রাজধানীর জলাবদ্ধতা জাতীয় জীবনের প্রতীক

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:৫২:৩৭ সকাল

সেপ্টম্বরের পহেলাতেই মাত্র দুই ঘন্টার বর্ষণে তলিয়ে গেছে রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ এলাকা। রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি পানিতে থৈথৈ করছে। বৃষ্টির পানি বেরুনোর পথ সব অবরুদ্ধ। ফলে রাস্তায় যানবাহন চলাচল যেমন ব্যহত হয়ে পড়েছে, তেমনই জনজীবনও অচলাবস্থায় পড়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। রাস্তাগুলোকে মনে হচ্ছে প্রবাহমান নদী। তীব্র যানজট আর জলবদ্ধতায় নগর জীবর এখন বিপর্যস্ত। রাস্তায় রাস্তায় অনেক গাড়ী অচল হয়ে পড়ে আছে। ফলে স্বাভাবিক জীবনে দেখা দিয়েছে দুরাবস্থা। ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ ব্যবস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনে অকিঞ্চিৎকর বলেই মনে হয়। পানি নিষ্কাষণের প্রাকৃতিক খালগুলো ঢাকা শহর থেকে উধাও হয়ে গেছে। নৌকা চলাচলের জন্য ব্যবহৃত বড় দোলাই খালটিও বহু দিন হয় শহর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে । সর্বশেষ সেগুনবাগিচা খাল, জিরানী খাল, বেগুনবাড়ী খাল, ইব্রাহীমপুর খাল, গোপীবাগ খাল, মান্ডা খালগুলোর মত প্রায় ৫০টি খাল ভূমি-দস্যুদের কবলে পড়ে নিখোঁজ হওয়ার পথে। এছাড়া নগরীর চারপাশের জলাভূমিগুলোও এদের দ্বারা ভরাট হয়ে চড়া মূল্যে বিক্রী হচ্ছে। আমরা তো জানি, শরীরের রক্ত চলাচলের ধমনীগুলো যখন বন্ধ যায় তখন তার পরিণতি কি হয়। ঢাকা নগরীর ধমনীতুল্য প্রাকৃতিক খালগুলো বন্ধ হওয়ার ফলও যা হবার তাই হয়েছে। পরিণতিতে মাত্র দুই ঘন্টার বৃষ্টির পানি সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে এ নগরীর। একটু বৃষ্টি হলেই নগরী পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। জনজীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। অথচ নগরীর ষ্টর্ম ড্রেনেজ ব্যবস্থা তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডজনখানেকেরও বেশী সরকারী সংস্থা নিযুক্ত রয়েছে। অনেক সন্ন্যাসিতে গাজন নষ্টের মত এদের অকর্মণ্যতা নগরবাসীর জন্য একটা বড় দুর্ভাগ্য ও ভোগান্তির বিষয়।

বিশ্বের ১৪০টি নগরীর মধ্যে সবচেয়ে কম বসবাসোপযোগি নগরী হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দামেস্ক প্রথম স্থানে আছে। যুদ্ধের ডামাডোল থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমাদেরই প্রিয় নগরী ঢাকা। এ তথ্যটি দিয়েছে ‘ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট’ এর প্রকাশিত এ বছরের লিভেবিলিটি ইনডেক্স। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে কম বসবাসোপযোগি ১০টি নগরীর তালিকায় ঢাকা শহরের নাম অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ঢাকা নগরীতে বসবাসরত কোন নাগরিকই এ তথ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন না। কেননা এই নগরীর দুরাবস্থার তো তারাই প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। নগরীর শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থায়ই নয় - রাস্তা-ঘাট, গণপরিবহন, আবাসন, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস, সেনিটেশন, কাঁচা-বাজার, শপিং-মল, বাণিজ্যিক ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য-সেবা, হাসপাতাল-ক্লিনিক, খেলাধুলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন, পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট ও তথ্য সেবা প্রতিটির ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে এক অরাজক অবস্থা। ফলে প্রয়োজনীয় সব নাগরিক সুযোগ সুবিধার বড়ই আকাল এ নগরীতে। তাই ঢাকা নগরী সুন্দর জীবন যাপনের জন্য সবচেয়ে কম উপযোগী শহর হিসেবে বিশ্ব সমাজে পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের রাজধানী শহরের এ হাল সার্বিক দেশের ভাবমূর্তির জন্য লজ্জাজনক।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের প্রিয় নগরীটির এ দুরাবস্থা?

ঢাকা সিটি কর্পোরেশন তার স্বায়ত্ত্বশাসিত মর্যাদাকে কখনও সমুন্নত করে এগিয়ে যেতে পারেনি। একে বানিয়ে রাখা হয়েছে এক ঠুঁঠো জগন্নাথ। প্রায় সময়ই জনপ্রতিনিধিত্বহীন আমলারা এর দায়িত্বে থাকেন। এত বড় একটি নগরী, অথচ এর জন্য নেই কোন আলাদা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং নেই কোন সমন্বিত ও দূরদর্শী পরিকল্পনা। অনেকগুলো সরকারী ও স্বায়ত্ত্ব-শাসিত সংস্থা বিভিন্ন নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য নিযুক্ত থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাবে তেমন সেবা প্রদান সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেবামূল্য বাড়াতে তারা যেভাবে তৎপর, মানসম্মত প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে তারা ততটাই অক্ষম। মাত্র কয়েকদিন আগেই জ্বালানী তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম এই সরকারের আমলে ৭ম বারের মত বাড়ানো হলো। এত আকাশচুম্বী মূল্যে এসব সেবা কিনে জনগণ কি স্বস্তি পাচ্ছে? প্রায় সময়ই তো বিদ্যুৎ থাকে না, গ্যাসের অভাবে চুলা জ্বলে না, ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় চলাচল বড় দায়, নর্দমার দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি সব সময়ই উপচে পড়ছে, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনায় যানজট ও দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ব্যাপার। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল পরিশোধ করে, পরিবহনের ভাড়া মিটিয়ে সীমিত আয়ের মানুষের ধকল কমে না। এছাড়া তো চুরি, ছিনতাই, খুন, জখম লেগেই আছে। এ শহরে মানুষের দুর্ভোগের রয়েছে লম্বা ফিরিস্তি।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ এ শহরের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠছে যত্রতত্র। অথচ এসবে সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পরিকল্পিত রাস্তা, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস, সেনিটেশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠছে না। আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠছে বিভিন্ন ধরনের অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। সারা দেশের শিল্প-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও স্বাস্থ্যসেবার সব কর্মকান্ড এ শহরকে ঘিরেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষ ও যানবাহন। সে অনুযায়ী আবাসন সুবিধা ও চলাচলের ব্যবস্থার না থাকার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে শহরটি এখন বিপন্ন। কেন্দ্রীয় সরকার ঢাকা নগরীর জন্য পৃথক স্বায়ত্ত্ব-শাসিত প্রশাসনিক অঞ্চল গড়ে না তোলায় এ নগরীর সঠিক ও পরিকল্পিত উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাব খুবই প্রকট। এগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার জন্য অর্থপ্রাপ্তি একটি দুরূহ ব্যাপার।

শিরোনামেই বলেছি রাজধানীর জলাবদ্ধতা আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতীক। রাজধানীর এ অবস্থা প্রতীকি, যা দেখে দেশের সার্বিক অবস্থা বোঝা যায়। জলাবদ্ধতায় অবরুদ্ধ এ নগরীর মত আমরা ক্রমশ সবদিক থেকেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছি। জাতীয় জীবনে অস্থিরতা লেগেই আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক সংকট। রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। দুইটি বড় দলের বিপরীতমুখী মেরুকরণের মধ্যে দেশ এমনভাবে বন্দী হয়েছে যে কোনরূপ সমঝোতা আজ প্রায় অসম্ভব। হরতাল-অবরোধে দেশবাসী জিম্মী। দেশ থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অপসৃত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও অবরুদ্ধ। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা আমাদেরকে দেশে বিদেশে হেয় প্রতিপন্ন করে চলেছে। নিজেদের গৃহ বিবাদে বিদেশীদের টেনে আনা হচ্ছে। কেউ বৃহৎ প্রতিবেশীর সুনজরে থেকে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চায়, আবার কেউ পশ্চিমাদের মদদে ক্ষমতায় আসতে চায়। মনে হয় তারা কেউই জনগণের রায়ে বিশ্বাসী নয়। সুশাসন, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ও জবাবদিহিতা এখন সুদূরপরাহত। সুশাসনের সকল সূচকে আমাদের অধঃগামীতা লজ্জাজনক। নীতিভ্রষ্ট দুর্জনেরা এখন সমাজের অধিপতি। এরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পৃষ্টপোষকতা পেয়ে থাকে। অশ্লীল, শিষ্টাচার বহির্ভূত ও অসহিষ্ণু আচরণ রাজনীতিকে কলুষতি করে ফেলেছে। রাজনৈতিক আদর্শ থেকে এখন জনসেবা উধাও হয়ে গিয়ে তৎপরিবর্তে ব্যক্তি ও দলীয় সেবার রূপ ধারণ করেছে। এটা সমগ্র জাতির জন্য এক অশনিসঙ্কেত। স্বল্প সময়ের বৃষ্টিপাত যেমন রাজধানীকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে, তেমনই রাজনৈতিক অস্থিরতাও দেশবাসীকে বারবার অবরুদ্ধ করে রেখেছে। গণতন্ত্র মুক্তি পেলে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয় জীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে।

বিষয়: বিবিধ

১১২১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

339656
০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ০৭:৪৬
শেখের পোলা লিখেছেন : দায়িত্ব হীনতা মহামারী রূপে সর্বত্র বিরাজ করছে। যার ফলে দায়িত্ব বানেরা স্বর্থপরতায় ভুগছে৷ প্রথমেই প্রত্যেককে আপন দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবান হতে হবে ও সঠিক ব্যক্তিটিকেই সঠিক দায়িত্ব দিতে হবে৷ মূল্যবান আলোচনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
339670
০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ০৯:১৪
শিহাব আহমদ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
339683
০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:০৩
হতভাগা লিখেছেন : ৫ মিনিট মুষল ধারে বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহর তলিয়ে যায় । প্রচন্ড যানজটের সৃষ্টি হয় ।

এটা ঢাকা শহরের অনেক পুরনো সমিস্যা । অপরিকল্পিত নগরায়নই এর কারণ ।
339689
০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:০৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভাল লাগলো। জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা বিহিন আমলারা দেশের যত ক্ষতি করে রাজনিতিবিদরা ততটা করেনা।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File