ছেলেদের জন্য যা দুষ্টুমী মেয়েদের জন্য তা ভয়ঙ্কর
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৮ মে, ২০১৫, ১০:১১:০৬ রাত
একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ বাহিনীর প্রধান কাজ হল 'দুষ্টের দমনে আর শিষ্টের পালনে’ সরকারকে সহায়তা করা। পুলিশকে বলা হয় 'আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’ অর্থাৎ যারা আইন ভঙ্গ করে সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের হাত থেকে নিরীহ জনগণকে রক্ষা করা। পুলিশ আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিচিত্র এক দেশ এই বাংলাদেশ। এ দেশের সরকারগুলো তাদের গণতান্ত্রিক রূপ পাল্টে স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করেছে। এসব স্বৈরাচারী সরকারের প্রশ্রয়ে পুলিশ বাহিনী তাদের স্বাভাবিকতা হারিয়ে এক অস্বাভাবিক বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ যেন জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর মত অবস্থা। তারা এখন সরকারের দুষ্কর্মের সাথী হয়ে 'দুষ্টের পালনে আর শিষ্টের দমনে’ সরকারকে মদদ দিচ্ছে। সরকার তার বিরোধী পক্ষকে দমন করার জন্য পুলিশ বাহিনীর উপর এত বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে দেশ এখন পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। পুলিশ নিজেই আইন ভঙ্গ করে, আইন ভঙ্গকারীদেরকে সহায়তা দেয়, সরকারের দোষ গোপন করে সরকারের লেজুরবৃত্তি করে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে - সারা দেশ জুড়ে অবিচার, গুম, খুন, ক্রস-ফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভূত হত্যা, গ্রেফতার বাণিজ্য, হয়রানি, নির্যাতন, লুটপাট ও অরাজকতার এক স্বর্গ-রাজ্য বিরাজ করছে।
যে কোন গণতান্ত্রিক দেশের পুলিশ বাহিনী আইন প্রয়োগকারী এক নিয়মতান্ত্রিক বাহিনী হিসেবে কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলে। তাদের নিকট কেউই আইনের ঊর্দ্ধে নয়, তাই নিজেরাও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের সম্পর্কের একটি আচরণ-বিধি রয়েছে। পুলিশ বাহিনীর ছোট থেকে বড় সব সদস্যই কঠোর প্রশিক্ষণ লাভ করে একজন দায়িত্বশীল পুলিশের দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে সারদায় একটি পুলিশ প্রশিক্ষণ একাডেমী আছে বটে, সেখানে তারা কি প্রশিক্ষণ পায় তা আল্লাহই জানেন। এ দেশে একজন সাধারণ পুলিশ সদস্য ও সর্বোচ্চ কর্মকর্তার আচরণের মধ্যে তেমন কোন ফারাক আছে কি না বোঝার উপায় নেই। একজন কর্মরত সাধারণ পুলিশ তার বুট ও লাঠির ব্যবহারে যেমন অশালীন ও বর্বর আচরণের প্রকাশ ঘটায়, সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত কর্তা ব্যক্তিটির বক্তব্য প্রকাশের ভাষা ও ভঙ্গী তেমনই। মিডিয়ার কল্যাণে এখন তাদের কাজ-কর্ম ও কথা-বার্তা সবার সামনেই প্রকাশ পাচ্ছে। তারা এখন তাদের পেশাদারিত্ব ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব-কর্তব্যকে জলাঞ্জলী দিয়ে সরকারের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। এতে হয়তো তারা অবৈধ উপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু তারা হারাচ্ছে নৈতিকতা ও আত্মসম্মানবোধ। সেই সাথে ক্ষতি করছে দেশ ও জাতির।
পহেলা বৈশাখে পুলিশ সদস্যদের সামনে যখন 'দুষ্টু ছেলেরা' মা-বোন-শিশুদের উপর নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটাল তখন তারা নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করল। অথচ এই নির্যাতনের প্রতিবাদ মিছিলে এক প্রতিবাদী নারীর উপর বাহাদুর এক পুলিশের বুট ও বন্দুকের বাটের আক্রমণ সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। সেই পহেলা বৈশাখে যে 'সোনার ছেলেরা’ নারীদের উপর 'দুষ্টামী’ করল তাদের সাফাই গাইলেন প্রথমে আমাদের পুলিশের ছোট কর্তারা, পরে তাদের সাথে সুর মেলালেন পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা-ব্যক্তিটি। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে তার মনে হল, 'তিন-চারটা ছেলে দুষ্টামি করতাছে, মেয়েদের শ্লীলতাহানি করছে, কেউ আগায়া আসল না, বাকি লোক তাকিয়ে দেখল। একটা লোকও তো বলল না, এই লোকটাকে তারা চেনে। তারা তাদের বাড়ির পাশের........ টিএসসির সামনে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে চার-পাঁচটি ছেলে দুই-তিনটি মেয়েকে শ্লীলতাহানি করল। যাদের সামনে এই ঘটনা ঘটাল, সেই পাবলিকরা তাদের কেন ধরল না। ..... প্রত্যেক নাগরিকের আইনগত অধিকার আছে, তাদের সামনে অপরাধ ঘটলে তারাই তাদের গ্রেপ্তার করতে পারবে। এতে পুলিশের গ্রেপ্তার করা লাগত না।’ কি আশ্চর্য! সব দোষ এখন পাবলিকের ঘাড়ে, তারা কেন দুষ্টুদের 'গ্রেফতার’ করল না। এ যেন ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর অবস্থা। অথচ সিসিটিভির ফুটেজে চিহ্নিত অপরাধীদের ধরতে পুলিশের যত টালবাহনা। আসলে এরা তো ছাত্রলীগের 'সোনার ছেলে’ - তাই তাদের ধরতে মানা।
কি অপূর্ব এক-চোখা দৃষ্টি আর অযৌক্তিক বক্তব্য এই পুলিশ আইজি সাহেবের - এতে দেশবাসী মর্মাহত হলেও বিস্মিত হয়নি। কেননা হবুচন্দ রাজার দেশে গবুচন্দ মন্ত্রীর মত একজন কতোয়াল তো থাকতেই হবে। তা না হলে এমন সাফাই গাইতে লজ্জায় মরে যেতে হত। যারা মিথ্যার বেসাতি করে তারা সব কিছুই উল্টো করে দেখে। তাইতো পুলিশ সিসিটিভির ফুটেজে শ্লীলতাহানি বা নষ্টামীর বদলে 'পোলাপানদের দুষ্টুমী’ দেখতে পায়। এসব বুড়ো পোলাপানদের জন্য যা দুষ্টুমী তা মেয়েদের নিকট ভয়ঙ্করী। আমাদের সমাজে মেয়েদের শ্লীলতাহানির চেয়ে আর মারাত্মক অবমাননা কি হতে পারে? এ অবস্থায় অনেক মেয়ে অপমানে-দুঃখে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। আহা, ঘটনাটা যদি শাসকগোষ্ঠীর কারো মা-বোন-মেয়ে বা স্ত্রীদের উপর ঘটত তখন রাজ্য তোলপাড় হত, কত পুলিশের নওকরী চলে যেত। নিজেদের গায়ে দুষ্টুমীর আঁচ না লাগা পর্যন্ত এসব গবেটদের হুঁশ আসবে বলে মনে হয় না।
অতঃপর, আইজি সাহেবের কথার রেশ ধরেই যদি বলি, প্রকাশ্য দিবালোকে কিছু লম্পট নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর হাজার হাজার জনতা দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল। তারা কেন ছাত্র ইউনিয়নের জনৈক নেতার মত অসহায় মেয়েদেরকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এল না? অন্যায়ের প্রতিরোধে সমাজ যদি নীরব থাকে তবে এ সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতার দু'টি চরণ এখানে উল্লেখ করতে চাই: "অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে”। সবশেষে বলতে চাই, আমরা কি নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপদেশটি ভুলে গেলাম? তিনি বলেছিলেন, 'অন্যায়-জুলুমকে প্রতিরোধ কর হাত দিয়ে, সম্ভব না হলে মুখ দিয়ে, তাও সম্ভব না হলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা কর - তবে তা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচয়’। সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে আমাদের সবাইকে ঈমানের বলে বলীয়ান হতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৭০ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন