মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ববোধ
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০২ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:৪৩:৫৩ রাত
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সমগ্র আরবে বিরাজ করছিল ’আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অন্ধকার যুগ। গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ-কলহ, হানাহানি, দস্যুতা, লুন্ঠন, নারী ধর্ষণ, কন্যা শিশু হত্যা, প্রভৃতি জঘন্য অপরাধ ও বর্বরতায় লিপ্ত ছিল আরব জাতি। এহেন পরিস্থিতিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করলেন আরব সমাজ তথা সমগ্র মানব জাতির হেদায়েতের উদ্দেশ্যে। নবী করিম (সাঃ) তাঁর ওপর নাযিলকৃত ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের আলোকে সব মানুষকে আহ্বান জানালেন ইসলামের পথে। তিনি সৎ চরিত্র গঠনের মাধ্যমে তাদেরকে পরিশুদ্ধ করলেন, তাদেরকে শিক্ষা দিলেন কুরআনের বাণী, জ্ঞান ও জীবন পরিচালনার কৌশল। মাত্র তেইশ বছরের সাধনায় তিনি এমন একটি জাতি গঠন করলেন যারা বিশ্বকে উপহার দিল সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ও ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত এক ভেদাভেদহীন আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা। এ অবস্থার বর্ণনা পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এভাবে দিয়েছেন, ”আর তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা (পরস্পর হানাহানিজনিত কারণে) এক অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে অবস্থান করছিলে। অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমুহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হতে পার। আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম (৩:১০৩-১০৪)।” আল্লাহর রজ্জু বলতে এখনে ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। ইসলামের এ ভ্রাতৃত্বপূণৃ আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা সমগ্র মানব সমাজে প্রচারের জন্য মুসলমানদের মধ্য থেকে দল গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ পাকের উপরোক্ত নির্দেশের আলোকে নবী করিম (সাঃ) মদীনার বুকে মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন তা ছিল সৌভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই লোকগুলো কিছু দিন পূর্বেও অন্যায়ভাবে অপরের ধন-সম্পদ ও জীবন হরণে দ্বিধাবোধ করত না, এখন তারা নিজেদের জান-মাল দিয়ে অন্যকে রক্ষা করে। তিনি তাদের মধ্যে উত্তম নৈতিক গুণাবলী ও আধ্যাত্মিকতা সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর ফলে তাদের অন্তরে যে খোদাভীতি ও ঈমানী শক্তি জাগ্রত হয়েছিল তারই বলে বলীয়ান হয়ে এ দরিদ্র জাতি বিশ্বের পথভ্রষ্ট পরাশক্তিগলোর ক্ষমতা ও অহমিকাকে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়। এরা এমন এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয় কুরআনের ভাষায় তা যেন ’সীসা-ঢালা প্রাচীর’। মক্কার মুসলমানগণ যখন কোরেশদের নির্যাতনে অতিষ্ট তখন মদীনাবাসীর আমন্ত্রণে তাঁরা মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নিঃস্ব অবস্থায় তাঁরা মদীনায় খুবই কষ্টে জীবন যাপন করছিলেন। এ কঠিন পরিস্থিতিতে নবী মুাম্মদ (সাঃ) মক্কার মোহাজের ও মদীনার আনসারদেরকে পরস্পর ভ্রাতৃত্বের প্রীতি বন্ধনে আবদ্ধ করে দিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে (সাঃ) মদীনার মুসলিম আনসারগণ তাদের মোহাজের ভাইদের সাথে নিজেদের সহায়-সম্পদ এমনভাবে বন্টন করে নিয়েছিলেন যেভাবে সহোদর ভাইদের মধ্যে সম্পদের ভাগাভাগি হয়। মদীনার আনসারগণের এ মহানুভবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ মোহাজেরদের কষ্টকে অনেক লাঘব করে দিয়েছিল।
ঈমানের ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্বসলিভ সদ্ভাব ও সদাচারণ গড়ে ওঠেছিল তা তাদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করে। এক মুসলমানের সাথে অন্য মুসলমানের আচরণে আপন-পর ভেদাভেদ ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে নবী করিম (সাঃ) বলেন, ”সেই মহান সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন, কোন ব্যক্তি ততক্ষণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, আরেক মুসলমান ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ না করবে (বোখারী/মুসলিম)।” এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে ভিন্ন চোখে দেখা ঈমানের পরিচায়ক নয়। ভাল কিছু নিজের জন্য রেখে দিয়ে খারাপটা অন্যকে দেওয়া ইসলাম কোনভাবেই অনুমোদন করে না। এটা স্বার্থপরতা ও হীনতার লক্ষণ। এধরনের আচরণ পরস্পর দূরত্ব ও বিভেদ সৃষ্টি করে। নিজের জন্য যে আচরণ পছন্দনীয় অপর ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ করতে হবে - এটাই ইসলামের নির্দেশ। এতে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালবাসা বৃদ্ধি পায় এবং একটি সৌহার্দপূর্ণ সমাজ গড়ে ওঠে। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) মদীনার বুকে সেই সমাজ ব্যবস্থাই গড়ে তোলেছিলেন।
প্রতিটি মুসলমান একে অপরের দ্বীনি বা ধর্মীয় ভাই। একই ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেছে তাদের এ সম্পর্ক। এ নিগূঢ় সম্পর্ক ঈমানের বন্ধনে আবদ্ধ, এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহ ও তাঁর নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রতি ভালবাসায় ও আনুগত্যে পরিপূর্ণ এবং পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোকিত। এ সম্পর্ক কত দৃঢ়, কত মধুর ও কত আন্তরিক তা প্রতিদিনের ইসলামী জীবন চর্চার মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সাথে সাক্ষাত হওয়া মাত্র ’আস্সালামু আলাইকুম’ এবং ’ওয়া আলাইকুম সালাম’ বলে পরস্পর সালাম বা সম্ভাষণ বিনিময় করে। অর্থাৎ আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। একে অপরের কল্যাণ ও নিরাপত্তা কামনায় কত মধুর ও আন্তরিক এ সম্ভাষণ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর নির্দেশ হলো: ” আর যখন তোমাদেরকে অভিবাদন জানানো হয়, তখন তোমরা এর চেয়েও উত্তম পন্থায় তার জবাব দাও কিংবা (অন্ততপক্ষে সে যতটুকু বলেছে) ততটুকুই ফেরত দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে হিসাব-নিকাশ গ্রহণকারী (৪:৮৬)।” বাড়তি কিছু শব্দ সংযোজনের মাধ্যমে সালামের জবাব দেওয়া শ্রেয় ও অধিক শিষ্টাচারসম্মত। খালিছ অন্তরে এ ধরনের সালাম বিনিময় করলে উভয়ের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত নেমে আসে।
ইসলামের প্রতিটি ফরয এবাদতের মধ্যেও মুসলিম সমাজের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠার অনেক সুযোগ রয়েছে। মসজিদে জামাতে নামায আদায়ের জন্য যখন তারা দিনে পাঁচ বার মিলিত হয় তখন তাদের মধ্যে পরস্পর সালাম ও কুশল বিনিময় হয়। প্রতিদিন বারবার এ সম্মিলন তাদের মধ্যে ভালবাসা ও সম্প্রীতির সৃষ্টি করে। মসজিদে যখন ধনী-গরীব ও রাজা-প্রজা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আল্লাহ পাকের সামনে নামাযে রত হয়, তখন তাদের মধ্যে একতা, সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয়। রোজা পালনের মাধ্যমে তারা অভুক্ত থেকে যেমন অনাহারক্লিষ্ট মানুষের কষ্ট অনুভব করে, তেমনি তাদের প্রতি সহৃদয়তার হাত প্রসারিত করে দেয়। তাই রমযান মাসে দান-খয়রাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে তাদের কষ্ট লাঘবে ব্রতী হয়। সারাদিন রোজা শেষে সবাইকে নিয়ে এসাথে ইফতারী খাওয়ার রেওয়াজ মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সুষ্টির এক অপূর্ব সুযোগ। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে গরীব আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত প্রতিবেশী, মুসাফির, ঋণগ্রস্ত ও ফকির-মিসকিনকে সহায়তা করে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক শান্তিকে সমুন্নত রাখে। হজ্জ্ব পালনের সময় পবিত্র কাবা শরীফকে কেন্দ্র করে বিশ্বের মুসলমানদের সম্মিলন ঘটে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। রোজার ঈদে ফিতরার খাদ্যসামগ্রী বা অর্থ বিতরণ এবং ঈদুল আযহায় সবার মধ্যে কোরবানীর মাংস ভাগ করে খাওয়ার মধ্যেও রয়েছে পারস্পরিক সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বল নিদর্শন। এভাবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এবাদতের মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজে ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠার বিরাট সুযোগ দান করেছেন। ইসলামের এবাদত-বন্দেগীতে শুধু আল্লাহর নৈকট্য ও ভালবাসাই অর্জিত হয় না, মানুষে মানুষে নৈকট্য ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে এক সুন্দর সমাজ তৈরী হয়।
মুসলিম সমাজের প্রতিটি সদস্য পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যবোধের দ্বারা আবদ্ধ। পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে তা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে: ”আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়তাকারী বন্ধু। তারা (একে অপরকে) ভাল কথা শিক্ষা দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী (৯:৭১)।” আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীসে প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন: ”একজন মুসলমানের অন্য মুসলমানের ওপর ছয়টি অধিকার রয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, সেগুলো কি কি? উত্তরে রসূল (সাঃ) বললেন: যখন তুমি তোমার মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করবে, তখন তাকে সালাম করবে। যখন সে তোমাকে দাওয়াত দেবে তখন তার দাওয়াত কবুল করবে। যখন সে তোমার হিত কামনা করবে বা সদুপদেশ চাইবে, তখন তুমিও তার হিত কামনা করবে বা সদুপদেশ দেবে। আর যখন সে হাঁচি দেয় এবং আলহামদুলিল্লাহ বলে, তখন তার জবাব দাও। যখন সে রোগাক্রান্ত হয় তখন তাকে দেখতে যাও ও তার সেবাযতœ কর। আর যখন সে মারা যায় তখন তার জানাযার নামাযে ও দাফনে শরীক হও (মুসলিম)।” এ হাদীসে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অধিকার সমূহ সুন্দর ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এ অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করলে একটি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠবে।
এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের পারস্পরিক অনুভূতি কত প্রগাঢ় তা বোঝাতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন। হযরত নোমান বিন বশীর (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন, ”তুমি মুসলমানদেরকে পরস্পরের প্রতি দয়া, সম্প্রীতি ও সহানুভূতি পোষণে একটি দেহের মতই দেখতে পাবে। দেহের একটি অঙ্গ যদি কোন রোগে আক্রান্ত হয়, তবে অবশিষ্ট সব কয়টি অঙ্গ জ্বর ও অনিদ্রার শিকার হয়ে তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে (বোখারী/মুসলিম)।” দেহের একটি অঙ্গে যদি একটি কাঁটাও ফোটে, সারা অঙ্গ ব্যথায় কাতর হয়ে ওঠে, ব্যথা নিরসনে প্রচেষ্টা চালায়। সমগ্র মুসলিম সমাজও তেমনই একটি দেহের মত, এ সমাজের কোথাও কোন মুসলমান বিপদগ্রস্ত হলে তার প্রতি সহমর্মীতায় পুরো মুসলিম সমাজই ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে, তার সহায়তায় এগিয়ে আসে। পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ ও সহানুভূতিমুলক আচরণ কেমন হওয়া উচিত এ হাদীসে তার নির্দেশনা পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, অপর এক হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পেটপুরে খেলে ঈমানদার হওয়া যায় না। প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখ, অভাব ও কষ্টকে ভাগ করে নিতে ইসলাম নির্দেশ দেয়। প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও ভালবাসাপূর্ণ সমাজই ইসলামের কাম্য।
নিশ্চিত হওয়া ছাড়া শুধুমাত্র আন্দাজ বা অনুমানের ভিত্তিতে অন্যের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। এ ধরনের পাপকর্মে লিপ্ত না হওয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ”মুমিনগণ, তোমরা বেশী বেশী আন্দাজ-অনুমান করা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কিছু আন্দাজ-অনুমান গুনাহ। এবং কারো গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরাতো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু” (৪৯:১২)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, ”কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করো না, কেননা খারাপ ধারণার ভিত্তিতে যে কথা বলা হবে, তা হবে ডাহা মিথ্যে কথা। তাহাস্সুস করো না অর্থাৎ কারো সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান করে বেড়িও না, তাজাস্সুস করো না অর্থাৎ কারো দোষ অন্বেষণে ব্যপৃত থেকো ন, তানাজুস করো না অর্থাৎ (মিথ্যে ক্রেতা সেজে আসল ক্রেতাদেরকে ফাঁসানোর অসৎ উদ্দেশ্যে) দালালী করো না, তাদাবুর করো না অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করো না, পারস্পরিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করো না। আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকো, পরস্পর ভ্রাতৃত্বসুলভ জীবন যাপন করো (আবু দাউদ)।” কি কি কারণে সমাজে অশান্তি ও হানাহানি সৃষ্টি হয় তা এ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সামাজিক শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার জন্য এসব বাজে অভ্যাস ত্যাগ করে আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে ভ্রাতৃত্বসুলভ জীবন যাপনের তাগিদ দিয়েছেন আল্লাহর নবী (সাঃ)।
মুসলমান মুসলমানে তিক্ততা ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতে পারে। তবে এ মনোমালিন্য দীর্ঘায়িত করা যাবে না। তাতে শয়তান দুই ভাইয়য়ের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাবে। তাই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ মুসমানদেরকে তাদের মধ্যকার বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে ফেলে নিজেদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে অটুট রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ”অবশ্যই মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে (দ্বন্দের সৃষ্টি হলে) মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও (৪৯:১০)। এ প্রসঙ্গে হযরত আইয়ুব আনসারী (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে নবী করিম (সাঃ) বলেন, কোন মুসলমান অপর মুসলমান ভাইয়ের সাথে তিন দিনের বেশী সম্পর্ক না রাখা, এবং পথে দেখা হলেও একজন অপরজনের দিকে না তাকানো জায়েয নয়। এ ধরনের দু’জনের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে প্রথমে সালাম দেয় (বোখারী/মুসলিম)।” এখানে সালামের অর্থ হলো, অন্তরে আল্লাহর ভয়কে স্থান দিয়ে শান্তি ও কাল্যাণ কামনার মধ্য দিয়ে মীমাংসার পথে অগ্রসর হওয়া এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করা। এতে পারস্পরিক মনোমালিন্য দূর হয়ে পুনরায় ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠিত হবে।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কারো সাথে কারো ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক অথবা শত্রুতা ও ঘৃণার সম্পর্ক কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ বা লাভালাভের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে না, শুধুমাত্র ইসলামের স্বার্থেই তা গড়ে ওঠে। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে আনুগত্য ও ভালবাসার সম্পর্ক বজায় রাখে তারাই মুসলমানদের বন্ধু, আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শত্রু, স্বাভাবিকভাবেই তারা মুসলমানদেরও শত্রু। কারো বন্ধুত্ব বা শত্রুতার উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর ওয়াস্তে এবং ইসলামের খাতিরে হয় তবে আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা অনেক উপরে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সাঃ) বলেন, ”আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কতক এমনও আছে যারা নবী নয়, শহীদও নয়, তথাপি তারা আল্লাহর কাছে এত মর্যাদাসম্পন্ন হবে যা দেখে নবী-রাসুলগণও তাদের প্রতি ঈর্ষাবোধ করবেন। উপস্থিত সাহাবীবৃন্দ তাঁর নিকট জানতে চাইলেন, তারা কারা? তিনি বললেন, তারা পরস্পরের আত্মীয় ছিল না, পরস্পরে কোন আর্থিক লেনদেনও করতো না, বরং শুধু আল্লাহর দ্বীনের ভিত্তিতে পরস্পরকে ভালোবাসতো। আল্লাহর কসম, তাদের মুখমন্ডল আলোকোদ্ভাসিত ও জ্যোতির্ময় হবে, অন্য সব মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত থাকলেও তাদের কোন ভয়ভীতি ও দুশ্চিন্তা থাকবেনা। এরপর তিনি সুরা ইউনুসের এ আয়াতটি পাঠ করলেন, ”জেনে রেখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয়ও নেই, তারা কোন দুশ্চিন্তায়ও পড়বে না (আবু দাউদ)।” কোন ব্যক্তিগত দুনিয়াবি স্বার্থে নয়, শুধুমাত্র ইসলামী জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্যে যারা পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলবে তারাই এ মর্যদার অধিকারী হবে।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্যকে একটি শক্ত দালানের সাথে তুলনা করেছেন নবীজী (সাঃ)। হযরত আবু মূসা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ”মুসলমান মুসলমানের জন্য অট্টালিকার মত, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তি যোগায়। এরপর তিনি এক হাতের আঙুলগুলোকে অন্য হাতের আঙুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখালেন (বোখারী/মুসলিম)।” একটি দালানের প্রতিটি ইট পরস্পর যুক্ত থেকে যেভাবে মজবুত কাঠামো তৈরী করে, তেমনই মুসলিম সমাজের একতা ও সঙ্ঘবদ্ধতা তাদের পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতিকে জোরদার করে। অপরদিকে পরস্পর বিচ্ছিন্নতা পতন ডেকে আনে। এভাবে মুসলিম সমাজে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শিথিল হলেই পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। নবী (সাঃ) মুসলিম জাতির ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বকে সংহত করার জন্যই এ কথাগুলো বলেছেন। ইসলামের শত্রুরা বিভিন্ন সময়ে, এমন কি নবীজীর (সাঃ) যামানায়ও মুসলমানদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বে ফাটল ধরাতে চেয়েছে। রাসুলুল্লাহর (সাঃ) সময়ে মুসলমানদের ঈমানের ভিত এতই মজবুত ছিল যে, শত্রুদের এসব চক্রান্ত তাদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বে চিড় ধরাতে পারেনি। তাই মুসলিম জাতি এত স্বল্প সময়ে বিশ্বের বুকে এক সেরা জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।
ইসলামের সেই এক সোনালী যুগ ছিল, তা অতীত হয়ে গেছে। বর্তমান সময় মুসলিম উম্মাহর জন্য বড়ই দুর্যোগের কাল। বিশ্ব ব্যাপী মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আজ মুসলমানদের ঈমান অনেক দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তারা শতধা বিভক্ত। তাই সারা বিশ্বে তারা অতীব দুর্বল জাতিতে পরিণত হয়েছে। সর্বত্রই আজ তারা নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ও অপমানিত। এর কারণ, আল্লাহর রজ্জু অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর বিধান থেকে তারা এখন অনেক দূরে সরে এসেছে। তাদের মধ্যে স্বার্থপরতা বেড়ে গেছে এবং তারা অন্তর্কলহ ও পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদে জড়িয়ে পড়েছে। তাই বহিঃশত্রু আজ তাদের ওপর চড়াও হয়ে তাদেরকে নিষ্পেষিত করছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকালে এ করুণ দৃশ্য এক সুস্পষ্ট বাস্তবতা। অন্যান্য মুসলিম দেশেও এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে অবলীলায় শুধু কাফের আখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, বরং অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, মসজিদে নামাযরত মুসল্লীদের ওপর বোমা হামলা চালিয়ে নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। বিধর্মীদেরকে মিত্র বানিয়ে অহরহই মুসলিম দেশ ও জনপদে আক্রমণ চালিয়ে স্বধর্মী মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা করছে। মুসলিম জাতির জন্য এর চেয়ে নাজুক ও হতাশব্যঞ্জক অবস্থা আর কি হতে পারে? বিদেশী চক্রান্তে এক দল উগ্রবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে যারা অতি সামান্য মতবিরোধকেও ইসলামের নামে উস্কে দিয়ে সমাজে হানাহানি ও হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ’আইয়ামে জাহেলিয়াতের’ যুগই যেন ফিরে এসেছে। এ ভয়ানক পরিস্থিতির ব্যাপারে সাবধান বাণী উচ্চারণ করে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন, ”আর আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মেনে চলো। তাছাড়া তোমরা পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। যদি তা কর, তবে তোমরা মনোবল হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের প্রভাব ও শক্তি চলে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন। (৮:৪৬)।”
অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করার মত জঘন্য অপরাধ আর নেই। হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়-অবিচার, লোভ-লালসা ও জুলুম-অত্যাচার মানুষকে হত্যার প্রতি প্ররোচিত করে। যারা এ ধরনের জঘন্য পাপে নিমজ্জিত তাদের সম্পর্কে আল্লাহ ক্রোধ ব্যক্ত করে বলেন, ”যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্যে ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন (৪:৯৩)।” এ প্রসঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিদায় হজ্জ্বের ভাষণটিও স্মরণীয়। আরাফার ময়দানে হজ্জ্বের ভাষণে তিনি বলেন, ”শুনে রাখো, আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের রক্ত, ধনসম্পদ ও মানসম্ভ্রম ঠিক তদ্রƒপ সম্মানিত ঘোষণা করেছেন, যেরূপ তোমাদের নিকট আজকের এই দিন, এই মাস ও এই শহর সম্মানিত। আমি কি এ কথাটি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি? উপস্থিত লোকেরা সমস্বরে বললো, হ্যাঁ, আপনি পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ্, তুমি স্বাক্ষী থেকো যে, আমি উম্মতের নিকট তোমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। এ কথা দিনি তিনবার বললেন। পুনরায় বললেন, সাবধান, আমার পরে তোমরা কাফের হয়ে যেয়ো না যে, মুসলমান হয়েও একে অপরকে হত্যা করতে থাকবে” (ইবনে ওমর রাঃ বর্ণিত, বোখারী শরীফ)। এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে হত্যা করা কুফরীজনিত পাপ বিধায় তার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম।
ইসলাম ন্যায় ও শান্তির ধর্ম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাতির হেদায়েত এবং ইহ ও পরকালীন শান্তির জন্যই ইসলামের আবির্ভাব। আল্লাহ্ ইসলামকে একটি মধ্যপন্থী ধর্ম হিসেবে মনোনীত করেছেন। এতে কোন রকম জোর-জবরদস্তি ও বাড়াবাড়ির স্থান নেই। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুসলমানদের সার্বিক অবস্থার বিশদ পর্যালোচনা করা অতীব প্রয়োজন। মুসলিম জাতির ভ্রাতৃত্ববোধকে পুনরায় কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ অনুযায়ী জাগ্রত করতে হবে। সকল হানাহানি দূর করে, স্বার্থপরতা ভুলে সত্যিকার মুসলমানের চরিত্র গঠনে মনোযোগি হওয়ার এখনই প্রকৃষ্ট সময়। ইসলামের সোনালী যুগে যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠেছিল, সেরূপ সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে আজকের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর যখনই এ লক্ষ্য নিয়ে মুসলিম সমাজ অগ্রসর হবে তখনই নেমে আসবে আল্লাহর সাহায্য ও নেয়ামত। মুসলিম উম্মাহই শ্রেষ্ঠ - এর কারণ হিসেবে আল্লাহ্ বলেন, “তোমরাই (এই দুনিয়ায়) সর্বোত্তম জাতি, সমগ্র মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। (তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে) তোমরা দুনিয়ার মানুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে, নিজেরাও তোমরা আল্লাহর ওপর (পুরোপুরি) ঈমান আনবে” (৩:১১০)। আল্লাহর রজ্জু কুরআনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে বর্তমান মুসলিম জাতি যখন পূর্বের ইসলামী চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যে বলীয়ান হয়ে ওঠবে তখনই সর্বোত্তম জাতির খেতাবে ভূষিত হওয়ার সৌভাগ্য পুনরায় অর্জন করতে সক্ষম হবে।
বিষয়: বিবিধ
৩৭৪০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন