বাংলা ভাষার বিপন্নতা
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৮:১৪:১৪ সকাল
মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম শুরু হয় পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে। বায়ান্ন’র একুশে ফেব্রুয়ারীতে তা এক রক্তাক্ত সংগ্রামে পরিণত হয়। মাতৃভাষার প্রতি অপরিসীম দরদই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে এ দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল। ফলে ভাষাভিত্তিক চেতনায় যে জাতি সত্তার উন্মেষ ঘটেছিল, তা পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে। পৃথিবীর প্রথম সারির ৮টি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থান অষ্টম স্থানে। বালাদেশ ও ভারতসহ সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের মাতৃভাষা দিবস ‘একুশে ফেব্রুয়ারীর’ সম্মানে জাতিসংঘ এ দিবসটিকে ʼবিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য নির্ধারিত করেছে। মাতৃভাষার জন্য আমাদের গৌরবোজ্জল আত্মদান আজ বিশ্ব সভায় শুধু স্বীকৃতিই পায়নি, বিশ্বের সকল মাতৃভাষাকেও মহিমান্বিত করেছে। একটি স্বাধীন দেশ ও জাতির উত্থানে যে ভাষার এত অবদান, সেই ভাষাই এখন নিজ দেশে বিকৃতির কবলে পড়ে বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অযত্ন ও অবহেলায় আজ আমাদের মাতৃভাষা ম্রিয়মান। ভুল বানান ও বিকৃত উচ্চারণ আজ বাংলা ভাষাকে লজ্জিত করছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, রেডিও-টিভি, সংবাদপত্র সর্বত্রই বাংলার বিশুদ্ধ ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ব্যবহারিক দিক দিয়ে বাংলার বিশুদ্ধ উচ্চারণ যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। নাটক-সিনেমা, গণমাধ্যম ও সাহিত্য চর্চায় বাংলা ভাষার অপব্যবহার, বানানের বিকৃতি খুবই পীড়াদায়ক। অথচ কোথাও এর বিরুদ্ধে কোন জোড়ালো শুদ্ধি আন্দোলন গড়ে ওঠছে না। আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবি ও শিক্ষিত মহল তোষামোদি ভাষায় যত প্রাঞ্জল, মাতৃভাষার সঠিক চর্চায় ততটাই দুর্বল। এমন কি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতেও উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার ব্যবহার আশাব্যঞ্জক নয়। বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতি এবং আঞ্চলিকতার আগ্রাসনে পড়ে বাংলা ভাষা এখন তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারানোর পথে।
মাতৃভাষার উন্নয়ন ও এর সঠিক চর্চায় আমরা বেশ অমনযোগী। বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজনে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারকে বাংলায় অনুবাদ করার প্রচেষ্টা তেমন সাবলীল হয়ে ওঠছে না। ফলে বিদেশী ভাষার ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বেড়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজী ভাষার গুরুত্ব রয়েছে। তাই বলে, প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ইংরেজীকে গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে কিন্ডার গার্ডেন স্কুল ব্যঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠছে তা আমাদের শিশুদেরকে সঠিকভাবে মাতৃভাষা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। এ ছাড়া আমাদের শিক্ষার মান এতই নিম্ন যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা বাংলা বা ইংরেজী কোনটাই সঠিকভাবে শিখতে পারছে না। ফলে বাংলা-ইংরেজী মিলে আমাদের শিশুরা যে খিচুড়ি ভাষা শিখছে তার নাম হতে পারে 'বাংলিশ’। এ ধরনের প্রবণতা আমাদের মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করার পরিবর্তে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মাতৃভাষা বলে এ ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব আমাদের কাছে তেমনটি নেই বললেই চলে। ঠেকায় পড়ে যতটুকু শেখা যায়, ততটুকু দিয়েই দায়সারা কাজ চালানো হচ্ছে। আমরা এক একজন একুশের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক হয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি, অথচ এসব চেতনার কোন বৈশিষ্ঠ্য আমাদের কাজকর্মে ও আচার-আচরণে দেখা যায় না। বাংলা ভাষাকে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর অবস্থানে রেখে বিদেশী ভাষাকে মর্যাদার আসনে বসাই। আজকাল আমাদের রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ও সংসদীয় বিতর্কে যে খিস্তি-খেউড় ব্যবহৃত হয় তা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য খুবই অবমাননাকর। টিভি চ্যানেলের এ যুগে আমাদের নেতৃবৃন্দ ও গুরুজন যে ভাষায় বক্তৃতা-বিবৃতি দেন শিশুসহ সর্বসাধারণ তা দেখতে ও শুনতে পায়। তাঁদের অমৃত বচন থেকে তারা কতটুকু শিখতে পারে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
একগাদা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ভাষার বিকৃতি ক্রমশই বাড়ছে। এসব চ্যনেল যেন বাংলা ভাষাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। টিভি’র সংবাদ, নাটক ও বিজ্ঞাপনে এমন সব বিকৃত ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে তা আঞ্চলিক বাংলা, হিন্দী ও ইংরেজীর এক কিম্ভূতকিমাাকার মিশ্রণ। টিভি’র বিজাতীয় কার্টুন ও বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট শিশুরা মাতৃভাষাকে এগুলোর সাথে গুলিয়ে ফেলছে। আঞ্চলিকতার দোষে আমাদের বাংলা কথ্যভাষা নির্মূল হওয়ার উপক্রম। যে যেমন পারে তেমনিভাবে মুক্ত ভঙ্গিমায় কথা বলছে। এর ফলে নব্য এক জগাখিচুড়ি কথ্যভাষার আবির্ভাব ঘটেছে, যার মধ্যে ভাষার মাধুর্যতা খুঁজে পাওয়া ভার। তা ছাড়া টিভি চ্যানেলে প্রচারিত বর্তমান বাংলা নাটক-সিনেমার সাহিত্যিক মান অনেক নীচে নেমে গেছে। এসব থেকে এখন সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধও উধাও। বিনোদনের নামে এগুলোকে শুধু ভাঁড়ামি বলেই মনে হয়। নবীন লেখকদেরকে নিয়ে উন্নত মানের সাহিত্য চর্চার প্রতিষ্ঠানের বড়ই অভাব। ফলে কবিতা-গান, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস-নাটক সর্বত্র মানহীন চর্চা ও দৈন্যতায় ভরপুর। উন্নত ও সৃজনশীল চিন্তাশক্তির অভাবে এখন আর তেমন কোন মহৎ সাহিত্যকর্মের দেখা মিলছে না। অথচ ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রতিভাবান বাঙালী কবি-সাহিত্যিকদের লেখনী বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি, নোবেল প্রাইজ অর্জনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছে। আমাদের গৌরবোজ্জল অতীত আমাদেরকে যে সুনিপুণভাবে এক সমৃদ্ধ ভাষা গড়ে দিয়েছিল, অবজ্ঞা ও অবহেলায় সে ভাষা তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও মাধুর্য হারিয়ে এক অমার্জিত রূপ ধারণ করতে বসেছে।
এ বিশ্বায়নের যুগে প্রচুর বাংলাভাষী মানুষ জীবিকার অন্বেষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেসব দেশে বড় বড় বাঙালী সমাজ গড়ে ওঠলেও বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের অভাবে সেখানকার বাঙালী শিশুরা মাতৃভাষা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক সময় আসবে যখন বাংলা ভাষা তাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাবে। এমন অবস্থা এখনই শুরু হয়ে গেছে। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে সিলেট জেলার বাংলাদেশী সমাজের শিশুরা আঞ্চলিক সিলেটী ভাষা ও ইংরেজী ছাড়া শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে না। তাদের জন্য আঞ্চলিক ভাষায় টিভি চ্যানেল চালু হলেও বাংলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠছে না। এটা আমাদের প্রবাসী সমাজের জন্য শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার এক বড় হুমকি স্বরূপ। খুবই দুঃখজনক হলো, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রবাসীদের সমর্থন ও অনুদানের ওপর যতটা নির্ভরশীল, প্রবাসীদের কল্যাণে তাদের অবদান ততটাই স্বল্প। মাতৃভাষা দিবসে প্রভাত ফেরী ও শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলীর মধ্যেই বাংলা ভাষার প্রতি আমার দায়িত্ব সীমিত হয়ে পড়েছে। এ ধরনের লৌকিক শ্রদ্ধা বংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় তেমন কোন অবদান রাখতে সমর্থ নয়। একুশের বই মেলারও মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। বিশুদ্ধতা রক্ষা করে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও প্রচলন এখন খুবই জরুরী। যে জাতি মাতৃভাষার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছে, তারই তো বোঝা উচিৎ মাতৃভাষার উন্নয়ন ব্যতীত জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রথমে বিদেশী ভাষার প্রতি অনুরক্ত ও পরে অনুশোচনায় দগ্ধ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার কয়েকটি পঙক্তির উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করছি আজকের এ নিবদ্ধ:
``ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!''
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥
বিষয়: বিবিধ
১৯৬২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন