ভালোবাসা ‌দিবসের ভাবনা

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৭:৪৯:২৮ সকাল

জগত ব্যাপী একটি সুমধুর বচন ভালোবাসা। এর উৎস স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্। তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ তাঁরই সৃষ্ট জগতে প্রতিভাত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রেমময় মহান আল্লাহর এক অসাধারণ স্বর্গীয় নেয়ামত হলো সৃষ্টির প্রতি তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা। তিনি তাঁর সৃষ্ট প্রাণীকুলের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধনের সৃষ্টি করেছেন তা-ই প্রেম ও ভালোবাসার রূপ পেয়েছে। এই প্রেম-ভালোবাসা আল্লাহ্ প্রদত্ত এমন এক পবিত্র আবেগানুভূতি যা হৃদয়ের গহীন থেকে মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়। ভালোবাসার আকর্ষণে বা বিকর্ষণে কখনও তা প্রকাশিত হয় মিলন মাধুর্যে, কখনওবা বিরহ-বেদনায়। পবিত্র হাদীসে বর্ণিত আছে, পরিপূর্ণ ভালোবাসার মাত্র এক শতাংশ তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিতরণ করেছেন, বাকী নিরানব্বই শতাংশই তাঁর নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছেন। আর এই এক শতাংশ ভালোবাসার দ্বারাই সমগ্র সৃষ্টি আপ্লুত হয়ে আছে। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনের অপত্য ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার গন্ডী পেরিয়ে সমাজ-সংসার, পরিবেশ-প্রকৃতি সর্বত্রই ছড়িয়ে তা আছে। প্রেম-ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার পরশে মানব জীবনে স্বর্গীয় শান্তি নেমে আসে। ভালোবাসার বন্ধন একান্ত আপন জনকে ছাড়িয়ে সার্বজনীন রূপ ধারণ করে। মানব প্রেম, স্বজাতি ও স্বদেশ প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, স্রষ্টার প্রতি প্রেম নিয়ে কবি-সাহিত্যিক কত যে প্রেমোপাখ্যান লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রেম-ভালোবাসায় কত লক্ষ-কোটি প্রাণ উৎসর্গকৃত হয়েছে - তা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়, কবির কাব্য-গাঁথায় আছে এসব কাহিনীর ভূরি ভূরি নজীর। সৃষ্টির এ মিলন মেলায় আল্লাহ্ সবাইকে তাঁর আপন বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছেন। আপন সত্তা যখন পরম সত্তার কাছে সমর্পিত হয় তখন এ ভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করে।

ভালোবাসাকে অনুভব করতে হয় অন্তর দিয়ে, কোন বাহ্যিক চাকচিক্য বা উন্মত্ত আচরণ দিয়ে নয়। যারা যৌনতাকে ভালোবাসা বানাতে চায় তারা প্রেম-ভালোবাসার মর্ম বোঝে না। অধুনা প্রচলিত পশ্চিমা ধাঁচের ভ্যালেন্টাইন্স-ডে তরুণ সমাজকে ভালোবাসার পবিত্রতা থেকে অবাধ মেলামেশা ও যৌনতার পথে নিয়ে যাচ্ছে। অন্তরের মধ্যে অশ্লীলতা পোষণ করে বাহ্যিক সৌন্দর্য দ্বারা ভালোবাসার স্বরূপ সন্ধান করা যায় না। রিপুর কামনা বাসনাকে সম্বল করে ভালোবাসা অর্জন এক ব্যর্থ প্রয়াস বলেই মনে হয়। পশ্চিমা সভ্যতা অশ্লীলতা ও যৌনতার পূজারী। তাই তারা এসব নোংরামীর মধ্যেই জীবনের সুখ খুঁজে ফেরে। তাদের পরিবার থেকেও নেই, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে নেই কোন ঘনিষ্ট সম্পর্ক। তাদের পারিবারিক অনাবিল শান্তির পরিবেশ অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। পশ্চিমা নারী-পুরুষের অবাধ জীবন পরিবারকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিচ্ছে। এসব পরিবারের শিশুরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। পরিবারহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ওল্ড-হোমে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে এবং মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আবার এদের কারো কারো জীবনাবসান হচ্ছে নিজ গৃহের ভয়াবহ নির্জনতায় এবং একাকীত্বের বেদনায়। তাই এরাই কৃত্রিম ভালোবাসার স্বাদ মেটাতে বছরে এক দিন ভ্যালেন্টাইন্স-ডে উদ্যাপনে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। তারা এটা বোঝতে অক্ষম যে, একটি বিশেষ দিনের মধ্যে ভালোবাসাকে আটকে রাখা যায় না, বরং তা মানুষের অন্তরের এক সার্বক্ষণিক অনুভূতি।

পশ্চিমা মুক্ত বাজার অর্থনীতি মানবিক সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে নিয়ে বাণিজ্য করছে। মা-দিবস, বাবা-দিবস, ভালোবাসা-দিবস ইত্যাদির নামে চলছে বাণিজ্য। এসব দিবসে বাণিজ্যিক উপকরণগুলোই মুখ্য হয়ে ওঠেছে, বাহ্যিক চাকচিক্য ও ক্ষণিক আনন্দের আড়ালে ভালোবাসার মূল আবেদনটাই হারিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টিপাতের লেখক যাযাবর যথার্থই বলেছেন, বিজ্ঞান আমাদেরকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এ রোবটিক যুগে মানুষের হৃদয়ও ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে ওঠেছে। আমরা সবাই এখন ভার্চুয়েল জগতের বাসিন্দা, বাস্তব জগতের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা প্রকাশের মাধ্যমগুলোও যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। এখন আর হৃদয়ের ছোঁয়া হৃদয়ে লাগে না। মনের আকুতি মেশানো কথাগুলোর স্থান দখল করেছে মুঠোফোনের টেম্পলেট করা ক্ষুদ্র মেসেজগুলো। আমি তোমায় ভালোবাসি - এ কথাটিতে নেই মনের মাধুরী মেশানো সত্যিকার ভালোবাসার পরশ, তাতে আছে শুধু এক প্রাণহীন রোবটিক উচ্চারণ। আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছি এক নিষ্প্রাণ জড় জগতে। সেলফির যুগে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক ভালোবাসায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছে।

হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজ প্রকৃত ভালোবাসার বড়ই আকাল। ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে জনপ্রাণী ও প্রকৃতি বিভিন্নভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। মানুষই এখন মানুষের বড় শত্রু। পরিবেশ ও প্রকৃতিও মানুষের লোভ-লালসা ও স্বার্থপরতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিয়ে মানুষ নিজেই এ সুন্দর পৃথিবীর জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোগ-বিলাস ও যৌনতার বাড়াবাড়ির ফলে মানুষ তার নিজের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। যুদ্ধ-হানাহানি-সন্ত্রাস, ক্ষুধা-দারিদ্র, বৈষম্য-বঞ্চনা, শোষণ-নির্যাতন, রোগ-ব্যাধি, ইত্যাদি বিপর্যয়ে ভরে গেছে এ পৃথিবী। আণবিক বোমা ও হাইড্রোজেন বোমার মত পারমানবিক অস্ত্রের মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন মানব সভ্যতা। মানুষের বিধ্বংসী সব কর্মকান্ডের ফলে ভালোবাসা ও শান্তি বিদূরিত হয়েছে পৃথিবী থেকে। মানুষকে তার নিজ অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই সত্যিকার ভালোবাসায় অবগাহন করতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থপরতার ঊর্ধে ওঠে সামষ্টিক ভালোবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। ব্যক্তিবাদী বা গোষ্ঠীবাদী ভোগসর্বস্ব চেতনার বদলে সার্বজনীন ভালোবাসা ও আত্মোৎসর্গের চেতনার উন্মেষ ঘটানোর সময় এখনই। তরুণ-তরুণীর বেহায়াপনাসুলভ মেলামেশার মধ্যে এ দিবসটিকে সীমাবদ্ধ রেখে নয়, সার্বজনীন ভালোবাসার মানবিক আবেদন সৃষ্টির কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে এ দিবসটি উদযাপিত হোক - এটাই হোক আজকের ভালোবাসা দিবসের আসল ভাবনা।

বিষয়: বিবিধ

১২৩০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

359509
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ০৩:০০
এম আবদুল্লাহ ভূঁইয়া লিখেছেন : ভালোবাসা দিবস আমাদের সংস্কৃতি নয়,ভালোবাসা দিবস নামক সামাজিক এ ক্যান্সার থেকে আপনার সন্তানদের দূরে রাখুন।ভ্যালেন্টাইন ডে’ যা আজকের ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’।এই দিসবতো পালনীয় নয় বরং একে থুথু নিক্ষেপ করা উচিত।এটা ভালবাসার নামে "গজব দিবস" "বিশ্ব বেহায়া" দিবস নাম হওয়া উচিত।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File