মা দিবসে মায়ের মাহাত্ম্য

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৩ মে, ২০১৫, ১০:৩৯:৩২ রাত



‘মা-দিবস’ পালনের শত বার্ষিকীতে বিশ্ব জুড়ে মায়েদের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় আপ্লুত মানব সমাজ। “যিনি দুনিয়ায় আপনার জন্য যে কারো চেয়ে বেশী করেছেন" - তাঁরই সম্মানে উৎসর্গকৃত এই ‘মা-দিবস’ পালনের বিষয়টি প্রথম যাঁর চিন্তায় আসে তিনি হলেন আন্না জারবিস নামের এক আমেরিকান নারী। মাতৃভক্ত নিঃসন্তান এই মহিলা ১৯০৮ সালে তাঁর মৃত মায়ের স্মৃতিচারণ সভায় মাকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে ছুটিসহ একটি দিবস নির্দ্ধারণের দাবী তোলেন। তাঁর এ জোরালো দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৪ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার থেকে ‘মা-দিবস’ পালনের রেওয়াজ চালু হয়। এ দিনটির প্রবক্তা জারবিসের জন্য এটা হলো এমন একটি দিন “যখন আপনি বাড়ী যাবেন, মায়ের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাবেন এবং তিনি আপনার জন্য যা সব করেছেন তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাবেন”। পাশ্চাত্য সমাজের শিথিল পারিবারিক বন্ধন পরিবার থেকে মা-বাবাকে বহু দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তাই তাদের নিকট ‘মা-দিবস’ বা ‘বাবা-দিবস’ কিছুটা হলেও গুরুত্ব বহন করে। বছরের এ দু’টি দিনে মা ও বাবাকে পৃথক পৃথকভাবে স্মরণ করা হয়। মা-বাবাকে এক সাথে স্মরণ করার সুযোগ পাশ্চাত্য সমাজে খুব কমই ঘটে। কারণ অধিকাংশই একত্রে বসবাস করেন না। আবার বেশীর ভাগ সন্তানের নিকট মায়ের একটা পরিচয় জানা থাকলেও, বাবার পরিচয় মেলা ভার।

‘মা-দিবস’ প্রচলনের কয়েক বছরের মধ্যেই দিবসটি তার আসল তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। এতে আন্তরিকতার পরশের পরিবর্তে কৃত্রিমতার প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। দেশটির চতুর বেনিয়া সম্প্রদায় মায়ের প্রতি মানুষের আবেগকে পুঁজি করে একে প্রাতিষ্ঠানিকতায় পরিণত করে ফেলে। অন্তরঙ্গ পরিবেশে মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা প্রকাশের পরিবর্তে শুভেচ্ছা কার্ড প্রেরণ ও উপহার সামগ্রী প্রদানের মেকী আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটির প্রবক্তা জারবিসকে খুবই ব্যথিত করে। এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। তিনি মা-দিবসে মেকী ভালবাসা প্রদর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন। কিন্তু ভোগবাদী পাশ্চাত্য সমাজে তাঁর এ প্রতিবাদ তেমন সাড়া জাগায়নি। মা-দিবসের আবেগ-অনুভূতি এভাবেই কৃত্রিমতার কাছে অসহায় পরাজয় বরণ করে। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে শুভেচ্ছা-কার্ড, ফুল, ক্যান্ডি, ইত্যাদি উপহার সামগ্রী ও খাবার-দাবারের এক বিশাল বাজার তৈরী হয়। মা-দিবসের বাণিজ্যের পরিমাণ ঊর্দ্ধমুখী হয়ে উঠে। আমেরিকান ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের হিসেবে এসব সামগ্রীর বর্তমান বার্ষিক বাজার মূল্য ১৯.৯ বিলিয়ন ডলার। কার্ড বিক্রেতা ‘হলমার্কের’ বরাতে জানা যায় ‘মা-দিবসে’ তারা প্রতি বছর ১৩ কোটি ৩০ লক্ষ শুভেচ্ছা-কার্ড বিক্রি করে, আমেরিকাতে খৃষ্টমাস-কার্ডের পরই এর স্থান। তবে এই বিরাট বাণিজ্যিক লেনদেনের হিসেব পাওয়া গেলেও মায়ের সাথে প্রকৃত ভালবাসার লেনদেন কতটুকু হয় তা জানা সম্ভবপর হয়নি।

বাংগালী সাহিত্যিক যাযাবর এর ‘দৃষ্টিপাত’ থেকে এখানে একটি উদ্ধৃতি দিতে চাই - “আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেঁড়ে নিয়েছে আবেগ”। আধুনিক পাশ্চাত্য জগৎ বিজ্ঞানের কল্যাণে এমন এক যান্ত্রিক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে যা মানুষের হৃদয়ের আবেগ, অনুভূতি ও ভালবাসাকে যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত করেছে। আধুনিক মানুষ তাই মানবিক চেতনাবোধ হারিয়ে তার অন্তরের সূক্ষাতিসূক্ষ অনুভূতিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে। তারা অনেকটা রোবটের মত এক যান্ত্রিক জীব। পারিবারিক ও সামাজিক মেলামেশা, যাতায়াত ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা ছেড়ে, প্রাণবন্ত প্রকৃতি ও পরিবেশের গন্ডীর বাইরে তারা এখন এক ভার্চুয়াল জগতের নিঃসঙ্গ বাসিন্দা। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে ফেসবুক, টুয়্যিটার, ইত্যাদি এখন তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের প্রধান জায়গা। টিভি-চ্যানেল, ইন্টারনেট ও ছবির জগৎ এখন তাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। তাদের এ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের প্রাচ্য সমাজকেও তছনছ করে দিচ্ছে। পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতার অতি-ব্যস্ত মানুষ পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে ইন্টারনেটের জগতে ঘুরে বেড়াতেই বেশী পছন্দ করে।

বিগত ষাটের দশকে পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, অতি-আধুনিকতা, উগ্র নারীবাদ, অবাধ যৌনতার পক্ষে এক বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠে। এসব দাবীর প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন থাকায় পরিবারগুলো ভাঙ্গনের সম্মুখীন হয়। পরিবার ও সাংসারিক জীবন পশ্চিমা সমাজে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ায় মানুষ ক্রমশই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। সামাজিক নিরাপত্তার নামে পরিবারগুলোর উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ পারিবারিক বন্ধনকে আরও ভঙ্গুর করে দিয়েছে। সংসার প্রতিপালনের এক বড় অংশ ভর্তুকি হিসেবে রাষ্ট্রের ঘাড়ে অর্পিত হওয়ায় ফলে পরিবারগুলোতে বাবা ক্রমশ এক গুরুত্বহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। সন্তানদের নিকট তিনি যেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনের এক আগন্তুক ব্যক্তি। পরিবারের প্রতি অনীহা জন্ম নেওয়ার আরও কিছু কারণ আছে। ডিভোর্স এর মধ্যে অন্যতম। এ সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা, পৃথক বাসস্থান, সন্তানদের মানসিক যন্ত্রণা ও তাদের লালন-পালনজনিত সমস্যা, মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কায় পারিবারিক জীবনকে দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়। অপরদিকে সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালন-পালনের ঝামেলায় বিয়ে করে সংসার পাততে অনেকেই ভয় পায়। তাই পাশ্চাত্য সমাজ আজ ‘লিভ-টুগেদারের’ শর্ট-কাট পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। এতে একত্রে বসবাস ও যৌনতা ছাড়া তাদের আর কোন দায় দায়িত্ব নেই। অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে ‘ওল্ড হোম’ হয় তাদের গন্তব্যস্থান।

আমাদের প্রাচ্য সমাজে পরিবার এখনও কিছুটা শান্তির নীড় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এক সময়ে আমাদের যৌথ পরিবারগুলোতে মা-বাবার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সারা বছরই পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হত, শুধুমাত্র একটি বিশেষ দিবসের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল না। কিন্তু পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমাদের সমাজও তার ঐতিহ্য ও মূল্যবোধগুলো হারিয়ে ফেলছে। আমাদের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে, জীবিকার কারণে আমরা বাবা-মায়ের সঙ্গ ছেড়ে বহু দূরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছি। অপরদিকে আমাদের একক পরিবারগুলোতেও একই সমস্যা। দিনের একটা বড় সময় আমাদের কাটে অর্থনৈতিক ব্যস্ততায়, আর আমাদের গৃহে শিশুরা নিঃসঙ্গ পরিবেশে বড় হচ্ছে। আপন ঘরে শিশুরা অনেকটা অসহায় বন্দীর মত। টিভি কার্টুন, ভিডিও গেমস, যান্ত্রিক খেলনা এসবই তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। মানবিক সংস্পর্শে মানবীয় গুণগুলো তাদের মধ্যে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেনা। কাজের চাপে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে সন্তান, তেমনই বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজ-খবর নেওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। যখন আমাদের প্রয়োজন মা-বাবার খুব কাছে থাকা, তখনই আমরা তাদের থেকে অনেক দূরে। বৃদ্ধ মা-বাবা এখন সমাজের এক বোঝা স্বরূপ বলে গণ্য হতে চলেছেন।

পাশ্চাত্য ধাঁচে ‘মা-দিবসে’ সামান্য উপহার সামগ্রী দিয়ে, মুঠোফোনে অভিনন্দন-বার্তা পাঠিয়ে বা ‘হাই-হ্যালো’ বলে মায়ের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনকে মেকী বলেই মনে হয়। যে মায়ের কঠিন-কঠোর শ্রমে আমরা লালিত পালিত হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি, সেই মায়ের প্রতি আমাদের ভালবাসাকে একটি দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা কতটা সমীচিন তা সুস্থ মাথায় ভাবতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবা কেমন আছেন, তাদের শরীর ও মনের খবর নেওয়া আমাদের নিত্য দিনের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন পথে এগুচ্ছে। আমরা অনেকেই তাদেরকে ঝামেলা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেই অথবা তারা নিজেরাই সেখানে গিয়ে উঠতে বাধ্য হন। আমাদের সমাজে ‘ঐশীর’ মত কৃতঘ্ন সন্তানেরা জন্মাচ্ছে যাদের হাতে মা-বাবারা নৃসংশভাবে নিহত হচ্ছেন। সন্তানদেরকে ওভাবেই গড়ে তোলতে হবে যাতে তাদের অন্তরে মা-বাবার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা সঞ্চারিত হয়, তাদের মধ্যে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দৃঢ়ভাবে গ্রথিত হয়।

ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা হয়েছে, মাতৃত্বকে করা হয়েছে মহান ও সম্মানিত। এটা সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশ: “আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু বছর বয়সে। আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে (৩১:১৪)”। মা-বাবার প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে তার আরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ্ বলেন, “তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তোমার জীবদ্দশায় তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে (বিরক্তিসূচক) ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে শিষ্ঠাচারপূর্ণ ভাষায় কথা বল। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, বিনম্রচিত্তে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি দয়া কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন” (১৭:২৩-২৪)। মা-বাবার প্রতি কত মমতা-ভালবাসা, কত ভক্তি-শ্রদ্ধা, কি বিনয় ও সদয় আচরণের নির্দেশ দিয়ে তাদেরকে সম্মানিত করেছেন মহান আল্লাহ্।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর এসব নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মাকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করে বলেছেন, “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত” (ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদ)। সহীহ মুসলিম ও বোখারী শরীফে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর নিকট আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের পরই সবচেয়ে বেশী শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হবেন তাদের মা। নবী (সাঃ) এর ভাষ্য মতে মায়ের মর্যাদা প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান দখল করে আছে, চতুর্থ স্থানে রয়েছেন পিতা। নামায শেষে মা-বাবার জন্য দোয়া করা ইসলামে এক জরুরী বিষয়, কারণ এটা ছাড়া আল্লাহর দরবারে অন্য দোয়াসমূহ কবুল হয় না। মা-বাবাকে অসন্তুষ্ট করলে বেহেশতে যাবার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। মায়ের ঋণ পরিশোধ করা কখনই সম্ভব নয়। মায়ের মর্যাদা চিরন্তন। এসবই আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা। সুতরাং আমাদের নিকট প্রতিটি দিনই মা-দিবসের মর্যাদায় ভূষিত হওয়া উচিত।

বিষয়: বিবিধ

১০৭০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

319924
১৪ মে ২০১৫ রাত ০২:১০
আফরা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File