নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ - পর্ব: ২
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৫:৫২:২৮ সকাল
মক্কায় আল্লাহর রসুল (সাঃ) এর নবুওতের প্রাথমিক পর্ব ছিল নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের যুগ। সসস্ত্র জিহাদের নির্দেশ তখনও আল্লাহ্ নাযিল করেননি। সে সময় নবী (সাঃ) ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে তাঁর অনুসারীদের চরিত্র সংশোধনের কাজে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। কেননা মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আত্ম শুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে তৈরী করে নিতে হয়। 'আইয়ামে জাহিলিয়াতের’ যুগে সব ধরনের পাপাচার ও অনাচারে লিপ্ত মানব সমাজকে প্রকৃত মু'মিন বান্দা হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল এ জিহাদের লক্ষ্য। নবী করিম (সাঃ) এর সংস্পর্শে একনিষ্ঠ ঈমান ও নেক আমলের দ্বারা এসব মানুষ অন্তরের পরিশুদ্ধি লাভ করে। তাদের চরিত্র ও জীবন পুরোপুরি বদলে যায়, তারা এক একটি খাঁটি সোনার মানুষে পরিণত হয়। পরবর্তীতে তিনি তাঁর এসব অনুসারীদেরকে নিয়ে মদীনায় যে একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেন তা ছিল সমগ্র বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। পাশবিক সত্তার ঊর্ধে ওঠে কিভাবে মানবিক সত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হয় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর এসব অনুসারীগণ তা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে গেছেন। শুধু নফসের বিরূদ্ধে জিহাদেই তারা সাফল্য অর্জন করেননি, সংখ্যায় নগণ্য হয়েও তারা কাফের-মোনাফেকসহ সব ধরনের আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানেও সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
নফসের বিরূদ্ধে জিহাদ ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আখিরাতে জবাবদিহির ভয় নফসের বিরুদ্ধে জিহাদকে বুলন্দ করে। তাক্বওয়া, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সংযম, মিতাচার, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে নফস পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। নফসের মন্দ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সব সময় আল্লাহর নিকট তওবা করতে হয়, ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়। নবী করিম (সাঃ) নফসের খারাবী থেকে এবং সব ধরনের মন্দ থেকে আল্লাহর দরবারে বেশী বেশী পানাহ চাইতেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। তিনি দোয়া করতেন, 'ও আল্লাহ্! আমার অন্তরে সততা দান কর এবং একে পরিশুদ্ধ করে দাও। একমাত্র তুমিই একে পরিশুদ্ধ করতে পার, কারণ তুমিই আমার অভিবাক ও প্রভু’। তিনি বলতেন, আল্লাহ্ যাকে সুপথ দেখান সে কখনও বিপথগামী হতে পারে না, আর তিনি যাকে সুপথ দেখান না সে কখনও সঠিক পথ প্রাপ্ত হয় না। সুপথের সন্ধান পেতে হলে অনুতপ্ত হৃদয়ে ভয় ও আশা নিয়ে আল্লাহর দরবারে দয়া ও ক্ষমা ভিক্ষা করতে হবে, আন্তরিক বিশ্বাস ও চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করতে হবে, পার্থিব লোভ-লালসা থেকে নিজেকে সংযত রাখতে হবে এবং নিজ ব্যক্তিসত্তাকে আল্লাহর আনুগত্যে বিলীন করে দিতে হবে। তবেই হেদায়েত প্রাপ্তির আশা করা যেতে পারে। নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ মু'মিনকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং সৎ পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখে। মহান আল্লাহ্ তাঁর মুজাহিদ বান্দার প্রতি প্রতি সন্তুষ্টি ব্যক্ত করে বলেন, "যারা আমারই পথে জিহাদ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ নেককার বান্দাদের সাথে রয়েছেন” (২৯: ৬৯)।
গুণগতভাবে নফসের তিনটি স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থানকারী নফস হলো 'নফসে মুতমায়িন্না’ যা উন্নত চারিত্রিক গুণসম্পন্ন এবং পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত থেকে মুক্ত। এধরনের নফসের অধিকারী ব্যক্তিগণ পূণ্যাত্মা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিভাজন মু'মিন বান্দা। কুপ্রবৃত্তির তাড়না ও শয়তানের প্ররোচনা তাদের ওপর কার্যকরী হতে পারে না। শয়তান তাঁদের ব্যাপারে নিরাশ ছিল যখন সে অন্যদের সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ করেছিল, "সে বলল, তোমার ইজ্জতের কসম, তাদের সবাইকেই আমি বিপথগামী করে ছাড়ব, শুধু তোমার একনিষ্ঠ বান্দাগণ ব্যতীত” (৩৮: ৮২-৮৩)। এসব একনিষ্ঠ বান্দাই হলো 'নফসে মুতমায়িন্না’র অধিকারী। মধ্যম স্তরে রয়েছে ‘নফসে লাওয়ামা’ যা ভাল মন্দে মিশ্রিত এবং সব সময় নিজেকে ধিক্কার দেয়। তারা ওইসব মু'মিন বান্দার অন্তরে বিদ্যমান যারা মাঝে মধ্যে ভুল করে পাপ কাজ করে ফেলে, কিন্তু যখন ভুল বুঝতে পারে তৎক্ষণাৎ অনুশোচনা ও অনুতাপে দগ্ধ হয়ে নিজেকে ধিক্কার দেয়, আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে ও তওবা করে। আবার যখন ভাল কাজ করে তা আরো ভালভাবে করতে না পারার আক্ষেপেও নিজেকে ধিক্কার দেয়। শয়তান তাদেরকে নিয়ে বিব্রত বোধ করে। সব চেয়ে নীচের স্তরের নফস হলো 'নফসে আম্মারা’ যা ক্রমাগত পাপাচারের দ্বারা নিজেকে কলুষিত করে ফেলেছে। এ রকম নফসের যারা অধিকারী তাদের চোখ, কান ও অন্তরে পর্দা পড়ে গেছে, বোধ শক্তি হারিয়ে গেছে। তাই তাদের কাছে সব অপকর্মই শোভনীয় মনে হয়। এ ধরনের মানুষ পশুর মতই নিকৃষ্ট, এমনকি পশুর চেয়েও অধম। শয়তান এদের ব্যাপারে অতি উৎসাহী।
অধিকাংশ মানুষেরই পরকালের প্রতি বিশ্বাস খুবই কম। তারা এ দুনিয়ায় এমনভাবে অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত থাকে যে তারা এটাকেই শোভনীয় মনে করে। পার্থিব জীবনের লোভ-লালসায় তারা অন্ধ হয়ে গেছে। বিবেকহীন পাশবিক সত্তার দ্বারা তাড়িত তারা মনে করে মৃত্যুই সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেবে। মরে গেলে এ জীবনের কাজকর্মের কোন হিসাব দিতে হবে না। এদের সম্পর্কে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "আপনি কি তাকে দেখেন না, যে তারা প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন?" (২৫: ৪৩)। এটা কোন যৌক্তিক কথা নয় যে, মানুষকে পরকালীন জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে না। কারণ অনেকেই অন্যায় অপকর্ম ঘটিয়ে এ দুনিয়ার বিচারকে ফাঁকি দিতে পারে, কিন্তু আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায় বিচারক হিসেবে নিশ্চিতভাবেই সব মানুষকে ক্বিয়ামত দিবসে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। যারা পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে অবিশ্বাস পোষণ করে তাদেরেক স্বয়ং আল্লাহ্ প্রশ্ন করেন, "তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছ যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না?" (২৩: ১১৫)। মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়ায় নিজ নিজ দায়িত্ব পালন শেষে এক দিন সবাইকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে। তাই মানব জাতিকে সতর্ক করে আল্লাহ্ বলেন, "হে মানুষ, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং, পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারণা না করে। এবং সেই প্রবঞ্চক (শয়তান) যেন কিছুতেই তোমাদেরকে আল্লাহ্ সম্পর্কে প্রবঞ্চিত না করে” (৩৫: ৫-৬)।
এ পৃথিবী মানুষের জন্য একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র। এখানে চলছে সত্য বনাম মিথ্যা, শুভ বনাম অশুভ, ন্যায় বনাম অন্যায়ের এক চিরন্তন প্রতিদ্বন্দিতা। এগুলোকে ঘিরেই চলছে মানুষের অন্তরে মানবিক সত্তার সাথে পাশবিক সত্তার সংগ্রাম। নফসের বিরুদ্ধে এই জিহাদে আল্লাহ্ চান, তিনি মানুষকে যে স্বাধীন ব্যক্তিসত্তা দান করেছেন সে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে, তিনি যে ঐশী জ্ঞান দান করেছেন তার দ্বারা মানুষ তার মানবিক সত্তাকে বলীয়ান করবে, এবং পাশবিক সত্তাকে পরাভূত করে দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য অর্জন করবে। আর এ দুনিয়ায় সে ব্যর্থ হলে একদিন তাকে এর জন্য জবাবদিহি করতেই হবে। কেননা আমরা সবাই মহান স্রষ্টা আল্লাহর নিকট থেকেই এসেছি এবং মৃত্যুর পর তাঁরই নিকট ফিরে যাব। বিচার দিবসে আমরা কি আমল নিয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হব মৃত্যুর পূর্বেই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। নিজ কামনা-বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যেই রয়েছে বিরাট সাফল্য, এর জন্য সর্ব শক্তিমান আল্লাহর আশ্বাস বাণী হলো: "যেহেতু সে তার প্রভুর সম্মুখে দাঁড়ানোকে ভয় করেছে এবং তার নফসকে কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখতে পেরেছে, অবশ্যই জান্নাত হবে তার আশ্রয়স্থল” (৭৯: ৪০-৪১)। (সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
১৩৩০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মালিকের মুয়াত্তা হাদিস ২.২৩.৯০:
ইয়াহিয়া—মালিক—নাফি থেকে। ইয়াহিয়া বললেন যে আবদুল্লাহ ইবনে উমরের ক্রীতদাসীরা তাঁর পা ধৌত করতো এবং তাঁর কাছে খেজুর পাতার তৈরি এক মাদুর নিয়ে আসত। সে সময় তারা ঋতুমতী ছিল।
মালিককে জিজ্ঞাসা করা হল কোন এক ব্যক্তি গোসল করার আগেই কি তার সব ক্রীতদাসীদের সাথে যুগপৎ সহবাস করতে পারবে? তিনি (অর্থাৎ মালিক) উত্তর দিলেন যে গোসল ছাড়াই পরপর দুইজন ক্রীতদাসীর সাথে সহবাসে কোন অসুবিধা নাই। কিন্তু যখন কোন স্বাধীন স্ত্রীর সাথে সহবাসের দিন থাকবে সেদিন অন্য আর এক স্বাধীন স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম করা যাবে না। কিন্তু এক ক্রীতদাসীর সাথে যৌন সঙ্গমের পর সাথে সাথে অন্য ক্রীতদাসীর সাথে সহবাস করা আপত্তিকর নয়—যদিও তখন লোকটি জুনুব (সহবাসের পর তার কাপড়ে অথবা দেহে বীর্য ও অন্যান্য কিছু লেগে থাকা)।
এরপর মালিককে জিজ্ঞাসা করা হল। এক ব্যক্তি সঙ্গম করল এবং জুনুব হয়ে গেল। তার কাছে পানি আনা হল গোসলের জন্য। সে ভুলে গেল গোসল করতে। পানি উত্তপ্ত না শীতল তা জনার জন্যে সে তার আঙ্গুল ডুবিয়ে দিল পানির মাঝে”। মালিক উত্তর দিলেন: “তার আঙ্গুলে যদি কোন ময়লা না থাকে তবে আমার মনে হয় না ঐ পানিকে দুষিত বলা যাবে”।
তোমাদের দেখে খুব দুঃখ হয়, করুনা হয়। জানই শুধু এই কয়েকটা কথা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব জায়গায় এই কয়েকটা কথায় ব্যাবহার কর। তাল গাছের রচনা লিখতে বললে, গরু কে তাল গাছের সাথে বেঁধে রেখে গরুর রচনা লিখা শুরু কর। কারন তোমার জানই তো গরুর রচনা ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন