বাঙালী মুসলমানের আত্মপোলব্ধী
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২৬ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:০৯:২৬ রাত
প্রতিটি জাতিরই একটা আত্ম-পরিচয় আছে। এ পৃথিবী জুড়ে কত জাতি, গোত্র, সম্প্রদায়, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ বসবাস করছে তার ইয়ত্তা নেই। সবাই আমরা আদি পিতা আদমের সন্তান। তবে এই বৈচিত্রময় পৃথিবীতে মানুষ যাতে তার নিজস্ব পরিচয়ে তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ নিয়ে একত্রে বসবাস করতে পারে সে জন্য মহান আল্লাহ্ বিভিন্ন জাতি, গোত্র ও সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন, Òহে মানব জাতি! তোমাদেরকে আমি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো (৪৯:১৩)।Ó এই আবহমান বাংলার বুকে আমাদের জন্ম। এখানকার মাটি, পানি ও আলো-বাতাসে আমরা লালিত-পালিত। আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় আমরা কথা বলি। এদেশের রূপ-রস-গন্ধ ও খাদ্য-পানীয়ে আমরা পরিপুষ্ট। তাই জাতি হিসেবে আমরা বাঙালী। এ পরিচয়ের বাইরেও আমাদের আরেকটি পরিচয় আছে। তা হলো আমাদের ধর্মীয় পরিচয়। আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস - যার ভিত্তিতে আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিদিনের প্রতিটি কর্ম ও চিন্তাভাবনা প্রভাবিত হয়ে থাকে। ইতিহাসের গতিধারায় এক সময়ে রাজনৈতিক কারণে বাঙালী সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে বিভাজনের সৃষ্টি হয়। এ বিভাজনের মাধ্যমে হিন্দু বাঙালী ও মুসলমান বাঙালী এ দুইটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার উদ্ভব ঘটে। বাস্তবতার আলোকে এখন আমাদের পরিচয় বাঙালী মুসলমান। আমাদের আত্মোপলব্ধীর জন্য এ বিভাজনের ইতিহাস জানা প্রয়োজন।
গ্রাম বাংলার বাঙালী সমাজ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। এর পূর্বে তাদের অধিকাংশই ছিল নিচু বর্ণের হিন্দু। হিন্দু রাজন্যবর্গের শাসনামলে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দ্বারা তারা ছিল নিগৃহীত ও শোষিত এবং জাতিভেদপ্রথা ও বর্ণ-বিদ্বেষের শিকার। ধর্ম-কর্ম ও সামাজিকতায় তারা ছিল অচ্ছুৎ ও অপাঙক্তেয়, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল অবহেলিত। ইতিহাসের এ পর্যায়ে বাংলার বুকে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। মুসলিম রাজন্যবর্গের সাথে এ দেশে আসেন শত শত ধর্মপ্রাণ সূফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়া। তাঁরা স্থাপন করেন খানকাহ ও মসজিদ এবং প্রচার করতে থাকেন ইসলামের একত্ববাদ, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী। ইসলামের ভেদাভেদহীন সামাজিক সাম্য, সহজ সরল জীবন বিধান ও ন্যায়নীতি গ্রাম বাংলার নিপীড়িত বাঙালী সমাজকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁরা এসব ধর্মপ্রচারকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বাঙালী মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং এক সময়ে তারা বিপুল জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার বুকে হিন্দু ও মুসলিম দুটি সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে একত্রে বসবাস করছে। মুসলিম শাসনামলে বাংলার বুকে এ দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। বৃটিশ আমলেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজনের বীজ রোপিত হয়।
ঊনবিংশ শতকে বৃটিশ আমলা ও বাংলা সাহিত্যের এক কীর্তিমান পুরুষ বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর সাহিত্য কর্মে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প উদ্গীরণ করতে থাকেন। তিনি সাম্প্রদায়িক-বিদ্বষের জনকও বটে। মুসলিম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ তাঁর লিখিত গ্রন্থ Ôআনন্দ মঠÕ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার এক রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে হিন্দু বাঙালী সমাজে ব্যাপক সমাদর লাভ করে। এ গ্রন্থে তাঁর রচিত Ôবন্দে-মাতরমÕ গানটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। তাঁর এ বিদ্বেষপুর্ণ সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে দীক্ষিত হিন্দু সমাজ মুসলমানদেরকে ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে, ইত্যাদি গালাগালে আখ্যায়িত করে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়াও আরও অনেক হিন্দু কবি সাহিত্যিক মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকেন। বৃটিশ ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে যে শোষণ-নিপীড়নমূলক জমিদারি ব্যবস্থা চালু করেছিল, বৃটিশদের সহায়তায় হিন্দু বাবু ভদ্দরলোকগোষ্ঠী ছিল এই নব্য জমিদারি ব্যবস্থার পুরাপুরি উপকারভোগী। তাদের জমিদারির তালুকগুলো সবই পূর্ববাংলায় অবস্থিত হলেও তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো রাজধানী কোলকাতা শহরে। বঙ্কিম বাবু ছিলেন এ জমিদার শ্রেণীরই একজন নিষ্ঠাবান প্রতিভূ।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে যখন Õবঙ্গভঙ্গ-রদÕ আন্দোলনকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে Õআমার সোনার বাংলাÕ গানটি রচনা করেন তখন তিনি জানতেন না এ গানটিই একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে রূপান্তরিত হবে। বৃটিশ শাসনামলের এ সময়ে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী বিভক্ত হয়ে পূর্ববাংলা ও আসামকে একীভূত করে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়, যার রাজধানী করা হয়েছিল ঢাকা শহরকে। এর উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক, অর্থাৎ পূর্ববাংলা ও আসামের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন। পূর্ববাংলার দরিদ্র কৃষিজীবি মুসলিম জনগোষ্ঠী বৃটিশ রাজের এ নতুন প্রশাসনিক সংস্কারকে স্বাগত জানালেও কোলকাতা ভিত্তিক হিন্দু Õভদ্দরলোকÕ শ্রেণী Õবঙ্গমাতাকেÕ বিভক্ত করার অজুহাতে বৃটিশ-বিরোধী প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। সমগ্র বাংলার জনগণের ওপর কোলকাতার এ ভদ্দরলোক শ্রেণীটির আধিপত্য ছিল নিরঙ্কুশ। আসলে তাদের প্রভাব বলয় থেকে পূর্ববাংলা পৃথক হয়ে যাওয়ায় বঙ্গভঙ্গকে তারা তাদের কায়েমী স্বার্থের অন্তরায় মনে করেছিল। হিন্দু বাবুদের পরিচালিত স্বদেশী আন্দোলনের সাথে পূর্ববাংলার মুসলমানেরা একাত্ম হতে পারেনি। কারণ, এতে তাদের কোন স্বার্থ জড়িত ছিল না। বরং গ্রাম বাংলার কৃষক সমাজের লড়াইটা ছিল বৃটিশ শাসক ও তাদের দোসর হিন্দু জমিদার শ্রেণীর শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ছিল কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে আর তাঁর জমিদারি ছিল পূর্ববাংলায়। তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে নিজেদের কুঠিবাড়িতে থেকে জমিদারি দেখাশুনা করতেন। প্রায় এক দশক কাল তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর প্রজারা অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান কৃষক। তিনি তাঁর বিরাট সাহিত্যকর্মে তাঁর মুসলিম প্রজাদের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ ও বঞ্চনার কথা কতটুকু স্থান দিতে পেরেছিলেন কিংবা তাদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে কতটা একাত্ম হতে পেরেছিলেন তা তাঁর সাহিত্য-কর্মের গবেষকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে একথা ঠিক যে, বাঙালী শিক্ষিত মুসলমানরা তাঁকে শ্রদ্ধা করেছে, তাঁর সাহিত্য প্রতিভাকে সম্মান করেছে, তাঁকে আপন করে নিয়েছে। তাঁর রচিত গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে, যদিও এ গানটি রচিত হয়েছিল হিন্দু স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থনে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের জনগণের স্বার্থকে উপেক্ষা করে। বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদে বিক্ষুব্ধ হয়ে যে ভদ্দরলোকগোষ্ঠী বৃটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন করে বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল, ১৯৪৭ সালে তারাই স্বাধীন যুক্তবাংলার বিরোধিতা করে বাংলাকে ভাগ করতে বাধ্য করেছিল। কারণ, এ সময়ে পূর্ববাংলার শোষিত ও নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধিকার ও আত্মোন্নয়নের চেতনা পরিপুষ্ট হয়ে ওঠেছিল। সমগ্র বাংলায় তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, যা শাসন ক্ষমতায় তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ছিল। সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত ভদ্দরলোকগোষ্ঠী তখন বিভক্ত বাংলার পক্ষেই সোচ্চার হয়ে ওঠে। অচ্ছুৎ চাষাভূষা বাঙালদের সাথে এক কাতারে থাকাটা তারা মেনে নিতে পারেনি।
হিন্দু-মুসলিম এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা তৈরীর জন্য তৎকালীন কংগ্রেস নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও চিত্তরঞ্জন দাস নিরলস প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যান। এ জন্য জিন্নাহকে Ôহিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূতÕ ও চিত্তরঞ্জন দাশকে Ôদেশবন্ধু' খেতাব দেওয়া হয়। কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রচেষ্টায় জিন্নাহর Õলক্ষৌ প্যাক্ট’ ও চিত্তরঞ্জন দাশের Õবেঙ্গল প্যাক্টÕ কোনটিই কংগ্রেসের অসহযোগিতার কারণে সফলতার মুখ দেখেনি। কবি নজরুল ইসলাম তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েও হিন্দুদের মন জয় করতে পারেনি। হিন্দু নেতৃবৃন্দের উৎকট সাম্প্রদায়িকতা উভয় সম্প্রদায়কে দুই বিপরীত মেরুতে নিয়ে যায়। ফলে ১৯৪৭ সালে শুধু ভারতই বিভক্ত হয়নি, তার সাথে বাংলাও বিভক্ত হয়েছে। এই বিভক্তির পরিণতিতে ঘটেছে হাজারো মানুষের মৃত্যু, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি হারিয়ে দেশান্তরী হয় ও তারা নিঃস্ব ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে।
পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন মুসলিম লীগ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের যে দাবী করেছিল তার মূলে শুধু ধর্মীয় কারণ ছিল না, প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য। পশ্চাদপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার্থেই মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক আবাসভূমির দাবী করেছিলেন। তাঁরা উপলব্ধী করতে পেরেছিলেন, কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে মূলত উচ্চ বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি করছে। হিন্দু স্বদেশী আন্দোলনের ফলে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। এরপর বৃটিশ যখন পূর্ববাংলার মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় তাতেও হিন্দু সমাজ বাদ সাধে। দুঃখের বিষয়, কবি রবীন্দ্রনাথ নিজেও এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে কোলকাতার গড়ের মাঠে যে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় তার সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কোলকাতার হিন্দুদের বাধার কারণে ১০ বছর পিছিয়ে অবশেষে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের হীনমন্যতাবোধ এমন নীচে নামে যে, তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় নামে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। অবশ্য হিন্দু সমাজের এ হীন প্রকৃতি অতি পুরোনো। একাদশ শতব্দীতে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু সেন-বংশীয় রাজাদের শাসনামলে হিন্দু সমাজ সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিভেদ প্রথার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়। তখন থেকেই তাদের মন-মানসিকতায় উদারনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেনি। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেঙ্গল-রেঁনেসার প্রভাবে হিন্দু সমাজে যে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-চেতনার সূচনা হয় তাও তাদের এ হীনতাব্যঞ্জক মনোবৃত্তিকে প্রশমিত করতে পারেনি। তারা কখনও বাংলার মুসলমানদেকে আপন করে নিতে পারেনি।
বৃটিশ রাজত্বের রাজধানী কোলকাতা শহরকে ঘিরে যে বাঙালী সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগৎ এবং বিত্ত বৈভব গড়ে ওঠে তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অপ্রতিদ্বন্দী। পূর্ববাংলার অনগ্রসর বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায় তাদের নিকট ছিল অচ্ছ্যুৎ, চাষাভূষা ও বাঙাল নামে পরিচিত এবং তাদের শোষণ-নিপীড়নের শিকার। হিন্দু মহাজন ও ইংরেজ নীল-কুঠিয়ালের অত্যাচারে বাংলার কৃষক সমাজ ছিল জর্জরিত। বৃটিশ-শাসন এবং জমিদারি-শোষণের বিরুদ্ধে গ্রাম বাংলায় যে লড়াই চলছিল তা ছিল এ চাষাভূষাদেরই লড়াই। বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজ যখন হিন্দু জমিদার ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের আগ্রাসনে দিশেহারা তখন কিছু সংখ্যক মুসলিম মনীষি তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে এগিয়ে আসেন। এ লড়াইয়ের সূচনা করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ তাঁর পরিচালিত Õফরায়েজী আন্দোলনেরÕ মাধ্যমে। তাঁর পুত্র দুদু মিয়া এ আন্দোলনকে বিস্তৃত করেন বাংলার বিভিন্ন জেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তীতুমীর ও ফকির মজনু শাহ জীবন দিয়ে এ লড়াইকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁদের এ লড়াই শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে জন্ম দিয়েছিল আত্ম-সচেতনতা, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও স্বাধিকারের। নিজেদের অধিকার রক্ষা এবং বাঙালী মুসলিম পরিচয়ে নিজেদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার বিপুল আগ্রহ দেখা দিয়েছিল তাদের অন্তরে। তাঁদেরই সুযোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন মুন্সী মেহেরুল্লাহ, নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কায়কোবাদ, নবাব সলিমুল্লাহ, মওলানা আক্রম খাঁ, শেরে-বাংলা এ, কে, ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী, প্রমুখ। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলার মুসলিম সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদেরকে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলে। সর্বভারতীয় মুসলমানদের প্রচেষ্ঠায় ১৯০৬ সালে নব গঠিত পূর্ববাংলা ও আসামের রাজধানী ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ।
মুসলিম সমাজের এ জাগরণকে শুধু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার জাগরণ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। তাদের এ জাগরণের পেছনে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণগুলোও প্রাধান্য লাভ করেছিল। জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর শোষণ-নিপীড়ন, সামাজিক অবমাননা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, এসব মিলিয়ে মুসলিম সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন ও অবদমিত করে রাখার প্রবণতা তাদের মধ্যে এক স্বাতন্ত্র্যবোধের জন্ম দেয় - যা ধর্মের ভিত্তিতে তাদেরকে হিন্দু বাঙালী সম্প্রদায়ের বিপরীতে পৃথক এক মুসলিম বাঙালী সম্প্রদায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ করে দেয়। ১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হলেও এখানকার অধিকার সচেতন মানুষের স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম কখনও স্তিমিত হয়ে যায়নি। পাকিস্তানী স্বৈরশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধেও তারা লড়াই করে চলছিল নিরন্তর। ভাষার অধিকার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার সব বাসনাই পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছিল একাত্তরের মুিক্তযুদ্ধের চেতনায়। অবশেষে লাখো শহীদের খুনে রাঙা বিজয় পতাকা উত্থিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে। পূর্ববাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে এক স্বতন্ত্র সত্তায় রূপ দান করতে সক্ষম হয়েছে। তারা তাদের ভাষাকে বুকের রক্ত ঢেলে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করেছে। বাংলাদেশ এখন শুধু একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত নয়, বাংলাদেশের মানুষ একটি আত্ম-মর্যাদাশীল জাতি হিসেবেও বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
ধর্মরিপেক্ষতার দাবীদার ভারতের স্বাধীনতার ৬৮ বছর পরও হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক তিক্ততার অবসান হয়নি। ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মান্ধ ও উগ্র সাম্প্রদায়িক দল বিজেপিÕর উত্থান শুধু ভারতেই নয় উপমহাদেশের সর্বত্র উত্তেজনার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রায়শই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা সংঘটিত হচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে গুজরাটে এবং অতি সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের মুজাফফরাবাদে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমানকে উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে হয়েছে। ভারতে গোমাংস খাওয়ার কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও হত্যাকান্ড ঘটে চলছে অহরহ। ভারত থেকে বিদেশে গোমাংস রপ্তানী করা হয় এবং গরুর চামড়ায় তৈরী জুতা পায়ে ব্যবহৃত হয়, অথচ অন্য ধর্মাবলম্বীরা গোমাংস ভক্ষণ করলে হিন্দুদের ধর্মহানি ঘটে। এ এক অদ্ভূত কথাই বটে। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভারতের এ ধরনের গোবৎ চেহারা ও গোমূর্খের মত কর্মকান্ড খুবই বেমানান ও হাস্যকর। এসবই ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার খোলসে ধর্মান্ধতা ও ভন্ডামী বই কিছু নয়।
আজকের বাংলাদেশে হিন্দু সমাজ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে উন্নত, সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রেও তারা অনেক উচ্চপদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। নিজ দেশে তাঁরা স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। অথচ আমাদের প্রতিবেশী ভারতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো খুবই নিরাপত্তাহীন ও নির্যাতনের শিকার। আমাদের পার্শ্ববর্তী পশ্চিম বাংলার জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মুসলমান হলেও শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও চাকুরীর ক্ষেত্রে তারা এখনও অনেক পিছিয়ে। বিবিসি বাংলা সূত্রে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার একটি তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী কোলকাতার পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। Õমুসলমানের কথাÕ নামে এ তথ্যচিত্রটির পরিচালক সৌমিত্র দস্তিদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, Óরাজ্যে যে প্রায় ২৫% বাঙালি মুসলমান আছেন, তাঁদের মাত্র দুই শতাংশ সরকারি চাকুরিতে রয়েছেন। বেসরকারি ক্ষেত্রের অবস্থাটাতো আরও খারাপ। যদি শিক্ষক-অধ্যাপকদের মধ্যে মুসলমান খুঁজতে যান, খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হবে। এমনকি মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও মাত্র জনাকুড়ি মুসলমান সাংবাদিক খুঁজে পেয়েছি এই তথ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে।Ó তাঁর তথ্যচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের করুণ অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, Óযে গ্রামেই গেছি, সেখানেই খোঁজ পেয়েছি অনেক ১৩-১৪ বছরের কিশোরের যারা বড় বড় শহরে নির্মাণ শিল্পে কাজ করতে গেছে। যদি এখানে অর্থনৈতিক অবস্থাটা ভালই হবে, তাহলে ওইটুকু বাচ্চা ছেলেদের গ্রাম-পরিবার ছেড়ে কেন কাজ করতে যেতে হবে বাইরে?Ó প্রশ্ন সৌমিত্র দস্তিদারের। কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা অনেকটাই পিছিয়ে, সেই তথ্য প্রথম উঠে এসেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি Õসাচার কমিশনেরÕ প্রতিবেদনে।
ভারতের অভ্যন্তরীন অবস্থা যত কুৎসিতই হোক, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার বিরাট অবদানের কথা আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে। ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে আমাদের স্বাধীনতা দীর্ঘায়িত ও কষ্টকর হতো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রতিবেশী ভারতের সাথে যেমন আমাদের দৃঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, তেমনই আমাদের জাতীয় স্বার্থ, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভারতীয় আগ্রাসন থেকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারতীয় কঠোর মনোভাব ও আচরণ বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ককে জটিল ও কন্টকিত করে তোলে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও গঙ্গা নদীর একতরফা পানি প্রত্যাহার নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে প্রথম চিড় ধরে। এরপর তিস্তা নদীর পানি বন্টন, বাংলাদেশের সীমান্তের শত শত মাইল জুড়ে কাঁটতারের বেড়া তৈরী, সীমান্তে অহরহ ভারতীয় বিএসএফ গুলিতে বাংলাদেশী নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, বাংলাদেশের পণ্য আমদানীতে ভারতের নানান ধরনের শুল্ক-অশুল্ক বাধা আরোপ, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘ কাল ক্ষেপন, বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রদর্শন ভারতে নিষেধাজ্ঞা, ছোট থেকে বড় আরও অনেক ক্ষেত্রে উভয় দেশের সম্পর্ককে কন্টকিত করে রেখেছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নানাভাবে ট্র্যানজিটসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে ভারতের মনস্তুষ্টির চেষ্টা করছে, আশা হয়তো ভারত একটু উদার মনোভাব দেখাবে। কিন্তু একমাত্র আশ্বাসের বাণী ছাড়া তেমন কোন বাস্তব উদারতা ভারত এখনও দেখায়নি। বড় দেশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের যে উদার মনোভাব পোষণ করা উচিত ছিল তাদের মানসিক সংকীর্ণতার কারণে তা হয়ে উঠেনি। বৃটিশ আমলের সে পুরোনো মুসলিম বিরোধী মনোভাব থেকে ভারতীয় সমাজ এখনও বেড়িয়ে আসতে পারেনি। ভারতের এ ধরনের মনোভাব থেকে আমাদের সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ইতিহাসের গতি ধারায় ধর্মীয় ও সামাজিক ভেদাভেদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণ-নিপীড়ণের কারণে বাঙালী মুসলমানের মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি হয় তা তাদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জন্ম দেয়। বাঙালী মুসলিম পরিচয়ে তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে। এক সময়ে তা তাদেরকে হিন্দু বাঙালী সমাজ থেকে পৃথক করে ভিন্ন এক জাতি গঠনে অনুপ্রাণিত করে। বাঙালী মুসলমান ইসলামের উদারনৈতিক ভাবধারায় পুষ্ট বলেই দেশে অন্যসব সম্প্রদায়ের লোকেরা বাংলাদেশে তাদের সকল অধিকার নিয়ে উন্নত জীবন যাপন করতে পারছে, জাতীয় সকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর চক্রান্তের কারণে বিশ্ব জুড়ে ইসলামের নামধারী কিছুসংখ্যক উগ্রবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে। তাদের হিংসাত্মক কর্মকান্ডের জাল বাংলাদেশেও বিস্তারের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। কিন্ত বাংলাদেশের মাটিতে তা শেকড় গাড়তে পারেনি। অতীতে এদেশের মানুষ যেভাবে ইসলামের একত্ববাদ, সাম্য ও মৈত্রীর বাণীকে সহজভাবে ধারণ করে মুসলমান হয়েছিল আজও তারা ইসলামের উদারত্ব ও মহত্ত্বকে ঠিক সেভাবেই লালন করে চলেছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি এবং ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত আমাদের জাতীয় চেতনা আমাদের ভবিষ্যত বিনির্মাণে সঠিক পথ দেখাবে।
বিষয়: বিবিধ
১২৩১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লিখাটা ভালো লাগলো, আমার মনে হয় আমাদের পরিচয় আমরা মুসলিম খুব গুরুত্বপূর্ণ । দেশ অনুযায়ী জাতীয়তা ভিন্ন হতে পারে কিন্তু ধর্মীয় পরিচয় অনেক বেশী মুখ্য মুসলিমদের জন্য!
আর প্রতিবেশীর কথা বলছেন- বাংলাদেশ যতটুকু সুসম্পর্ক বজায় রাখে- নিজের মাথা পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে ইন্ডিয়াকে এরকম অন্য কোন দেশ করে নি!
শুকরিয়া আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন