তা ভঙ্গ করে। সামান্যতম বিপদেও তারা মু’মিনদেরকে পরিত্যাগ করে শত্রুদের সাথে হাত মেলায়। বিপদ-আপদের সময় তাদের আসল রূপ বের হয়ে পড়ে।” মক্কার কোরেশ বাহিনী মুসলমানদেরকে আক্রমণ করার জন্য যখন মদীনার অদূরবর্তী ওহুদ উপত্যকায় সেনা সমাবেশ করে তখন মদীনার মোনাফেকরা তাদের ঘরদুয়ার ও পরিবার অরক্ষিত এ অজুহাতে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। ওহুদ যুদ্ধে সামান্য ভুলের জন্য যখন মুসলমানদের ওপর ভীষণ বিপদ নেমে এসেছিল তখন মোনাফেকরা মনে মনে উৎফুল্ল হয় এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলকে দোষারোপ করে। তাদের এ দোষারোপমূলক উক্তিটি পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ এভাবে তোলে ধরেছেন, "এবং যখন মোনাফেক ও যাদের অন্তরে (সন্দেহের) ব্যধি ছিল তারা বলেছিল, আমাদেরকে প্রদত্ত আল্লাহ্ ও রাসুলের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা বৈ নয় (৩৩-১২)।” আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে মুসলিম বাহিনী অসাধারণ আত্মত্যাগের মাধ্যমে এ মহাদুর্যোগ কাটিয়ে ওঠে এবং কোরেশ বাহিনী ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে যায়। এসব মু’মিন বান্দারা তাদের জান-মাল কুরবানী দিতে সর্বক্ষণ নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখতেন। তারা জাগতিক লাভালাভের চেয়ে পরকালীন পুরস্কারকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিতেন। আল্লাহর রাস্তায় জীবন দানকে তারা শহীদ হওয়ার গৌরব মনে করতেন। অপরদিকে আল্লাহর পথে বিজয়কে তারা বিরাট সাফল্য ও নেয়া’মত হিসেবে গ্রহণ করতেন। সুখে-দুঃখে সবসময় আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট থাকাই ছিল তাদের নীতি। আর মোনাফেকদের নীতি ছিল তার উল্টো। তারা অত্যন্ত লোভী ও প্রতারক। এদের কাছে সততা ও ন্যায়নীতির কোন মূল্য নেই।
মুসলিম নামধারী এসব মোনাফেকের নেতা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। সে ও তার দলবল সবসময় মদীনার ইহুদী সম্প্রদায় ও মক্কার কোরেশদের সাথে যোগাযোগ রাখত এবং সুযোগ বুঝে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতায় মেতে ওঠত। কখনও ধরা পড়ে গেলে তারা মিথ্যা কসম খেয়ে নিজেদের অপরাধ অস্বীকার করত। তারা সবসময়ই সুযোগ সন্ধানী অর্থাৎ 'যখন যেমন, তখন তেমন’ গোছের। তাদের এ দ্বিমুখী চরিত্রের বর্ণনায় আল্লাহ্ বলেন, "এরা এমনি মুনাফেক যারা তোমাদের শুভাশুভের প্রতীক্ষায় ওতপেতে থাকে। অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় তোমাদের যদি কোন বিজয় অর্জিত হয়, তবে তারা বলে, আমরাও কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? পক্ষান্তরে কাফেরদের যদি আংশিক বিজয় হয়, তবে বলে, আমরা কি তোমাদেরকে ঘিরে রাখিনি এবং মুসলমানদের কবল থেকে রক্ষা করিনি? (৪:১৪১)।" এ প্রতারণামূলক দ্বিমুখী নীতির দ্বারা তারা মুসলমান ও কাফের উভয় সম্প্রদায়কে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিত। এরা দৃশ্যত মুসলমানদের সাথে মসজিদে গিয়ে নামাযে দাঁড়াত, কিন্তু এটা ছিল তাদের প্রতারণামূলক কাজ। মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই তারা তা করত। এদের এ ধরনের আচরণ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, "অবশ্যই মুনাফেকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে, অথচ (এর দ্বারা) তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুত তারা যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন দাঁড়ায় লোক দেখানোর জন্য একান্ত শিথিলভাবে। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে (৪:১৪২)।” তাদের মধ্যে সততা, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্তার খুবই অভাব। এমন ধারার মোনাফেকরা আমাদের সমাজে অহরহ বিদ্যমান।
বিশ্বাসঘাতকতা মোনাফেকীর আর একটি বড় লক্ষণ। এরা আমানতের খেয়ানত করে থাকে এবং শপথ করে শপথ ভঙ্গ করে। আমাদের সমাজে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক ’মীরজাফর’ চরিত্রের অভাব নেই। এরা স্বার্থান্ধ ও কুচক্রী। ভালো মানুষ সেজে এবং মধুর কথার দ্বারা এরা মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দেয় ও মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করে। তারপর স্বার্থ উদ্ধার শেষে তারা এক সময় সুযোগ বুঝে সটকে পড়ে। আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় এ ধরনের চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। এরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয় আর জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়। সামান্য লোভ ও স্বার্থের বিনিময়ে তারা শপথ ভঙ্গ করে দেশ ও জাতির স্বার্থ বিকিয়ে দেয়। এদের কথায় আর কাজে মিল পাওয়া ভার। তারা মিথ্যার বেসাতি করে বেড়ায়। দু’দলের কাছে দু’রকম কথা বলে ঝগড়া-ফ্যাসাদের সৃষ্টি করে। আর তাদের ওই দু’রকম কথা মিথ্যা বৈ কিছু নয়। এদের এ ধরনের কর্মকান্ড সমাজ ও রাষ্ট্রে বিপর্যয় ও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই মোনাফেকদের কেউ কেউ রাসুলুল্লাহর (সাঃ) সামনে এসে আল্লাহকে সাক্ষ্য রেখে পার্থিব জীবনের সুন্দর সুন্দর কথা বলতো যাতে তিনি মুগ্ধ হন, আবার ফিরে গিয়ে এর উল্টোটাই করত। আল্লাহ্ তখন তাঁর নবীকে (সাঃ) সাবধান করে বলেন, "আসলে এরা প্রচন্ড ঝগড়াটে প্রকৃতির লোক (২:২০৪)।” এর পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, "যখন (তারা) ফিরে যায় তখন চেষ্টা করে যাতে দেশের বুকে বিপর্যয় ঘটে, শস্যক্ষেত্রের বিনাশ হয় ও জীবজন্তু নির্মূল হয়ে যায়। আল্লাহ্ ফ্যাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না।” এ থেকেই বোঝা যায় মোনাফেকদের ছল-চাতুরি ও ছুতোনাতার কোন অভাব নেই। তারা নিজেদের স্বার্থ হাছিলের ব্যাপারে এতটাই উদগ্রীব থাকে যে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যেতে কোন পরোয়া করেনা। তারা নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এক বিভ্রান্ত ও কপট সম্প্রদায়।
আজ মুসলিম বিশ্বে যে অশান্তি, অনৈক্য ও হানাহানি চলছে তার মূলে রয়েছে মোনাফেকদেরই চক্রান্ত। বহিঃশত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে এরা দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতার সৃষ্টি করে এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মত নিজেদের স্বার্থ হাছিল করে নেয়। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বেশ কয়েকটি দেশের সরকার ইসলাম-দরদী সেজে ইসলামের চিরশত্রু ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে হাত মিলিয়েছে। তারা ফিলিস্তিনের মুসলিম নিধনে ইসরায়েলকেই শুধু সহায়তা দিচ্ছে না, নিজেরাও সরাসরি তাদেরকে হত্যা করছে। এসব মোনাফিকরা বিদেশী মদদপুষ্ট হয়ে আরব দেশগুলোর সাম্প্রতিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আন্দোলনগুলোকে বিপথগামী করে ফেলে এবং এগুলোকে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতার পথে নিয়ে যায়। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, ইয়েমেনের চলমান গৃহযুদ্ধে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো পশ্চিমা শক্তির মদদে শুধু ইন্ধনই যোগাচ্ছে না, সরাসরি হস্তক্ষেপও করছে। কাফের ও মোনাফেক শক্তির কবলে পড়ে মুসলিম বিশ্ব আজ বহুধা বিভক্ত এবং তাদের নিপীড়ন ও নির্যাতনের নিশানায় পরিণত হয়েছে। শত শত মুসলিম জনপদ তাদের বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের হামলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ইতোমধ্যে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু ও শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। কাফের-মোনাফেকদের সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেস্টাইন রূপী আইএস ও আলকায়দা দমনের নামে চলছে এক অন্তহীন যুদ্ধ। আর এর সাথে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে এসব কপট অপশক্তির বিঘোষিত মানবতা। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার নামে তারা যে উগ্রচন্ডি রণনৃত্য শুরু করেছে তাতে মানব সভ্যতা আজ হুমকির সম্মুখীন। তাদের এসব মোনাফেকি কর্মকান্ড সম্পর্কে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ বলেন, "আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে তোমরা অশান্তি সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরাতো সংস্কারের পথ অবলম্বন করেছি, নিঃসন্দেহে এরাই হচ্ছে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা উপলব্ধী করে না (২:১১-১২)।"
সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ ঘোষিত কঠিন আজাব থেকে মোনাফেকদের পরিত্রাণ নেই, কেননা তারা সত্য ও সঠিক পথের বদলে মিথ্যাকে গ্রহণ করেছে এবং গোমরাহীতে নিমজ্জিত আছে। তাদের এ সব নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত কাজের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, "নিঃসন্দেহে মুনাফেকরা রয়েছে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী কখনও পাবে না (৪:১৪৫)।” আল্লাহ্ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না, যদি না তারা অনুতপ্ত হৃদয় নিয়ে তওবা করে এবং তাঁর নিকট পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে। হেদায়েতের পথে তারা আসতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা হেদায়েতের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাবে। মহান আল্লাহ্ অতীব দয়ালু ও ক্ষমাশীল। নিশ্চয়ই তারা আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা লাভ করবে যদি তারা খালিস নিয়তে আল্লাহর দ্বীনের ওপর দৃঢ়ভাবে কায়েম হয়ে যায়। তারা যদি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করে ও সৎকর্ম করে এবং নিজেদের ভুল-ভ্রান্তির জন্য সবসময় ক্ষমা প্রার্থনা করে তবেই তারা দোজখের কঠিন আজাব থেকে নাযাতের আশা করতে পারে। পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, আমরা সবাই আমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকিয়ে পরীক্ষা করে নেই তাতে কোন মোনাফেকির লক্ষণ আছে কি না। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে হেদায়েতের পথে চলার তওফিক দান করুন, মোনাফেকি থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৯৫৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন